Wednesday, March 11, 2009
# ম্যালা কথা বইমেলায়। ০৫। যাঁরা মেলায় যান নি।
ম্যালা কথা বইমেলায়। ০৫। যাঁরা মেলায় যান নি।
রণদীপম বসু
[চলমান সতর্কবাণী ঃ এই সিরিজের পর্বে পর্বে বর্ণিত চরিত্রে কিংবা ঘটনা প্রবাহে কেউ কোনরূপ সাদৃশ্য বা মিল খুঁজিয়া পাইলে তাহা ব্যক্তির স্বেচ্ছাকল্পিত অতি সৃজনশীলতা বলিয়া গণ্য হইবে]
যে কোন কারণে হোক, যাঁরা এবার মেলায় যান নি বা যেতে পারেন নি তাঁদের জন্য উৎসর্গিত এই পোস্ট।
এবারের বইমেলার সরকারি নাম ছিলো ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০০৯’। বাঙালির ঐতিহ্যমাখা বাংলা একাডেমি চত্বরে আয়োজিত এই বইমেলা হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথই পেরিয়ে এলো। পূর্বনাম ‘পুঁথিঘর’ পরবর্তীতে ‘মুক্তধারা’ প্রকাশনীর প্রয়াত প্রতিষ্ঠাতা স্বত্বাধিকারী বাবু চিত্ত রঞ্জন সাহা’র বাংলা একাডেমি চত্বরে চট বিছিয়ে বই মেলে বসে থাকা ফেব্রুয়ারির খুব ছোট্ট একটা ব্যক্তিগত উদ্যোগ থেকে আজকের যে বিশাল একুশে বইমেলার রৈ রৈ আয়োজন অবয়ব, এটাকে হয়তো একটা গ্রন্থযুদ্ধই বলা যেতে পারে। শত শত প্রকাশনি, হাজার হাজার লেখক আর লক্ষ লক্ষ পাঠক ক্রেতার উচ্ছ্বসিত সমাবেশে আজ কোলাকুলি-কিলাকিলি, মাতামাতি-হাতাহাতি, গলাগলি-গালাগালির যে উদ্বাহু সরবতা প্রবহমান একে তো যুদ্ধই বলতে পারি আমরা।
আর তাই এই যুদ্ধের পেছনে কতো পরিকল্পনা, কতো নীতি, কতো নীতিহীনতাও লুকিয়ে আছে কে জানে। যাঁরা জানার তাঁরা হয়তো ঠিকই জানেন, আমরা জানি না। এই যুদ্ধ পরিচালনার জন্য মেলা প্রাঙ্গনে খোলা যে সিস্টেম বা ফ্রন্টগুলো চর্মচক্ষের অপরিকল্পিত অটো-রাডারে এমনিতেই ধরা পড়েছে তাকে সময়ের দাগে চিহ্ণিত করা আদৌ জরুরি কিনা জানি না। তবে নাই কাজ তো খই ভাজ জাতীয় বেকার প্রয়াস বললে নিজের উপরই অবিচার হয়ে যায়। তবু এরকম কোন উদ্দেশ্য হয়তো অবচেতনেই রয়ে গেছে এই উদ্যোগের পেছনে। তাহলে এবার কিছু খৈ ভাজা যাক।
একটু দাঁড়াও, এটা মেলার প্রবেশ তোড়ন...
অন্যবারের চেয়ে এবারের বইমেলার দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রধান পার্থক্যটাই ছিলো মেলার পরিসর একাডেমির নিজস্ব প্রাঙ্গন ছেড়ে বাইরের প্রধান রাস্তায় টেনে সম্প্রসারণ করা। আসলে সম্প্রসারণ বললেও ভুল হবে। মূলতঃ বাংলা একাডেমির নির্মীয়মান নতুন ভবনটি একাডেমি প্রাঙ্গনের বিরাট জায়গা খেয়ে ফেলায় পরিসর এতো বেশি সঙ্কুচিত হয়ে গেছে যে, মেলার আগের অবয়ব বা আকারটাকে ধরে রাখতেও এর গত্যন্তর ছিলো না। তাই টিএসসি থেকে দোয়েলচত্বরগামী প্রধান সড়কটাও এবার মেলার অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেছে। দু’দিকের দুটো তোড়নই ছিলো মেলার প্রবেশ মুখ।
আর রাস্তার মধ্যে মেলা চলে আসার কারণেই কিনা, আগত ক্রেতা পাঠক দর্শনার্থীর কোন কমতি না থাকলেও অন্যবারের মতো এবার আর মেলায় ঢুকতে কোন দুঃসহ দীর্ঘ লাইন ধরতে হয়নি। গতবার তো এরকম কয়েকবারই হয়েছে যে মেলা প্রাঙ্গন থেকে প্রায় এক কিলো দূরে সেই শাহবাগ মোড়ে বা অন্যদিকে কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারের প্রায় কাছাকাছি জায়গা থেকেই লাইন ধরতে হয়েছে। তবে বাংলা একাডেমির চমৎকার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবার তার নিজস্ব সীমানা প্রাচীর ভেঙে দুটো গেটের মাঝামাঝি আরেকটি প্রধান ফটক তড়িঘড়ি নির্মানও এই অসহনীয় জটমুক্তির অন্যতম প্রধান কারণ হতে পারে।
বাংলা একাডেমি পুস্তক বিক্রয় কেন্দ্র, হ্রাসকৃত মূল্য...
একমাত্র এই বইমেলা ছাড়া একাডেমির এই স্থায়ী পুস্তক বিক্রয়কেন্দ্র থেকে চাকুরেদের জন্য অফিস টাইমের মধ্যে বই কেনা বা সংগ্রহ করা কখনোই সম্ভব নয়, যদি না অফিস ফাঁকি দেয়া হয়। ফলে মেলা চলাকালীন সময়ে সারাক্ষণই বিক্রয়কেন্দ্র দুটোকে সরব থাকতে দেখা গেছে। একটিতে ৩০% হ্রাসকৃত মূল্যে বই বিক্রি এবং অন্যটিতে ন্যুনতম দশ বছর আগের প্রকাশনাগুলো ৫০% হ্রাসকৃত মূল্যে বিলি করে স্টক খালি করার প্রয়াস নেয়া হয়েছে। এমনিতে এবারের মেলায় সবার জন্য ২৫% ডিসকাউন্টে বই বিক্রির নিয়ম কড়াকড়ি ছিলো। গতবারও তাই ছিলো। তবে তার আগেরবার অর্থাৎ ২০০৭-এ ছিলো সম্ভবত ৩০%। একাডেমির বিক্রয়কেন্দ্র বাদে বাকি বইয়ের ক্ষেত্রে এই ডিসকাউন্ট প্রথাটা কেন যেন খুব ঘোরালো মনে হয়। এটা কি এক ধরনের ক্রেতা ঠকানো নয় ?
আমাদের দেশের প্রায় সব প্রকাশনাই বইমেলা কেন্দ্রিক হয়ে ওঠায় লেখক রয়্যালিটি (যদি সত্যি তা লেখককে দেয়া হয়), প্রকাশনা ব্যয়, বিপণন ব্যয়, প্রকাশকের মুনাফা ধরেই যদি বইয়ের বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হতো, তাহলে প্রকাশকের প্রকৃত মুনাফা আসলে কত, যে, তা থেকে ২৫-৩০% হ্রাসকৃত মূল্যে বিক্রি করেও প্রকাশকের ঘটি বাটি বিক্রি করতে হয় না ! আসলে হ্রাসকৃত মূল্যের পরিমাণটাকে প্রকৃত মূল্যের সাথে যোগ করেই বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। বাস্তবে এই যদি হয় তাহলে মূল্যহ্রাসের এই অনৈতিক ভড়ং দেখিয়ে পাঠককে প্রতারণা করার দরকারটাই বা কী এর জবাব কেউ দেবেন ? বাঙালি মনস্তত্ত্বের কোথাও না কোথাও মাগনা খাওয়া বা ভিক্ষাবৃত্তির পাশাপাশি লোক ঠকানোর একটা তীব্র প্রবণতা খুব সক্রিয়ভাবে রয়ে গেছে হয়তো। আর এজন্যই হয়তো আমাদের আত্মসম্মানবোধে এই ঘটনাগুলো কখনো নাড়া দিতে দেখা যায় না।
নজরুল মঞ্চ, মোড়ক ‘উম্মোচন’ এবং উন্মোচন কেন্দ্র...
একাডেমি প্রাঙ্গনে বর্ধমান হাউসের সামনেই সুশীতল বটবৃক্ষটার ছায়ায় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আবক্ষ ভাস্কর্য মূর্তিটা ঘিরে ইট সিমেন্ট বাধানো প্রশস্ত বেদীটার মধ্যে এবারের মেলায় প্রকাশ হতে থাকা বইয়ের মোড়ক উম্মোচন এবং উন্মোচনের ধুম লেগে থাকে।
সাধারণের মধ্যে এর কৌতুহলও কম ছিলো না। লেখক প্রকাশকরা সঙ্গি-সাথিসহ আপামর পাঠকের কাছে নতুন বই প্রকাশের ম্যাসেজটা এখান থেকেই প্রথম ঘোষণা দেন। তবে ঘোষণার সময় যে মজার বিষয়টা বারবারই লক্ষ্য করা গেছে, যাদেরকে উদ্দেশ্য করে এ ঘোষণা সেই আম-পাঠকরা কিংবা অতিউৎসাহী দর্শনার্থীরা সম্মুখাংশের বদলে পেছনভাগটা দখলে রাখতেই বেশি মনোযোগী ছিলেন। এ উছিলায় নিজেদের খুবসুরৎ চেহারাটা মিডিয়ার ক্যামেরায় ধরে রাখাতেই আগ্রহ তাদের বেশি ছিলো।
ফলে ভীড়ের ঠেলায় ঘোষণাকারীদেরই ঘোষণামঞ্চ থেকে ছিটকে পড়ার অবস্থা। আর যারা শোনার কথা তারা তখন ক্যামেরার চোখে চোখ রেখে বিভিন্ন পোজ ধরাতেই ব্যস্ত। যেহেতু এখানে কোন লাউড স্পীকার ছিলো না, তাই পাশেই একাডেমির বিরতিহীন অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে জোরালো শব্দের বিবর্ধিত আওয়াজে চাপা পড়ে মোড়ক উন্মোচন আসলেই উম্মোচনের দশায় পরিণত হচ্ছিল। এজন্যই কি মাসব্যাপি মেলার শেষ প্রান্তে এসে সংশোধনের আগ পর্যন্ত গোটা মাস ধরে মঞ্চের পেছনের দু-দুটো বিশাল বোর্ডে বিরাটাকার উন্মোচন বানানটাকে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ ‘উম্মোচন’ বানিয়ে রেখেছিল ?
লেখক কুঞ্জ, কথা ছিলো আড্ডা হবে...
বটবৃক্ষটার নিচেই নজরুল মঞ্চের ঠিক পেছনে লেখকদের সাথে পাঠকের একটা দৃশ্যমান যোগসূত্র ঘটানোর উদ্দেশ্যেই হয়তো লেখককুঞ্জের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিলো।
পাঠকের সংযোগ না ঘটলেও অনেককেই দীর্ঘসময় এখানে বসে থাকতে দেখা গেলো যাঁরা লেখক হিসেবে নিজেদেরকে পরিচিত করানোর প্রত্যাশা হয়তো করেছিলেন। কিন্তু আমাদের তথাকথিত সম্ভ্রান্ত লেখকদেরকে এই লেখক কুঞ্জের আশেপাশে দেখা যায় নি। তাঁরা বিভিন্ন প্রকাশনার স্টলে অটোগ্রাফ বাণিজ্যে দিনভর এতোটাই ব্যস্ত ছিলেন যে, ভক্তকূল ছাড়া স্বাভাবিক ও সাধারণ পাঠকরা ওইসব স্টলে গিয়ে যে কোন বইয়ের খোঁজ করবেন তার উপায় থাকে নি।
তবে ব্যতিক্রম হিসেবে লেখক মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে দেখা গেলো লেখক কুঞ্জের পাশেই বেদীর ধারটাতে বসে শিশু থেকে বয়স্ক অনুরক্তদের ইচ্ছা পূরণ করতে। হয়তো এজন্যই তিনি শ্রদ্ধাভাজন জাফর ইকবাল। কষ্ট লাগলো চির তরুণ এই ব্যক্তিত্বের প্রিয় চেহারায় চলে যাওয়া সময়ের অনিবার্য রেখাগুলো হঠাৎ করেই যেন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে ওঠছে !
আজকের বই, বর্ধমান হাউসের তথ্য-দেয়াল...
প্রতিদিন মেলায় যে সব বই প্রকাশিত হচ্ছিল সে বইগুলোর কভার নির্দিষ্ট দেয়ালগাত্রে সেটে দিয়ে পাঠক অবগতি ও আকর্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিলো। কিন্তু যে পরিমাণ বই প্রতিদিন আসছিল বা গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর কভার কি সত্যি সত্যি এখানে সাটা হচ্ছিল ? মনে হয় না। তবে এ অঞ্চলটা তারুণ্যের মুখরতায় উজ্জ্বল ছিলো।
নানা রঙ নানা সুর, একুশে অনুষ্ঠান মঞ্চ...
এখানেই জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহান একুশে বইমেলার শুভ উদ্বোধন করেন।
বর্ধমান হাউসের ঠিক পার্শ্ববর্তী খোলা স্থানটিতে কালো পর্দা টানানো বিশাল মঞ্চ আর শ্রোতা দর্শকের জন্য সুপরিসর বসার ব্যবস্থা রেখে তৈরি করা এ আয়োজনটি মাসব্যাপি সেমিনার, আলোচনা, বক্তৃতা, আবৃত্তি, সংগীত, নাটক, পুরস্কার বিতরণ ইত্যাদি অনুষ্ঠানমুখরতায় খুবই সরগরম ছিলো। তবে এখানেই দর্শক সারিতে চেয়ার বাইড়াবাইড়ির মতো লজ্জাজনক ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে। বুঝাই যাচ্ছে যে এতো সংস্কৃত প্রভাবেও আমাদের বাঙালি রুচি থেকে জংলি খাসিলতটা এখনও কেটে যায় নি।
তথ্য কেন্দ্র, তথ্যের সমাহার এবং...
মেলা প্রাঙ্গনে ঢুকলেই মাইকে কিছু বিরতিহীন ধারাবর্ণনা শুনতে পাওয়া যায়। বইয়ের নাম অমুক, লেখক তমুক, বইটি প্রকাশ করেছে সমুক প্রকাশনী ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ঘোষণাগুলোই আসছিলো তথ্য কেন্দ্র থেকে। প্রতিদিন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকাশকদের সরবরাহকৃত তালিকা পাঠ করে করে আগত দর্শনার্থীদেরকে ঐদিনের প্রকাশিত বইয়ের তথ্য অবগত করানোর ব্যবস্থাটা ভালোই। অবশ্যই আরেকটি ভালো উদ্যোগ ছিলো মেলার কোন সমস্যা বা হারানো বিজ্ঞপ্তির ঘোষণা।
এ ছাড়া মেলার যেকোন তথ্যসহযোগিতার জন্য বর্ধমান হাউসের পশ্চিম পাশের প্রশস্ত বারান্দার একাংশ জুড়ে বসানো এই তথ্য কেন্দ্রের কাছাকাছি অবস্থানে ছিলো ভাস্কর্য মোদের গরব। যেখানে বিভিন্ন টিভি মিডিয়ার অবস্থানের কারণে মেলার ভীড়টা সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা গেছে এখানেই। এবং তথ্য কেন্দ্রের পাশেই বারান্দার আরেক অংশে বিভিন্ন প্রতিবাদ ক্যাম্পেইনগুলোও অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়।
‘মোদের গরব’, মিডিয়ার প্রক্ষেপন কেন্দ্র...
ভাস্কর অখিল পালের বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন নির্ভর চমৎকার অর্থপূর্ণ মডেল অনুসারে শিল্পী গোপাল চন্দ্র পালের নির্মিত দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য ‘মোদের গরব’-এর সামনেই ছিলো প্রতিদিনের ইলেকট্রনিক মিডিয়ার লাইভ সম্প্রচার কেন্দ্র। প্রায় সবগুলো চ্যানেলই এই জায়গাটা থেকে মেলার লাইভ সাক্ষাৎকার, লেখক ও বই পরিচিতি এবং তথ্য সম্প্রচার করেছে।
আর এ জন্যই মেলা চলাকালীন এ জায়গাটা ছিলো নতুন-নতুনিদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা, নিজেদেরকে কোনভাবে যদি ক্যামেরার চোখে একটু ধরিয়ে দেয়া যায় ! এই সামান্য চাওয়াটুকুর ভীড়ে জায়গাটা এতোই ব্যতিব্যস্ত ছিলো যে, মেলায় বই বেরিয়েছে এমন লেখক লেখিকাদের অনেকেই বইটি হাতে নিয়ে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেও পিছপা হন নি। টিভি মনিটরে পর্দায় সামান্য কয়েক মুহূর্তের জন্য লাইভ সাক্ষাৎকারের দ্যুতি ছড়ানোর এই তীব্রতম আশা নিয়ে অনেক প্রসিদ্ধ লেখককেও এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনেকেই বেশ মজা পেয়েছেন। আহা, নিজেদেরকে প্রদর্শনযোগ্য করে তোলার জন্য আমরা কত কীই না করি !
সময় ভাঙার হাট, লিটল ম্যাগাজিন চত্বর...
ওগুলো কি কেওড়া গাছ ? দুটো বড় গাছের ভিত্তিমূল বাঁধিয়ে গোলাকার দুটো বেদীতে লিটলম্যাগ কর্মীদের সম্ভাব নিয়ে বসার স্থানটা ঠাসবুনুনির মতো হলেও স্বপ্নবান তারুণ্যের উচ্ছ্বাসকে এই আপাত বাধা অবশ্য দমিয়ে রাখতে পারে নি, পারার কথাও নয়। কেননা প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধবাদী আদর্শ ধারণ করে যে তরুণ লিটলম্যাগ কর্মীরা তাদের তারুণ্যকে নিবেদন করেন, সেখানে সামনে প্রচল বাধাকে অপ্রতিরোধ্য বাধা মনে না করাই তো এদের উদ্যমসূত্র।
মেলাকে ছুঁয়ে থাকা মেলা, ধোঁয়া আর তারল্য...
মেলায় আগত দর্শনার্থীদের মোট সংখ্যাকে যদি স্টল সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা হয়, যে ফলাফল বেরোবে, গাণিতিক নিয়মে তাকেই স্টলপ্রতি গড় দর্শনার্থী সংখ্যা ধরে নিতে পারি। এই গড় সংখ্যার সাথে অবশ্য সম্ভাব্য যা ঘটেছে সেই প্রকৃত সংখ্যার গরমিল থাকাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কেননা দর্শনার্থীদেরকে তো কেউ দিব্যি দিয়ে মেলায় প্রবেশ করায় নি যে ওটাতে যেতে হবে ওটাতে নয়। কিন্তু বর্ধিত মেলা এরিয়ার মধ্যেই যে ব্যতিক্রমী স্টলটিতে লোক সমাগমের রেট সবচেয়ে বেশি ছিলো বলে জোর বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে তা হলো সবচেয়ে কাছাকাছি শীববাড়িস্থ ব্যাচেলার্স ষ্টাফ কোয়ার্টার্স গেট সংলগ্ন চা স্টলটিতে।
এত্তোবড় জমজমাট একটা মেলার পবিত্রতা ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্যে মেলায় পান সিগারেট সেবন ও বিক্রি নিষিদ্ধ হওয়ায় শুধুমাত্র চা কফি পানি কিংবা ফুচকা পপকর্নের জন্য বাংলা একাডেমির গলাকাটা কেন্টিনটাতে অনেকেই হয়তো গিয়েছেন। কিন্তু গোটা মেলার বাদবাকি সব চাপ পড়েছে গিয়ে মেলার মূল প্রাঙ্গন থেকে বেরিয়ে শীববাড়িস্থ ওই বাদাইম্যা গোছের চায়ের দোকানটাতেই, যার একটা টেবিল মাত্রই সম্বল। পাশে পানি পান সিগারেট ও কফি পানের ব্যবস্থা থাকায় আড্ডারু তরুণ যুবকদের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে সারাক্ষণই জমজমাট ছিলো এই চিপাগলিটা। ধুমপায়ী লেখক পাঠক ক্রেতা আড্ডারুদের জন্য এটা একটা বিরাট সুযোগ বৈ কি !
অন্তর্জালিক ব্লগারাড্ডা, শুদ্ধস্বর...
এবারের মেলায় একটামাত্র কর্ণার ছিলো ‘মোদের গরব’ ভাস্কর্যটির ঠিক পেছন বরাবর, যেখানে কেবল সিঙ্গেল সারিতে গুটিকয় স্টল ছিলো। অপর পার্শ্বে কোন স্টল থাকার সুযোগ ছিলো না। যা ছিলো তা কিভাবে যে খাপে খাপে জায়গামতো মিলে গেলো ভাবতেই আশ্চর্য হই। একটা খোলা বারান্দা ! সচল প্রকাশনার উৎসকেন্দ্র শুদ্ধস্বর প্রকাশনের স্টলটি বারান্দার ঠিক উল্টো এই সারিতে না হয়ে মেলার অন্য কোথাও বরাদ্দ হলে এবারের মতো এমন ব্লগারাড্ডারুদের আড্ডাটা আদৌ এতোটা জমজমাট হতো কিনা ঘোরতর সন্দেহ থেকেই যায়। এক্কেবারে সোনায় সোহাগা অবস্থা। অদৃশ্য কোন সত্তায় কখনোই বিশ্বাসী ছিলাম না এবং এখনো নই। তবু মনে হয় কে যেন কানে ধরে সব সচলগুলোকে এক জায়গায় মিলিয়ে দিয়ে একটা হৈহুল্লোড়ের মেলা বসাতে চেয়েছিলো।
এবং হয়েছেও তাই। কোত্থেকে কতগুলো গাছের গুঁড়ি এনে মোড়ার মত বানিয়ে ওই বারান্দাতে যে আড্ডা কেন্দ্রটা গড়ে ওঠেছিলো, গোটা মেলার সবচেয়ে প্রাণোচ্ছল ও আকর্ষণীয় জায়গা হয়ে ওঠলো এটাই। এই বারান্দার সিংহভাগ জুড়ে প্রথম দিন থেকে একুশে ফেব্রুয়ারির আগ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানটি জোরেসোরে খুব সফলভাবে চালিয়েছেন তরুণ উদ্যমী কিছু ব্লগার ভাই। এবং এই বারান্দাটাই হয়ে ওঠেছিলো চেনা-অচেনা বিভিন্ন ব্লগের অন্তর্জালিক লেখক পাঠক বন্ধু-বন্ধুনিদের এক অভূতপূর্ব প্রাণকেন্দ্র।
এই কর্ণারের সর্বশেষ স্টলটাও ছিলো সম্ভবত এই মেলার একমাত্র সাজসজ্জাহীন স্টল, যাকে কাছে থেকে দেখেও ভালো করে না তাকালে বুঝার উপায় ছিলো না যে ওটার নাম ‘ভোরের শিশির’। এটাই কি মেলার সবচেয়ে গরীব স্টল ? না কি সমস্ত সাজ-সজ্জার বিরুদ্ধে এক উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদ ও ব্যতিক্রম ?
মাসব্যাপি দীর্ঘ এই বইমেলা যা বাঙালির প্রাণের মেলা, এখানে জান্তে-অজান্তে আরো বহু বহু ঘটনাই হয়তো ঘটেছে। মেলার আভ্যন্তরীণ বিষয় ছাড়াও পিলখানা ট্র্র্যাজেডির মতো রাষ্ট্রিয় বিষাদময় ও রহস্যপূর্ণ ঘটনাও ঘটেছে যা মেলাকে তীব্রভাবেই প্রভাবিত করেছে। বয়ানকারী হিসেবে ব্যক্তিগত আবেগ, সীমাবদ্ধতা, সময় সুযোগের ঘাটতি সবকিছু মিলিয়ে মাসব্যাপি বিরাট এই আয়োজনের যে কোন সংক্ষিপ্ত বর্ণনাই যে ভয়াবহ রকমের অসম্পূর্ণতায় ভরা তা বলাবাহুল্য। তবু এই সঙ্গতিহীন অসম্পুর্ণতাটুকুই না হয় উপস্থাপন ব্যর্থতার নমূনা-চিহ্ণ হয়ে থাক।
[sachalayatan]
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment