Saturday, March 7, 2009
# প্যাডেল...
প্যাডেল...
রণদীপম বসু
‘এই খালি... !’
সম্মতিসূচক ব্রেক কষেই রিক্সাটা দাঁড়িয়ে গেলো। ঝটপট চড়ে বসেই বললাম- একটু টেনে যান ভাই, দেরি হয়ে গেছে। মেজাজ ভীষণ খাপ্পা হয়ে আছে। নিজের উপরেই। বাঁ হাতের কব্জিতে ন’টা বেজে দশ। সেই পৌনে নয় থেকে রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। তিন রাস্তার মোড়টাতে। একটার পর একটা রিক্সা আসছে যাচ্ছে। কাজীপাড়া, শ্যাওড়াপাড়া, পীরের বাগ, মিরপুর-একে যাত্রীদের নিচ্ছে ঠিকই। কিন্তু এতো কাছের গন্তব্য আমার, মিরপুর দুই’টাই পছন্দ হচ্ছে না তাঁদের ! কী আশ্চর্য, চালকের পছন্দেই আজকাল গন্তব্য নির্ধারণ করতে হবে নাকি !
জোরসে টেনে গেলে ন’টার অফিস পৌঁছতে এখনও ন’টা পঁচিশ বেজে যাবে। লিফট আর হেনতেন করে আরো পাঁচ মিনিট। মানে সাড়ে নয় ! খাপ্পা হবো না কেন ! গোঁড়ালি ফেটে হা হয়ে যাওয়া পা ঘষটে ঘষটে হাঁটতে থাকলেও তো এতক্ষণে নিজের ডেস্কেই থাকতাম ! ন’টাতেই নোট সহ গুরুত্বপূর্ণ ফাইলটা বসের টেবিলে পেশ করার কথা। ছাগলামী করে এই পঁচিশটা মিনিট রিক্সাই খোঁজলাম। প্রতিবারই মনে হয়েছে, ওই যে পেছনে খালিটা আসছে ওটা হয়তো যাবে। শীট ! ঘাট হয়েছে ! রেগেমেগে প্রতিজ্ঞাও করে ফেলেছি প্রায়, শালার রিক্সাই চড়বো না আর ! পনের মিনিটের হাঁটা পথে আবার রিক্সা কিসের ! যাক্, এই রিক্সাটা সাথে সাথেই রাজী হয়ে গেছে।
কিন্তু এ কী ! রিক্সা তো টানছেই না ! শীর্ণদেহী চালককে তাড়া দিতে গিয়েও থেমে গেলাম। চোখ পড়লো রিক্সার প্যাডেলে। গোড়ালির একটু উপর থেকে বেঁকে যাওয়া প্রতিবন্ধী পা’টার দিকে। হাতের চেয়েও সরু হয়ে যাওয়া অক্ষম পা’টার দিকে তাকিয়ে ভেতরের ক্ষোভ উষ্মা সব গলে গেলো।
‘আপনি শুরুতেই অন্যদের মতো জিজ্ঞেস করলেন না যে, কই যাবো ?’
‘ভুল হইয়া গ্যাছে ছ্যার ! রিশকা চালাইয়া খাই, যেইহানে কন সেইহানেই তো যামু। আমাগো আবার...’
হাঁফাতে হাঁফাতে কথাগুলো বললো ঠিকই, বুঝলাম খুব কষ্ট হচ্ছে বেচারার। কথা আর না বাড়িয়ে দৃষ্টি নীচু করে একদৃষ্টিতে রিক্সার প্যাডেল ঘিরে পা দুটোর উঠানামা দেখতে থাকলাম। নিশ্চয়ই ঢাকায় নতুন এসেছে। গ্রাম্য সারল্যটুকু এখনো ছাড়তে পারেনি বলে হয়তো জীবিকার তাগিদে রিক্সাচালনার মতো আনফিট কাজটাই নিরূপায় বেছে নিয়েছে। সারল্যে ভরা অসহায় মুখের দিকে চেয়ে আমার নাগরিক জবানিতে তাঁকে আর প্রশ্ন করা হয়নি। জানা হয়নি তাঁর ঠিকানা-সাকিন কিংবা ফেলে আসা জীবনের অজানা গল্পগুলোর কথা। থাক্, কী দরকার ! যে গুপ্ত ট্র্যাজেডির ভার বইতে পারবো না, তাকে উন্মুক্ত করে দায়সারা কূটিলতায় নাগরিক সহানুভূতির ভণ্ডামো দেখানোর অপমানটুকু নাই বা করলাম।
প্রতিজ্ঞায় পূর্ণতা ছিলো না হয়তো। এখনো রিক্সা চেপে প্রায়ই অফিসে যেতে হয়। যথারীতি হাঁকও ছাড়ি ‘এই খালি’! তবু দৃষ্টিটা এখন আর চালকের মুখে নয়, কেন যেন ছুটে যায় ঘূর্ণমান প্যাডেলের দিকেই। যেখানে চাপলেই মন্থর জীবন ছুটতে থাকে...!
[e-book 'protidiner golpo']
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment