Thursday, March 26, 2009
# চিত্রকল্পে কিশোর-কবিতার স্বরূপ অন্বেষণ...
চিত্রকল্পে কিশোর-কবিতার স্বরূপ অন্বেষণ...
রণদীপম বসু
‘সেই লেখা লেখা নয় নাহি যার রস।’ কবি ঈশ্বর গুপ্তের এই রায়কে মান্য করলে আমাদের স্বীকার করে নিতে হয় যে, রস সৃষ্টিই সাহিত্যের অভীষ্ট লক্ষ্য। তাহলে প্রশ্ন আসে রস কী ? টস টস করে ঝরে পড়ার মতো কোন নিঃসৃত তরল পদার্থ যে নয় তা তো আমরা বুঝতেই পারছি। এ হচ্ছে সাহিত্যের রস। আর কাব্য বিচারে এলে কাব্যরস। তবে রস প্রসঙ্গে জানতে হলে আমাদেরকে তো রসশাস্ত্রে ঢু মারতেই হয় !
প্রাচ্য-অলঙ্কার শাস্ত্রে রস একটি পারিভাষিক শব্দ। যার ধাতুগত মূল অর্থ হচ্ছে আস্বাদন করা। কাব্যতত্ত্বের প্রধান পুরুষ আচার্য ভরত তাঁর নাট্যশাস্ত্রে নাকি ঘোষণা করেছেন এই বলে যে, “-নহি রসাদ ঋতে কশ্চিদর্থঃ প্রবর্ততে।” (নাট্যশাস্ত্র, -৬/৩৪) অর্থাৎ রস ব্যতিরেকে কোন বিষয়েরই প্রবর্তনা (সূচনা) হয় না। রসের এই সর্বব্যাপী-সর্বগ্রাহী স্বরূপ উপলব্ধি করেই রসের সংজ্ঞার্থ নির্ণয়ে আত্ম-জিজ্ঞাসায় প্রশ্ন রাখেন- “অত্রাহ, রস ইতি কঃ পদার্থ ?” অর্থাৎ রস কোন পদার্থকে বলে ? উত্তর-অন্বেষার সারাৎসার- “আস্বাদ্যত্বাৎ” (নাট্যশাস্ত্র, -৬/৩৫), যা আস্বাদিত হয়। রসবাদী হিসেবে আরেক খ্যাতিমান চতুর্দশ শতাব্দের বিশ্বনাথ কবিরাজ তাঁর ‘সাহিত্য দর্পণ’ গ্রন্থে ভরত-এর কথারই প্রতিধ্বনিত করলেন- রস্যতে ইতি রসঃ। (সাহিত্য দর্পণ, -১/৩) অর্থাৎ যা রসিত বা আস্বাদিত হয়, তা-ই রস। এবং রসের ব্যাপ্তি প্রকাশ করলেন এভাবে- “সর্বোহপি রসনাদ্ রসঃ” (সাহিত্য দর্পণ, -৩/৪২) অর্থাৎ রসন বা আস্বাদন হেতু সবই রস। হাঃ হাঃ, তাহলে তো আস্বাদন হেতু তালের রস আর কাব্যরসে কোন তফাৎ দেখি না ! তফাৎ হয়তো এটাই যে তালের রসের আস্বাদন করতে হলে গাছ বেয়ে আগায় চড়তে হবে। আর কাব্যরসের আস্বাদ পেতে হলে ডুব দেবার নিমিত্তে কাব্যহ্রদে ঝাঁপ দিতে হবে। বিষয়টা যেহেতু কাব্যকেন্দ্রিক, তাই যাঁরা কাব্যসাহিত্য নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, লেখালেখি করেন কিংবা এ থেকে রস আস্বাদনে আগ্রহী বা রসসৃষ্টির সম্ভাব্য নেশায় বুঁদ হতে আকাঙ্ক্ষি, তাঁদের জন্য ওইদিকে ঝাঁপ দেয়া ছাড়া আপাত কোন গতিক দেখছি না। এক্ষেত্রে সাহিত্যের মহাফেজখানায় খুঁজে খুঁজে হয়রান না হয়ে আপাতত যে দুটো অবশ্যপাঠ্য বইকে সঙ্গি করে নিলে পথ খুঁজতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না, তা হচ্ছে নরেন বিশ্বাসের ‘কাব্যতত্ত্ব-অন্বেষা’ এবং ‘অলঙ্কার অন্বেষা’। এ নিবন্ধে এই বিষয়ক অর্থাৎ প্রাচ্য-অলঙ্কার শাস্ত্র তথা কাব্যতত্ত্ব সংশ্লিষ্ট যাবতীয় তথ্য ও বাচন-বর্ণনার জন্য আমি শ্রদ্ধেয় নরেন বিশ্বাসের কাছে অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতায় এ দুটো গ্রন্থ-সহায়তার ঋণ স্বীকার করে নিচ্ছি।
চিত্রকল্পের ধান ভানতে গিয়ে রসিক পাঠকের কাছে যদি মনে হয় যে রসময় শিবের গীত শুরু হয়ে গেছে, তাহলে যথাসম্মান রেখেই বলে নেয়া ভালো যে গুরুচণ্ডালিকা টানার বদস্বভাবের একটা সুবিধাও রয়েছে। শিবের গীতের মধ্যেই ধানভানার কিছু অর্থহীন অর্থময় কথা সুরের ঠেলায় ভাসিয়ে দেয়া যায়, যা পরবর্তীতে প্রকৃত ধানভানার সময় এসে অযথা বিঘ্ন সৃষ্টি করবে না। অতএব, কথা যখন রসেরই, তা আস্বাদন করতে দোষ কোথায় !
মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্ ।।
- রামায়ণ, বালকাণ্ড ২/১৫
‘ওরে ব্যাধ তুই (যেহেতু) কামমোহিত ক্রৌঞ্চযুগলের পুরুষটিকে হত্যা করেছিস, (সেজন্য) কোনদিনই তুই (জীবনে) সুখী হবি না (প্রতিষ্ঠা পাবি না)।’
তমসার তীরে ভ্রমণরত অবস্থায় আদি কবি বাল্মীকি ক্রৌঞ্চমিথুনের শোকে নিজের অজান্তেই যে করুণ রসের শ্লোক উচ্চারণ করে বসলেন, তখনও কি বুঝেছিলেন তিনি কী রচনা করলেন ! এর পরই তাঁর হৃদয়ে যে বিস্ময়বোধ সঞ্চারিত হলো, প্রশ্ন জাগলো- ‘কিমিদং ব্যাহৃতৎ ময়া’। (এ কী ! এর স্বরূপ কী ?)। ‘কথমেবং রচিতানীত্যেবং বিস্ময়াবহানি’- (এ বিস্ময়াবহ এমন সৃষ্টি, তা কেমন করে নির্মাণ করলাম)!
মিথলজিক্যালি বা পৌরাণিক সত্য অনুযায়ী আদি কাব্যের এই প্রথম উন্মেষের পর এমন হাজারো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পরবর্তীতে বিভিন্ন জনের হাত ধরে একে একে জন্ম হতে থাকে নানান কাব্যতত্ত্বের। খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দের থেকে খ্রীস্টীয় চতুর্থ শতাব্দের মধ্যবর্তী যে কোন সময় অর্থাৎ আনুমানিক দু’হাজার বছর আগে ভারতীয় আলঙ্কারিকদের মধ্যে প্রাচ্য-কাব্য সাহিত্যে রসতত্ত্বের প্রবর্তক হিসেবে আচার্য ভরতকেই প্রথম ও প্রধান পুরুষ হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয়। একইভাবে রসতত্ত্বই তাবৎ কাব্যতত্ত্বের শ্রেষ্ঠতত্ত্বরূপে স্বীকৃত হয়। তাঁর মতে ‘রস’ই হচ্ছে সাহিত্যবৃক্ষের বীজ:
যথা বীজাদ ভবেদবৃক্ষো বৃক্ষাৎপুষ্পং ফলং তথা।
তথা মূলং রসাঃ সর্বেতেভ্যো ভাবা ব্যবস্থিতাঃ।।
-নাট্যশাস্ত্র, ৬ষ্ঠ অধ্যায়।
অর্থাৎ বীজ হতে যেমন গাছ হয় এবং গাছ হতে ফুল ও ফল, তেমনি রসবীজ হতেই কাব্য এবং এ কাব্যের ফুল ফল (ভাব, রীতি, অলঙ্কার ইত্যাদি) এই রসেরই প্রকাশ।
সকল তত্ত্বের সারতত্ত্ব এই ‘রসকে চিহ্ণিত করলেও আচার্য ভরত অলঙ্কাররীতি, গুণ কিংবা কাব্যের সৌন্দর্য-বিষয়ক বিষয়গুলোকে কোনভাবেই উপেক্ষা করেন নি। বরং রস’কে রসময় করে তুলতে এসব বিষয়ের আবশ্যিকতাকেই তিনি গুরুত্বারোপ করেছেন।
প্রাচ্য অলঙ্কারশাস্ত্রে নাট্য বা কাব্যসাহিত্যে যে নয়টি রসে’র অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে তা হলো, শৃঙ্গার বা আদিরস, বীররস, রৌদ্ররস, হাস্যরস, করুণরস, ভয়ানক, বীভৎস, অদ্ভুত এবং শান্তরস। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ আবার সংগৃহীত প্রাচীন লোকছড়াগুলোকে ‘ছেলেভুলানো ছড়া’ নাম দিয়ে এর রসমাধুর্যকে ‘বাল্যরস’ নামে আখ্যায়িত করেন। রসবোধ থাকলে সাহিত্যের এই রসময় জগতে রসের সন্ধান পাওয়া যায় বৈ কি। তবে সেখানে রস থাকতে হয়। পণ্ডিতজনেরা বলেন, ভাব থেকে এই রসের উৎপত্তি। অর্থাৎ রস এমনি এমনি আসে না, ভাবের উপস্থিতি আবশ্যক। সৃষ্টির আদিকাল হতে মানুষের মনে অজস্র ভাব বা ইমোশন বর্তমান। আর ভাব (চিত্তবৃত্তি) বা ইমোশনই হচ্ছে রসের মৌলিক উপাদান। আলঙ্কারিকদের ভাষায়, কাব্যানুভবের ফলে মনের এই ‘ভাব’ই অনুকূল আবহে রসে রূপান্তরিত হয়। পণ্ডিতের বিচারে ‘ভাব’ লৌকিক কিন্তু ভাব থেকে রূপান্তরিত ‘রস’ অলৌকিক। এই ‘ভাব’টা হলো স্থায়ী অবস্থা, আর ‘রস’টা আপেক্ষিক। নির্দিষ্ট ভাব থেকে কার মধ্যে কীভাবে কতটুকু রসের আবির্ভাব বা সঞ্চারণ ঘটবে তা রসগ্রহীতার যোগ্যতা এবং রসস্রষ্টার মুন্সিয়ানার উপরেও নির্ভর করে।
কোন্ স্থায়ী ভাব থেকে কীরকম রসের সঞ্চার ঘটবে তা-ও পণ্ডিতজনেরা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। রতি স্থায়ীভাব থেকে শৃঙ্গার বা আদিরস, উৎসাহ থেকে বীররস, ক্রোধ থেকে রৌদ্ররস, হাস থেকে হাস্যরস, শোকভাব থেকে করুণরস, ভয় থেকে ভয়ানক, জুগুপ্সা থেকে বীভৎস, বিস্ময় থেকে অদ্ভুত এবং শম স্থায়ী ভাব থেকে শান্তরস। রসশাস্ত্র অনুযায়ী এই নয়টি স্থায়ী ভাব নাট্য বা কাব্যে বিভাব, অনুভাব ও ব্যভিচারী ভাবের সংযোগে নয়টি রসে সার্থক পরিণতি লাভ করে। ভাবের সাথে এই যে বিভাব, অনুভাব ও ব্যভিচারী ভাবের সংযোগ তা কি আর এমনি এমনি ঘটে ! রসগ্রহীতার সাথে এই সংযোগ ঘটিয়ে দেয়ার জন্য রসস্রষ্টাকে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু কারুকাজের আশ্রয় নিতে হয়। সাহিত্য যেহেতু একটি শব্দ বা অর শিল্প, তাই শব্দের মায়াজালে বহুমাত্রিক বিন্যাসের মাধ্যমে তাঁকে এমন এক অভাবনীয় চিত্ররূপ তৈরি করতে হয় যাতে সেই উদ্দিষ্ট ভাবের নাড়িতে সার্থক অনুরণন তোলে। বহুমাত্রিক শব্দবিন্যাসে রচিত এই কাল্পনিক চিত্ররূপকেই সাহিত্যের ভাষায় বলা হয়ে থাকে চিত্রকল্প বা রূপকল্প। এতে যে কাঙ্ক্ষিত রসের উদয় হয় তাতে স্পন্দিত হয়ে রসগ্রাহী পাঠক মাত্রেই হয়ে ওঠে আপ্লুত। আর এভাবেই সাহিত্য তার সার্থকতা নিয়ে এগিয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে।
প্রাচীন অলঙ্কার শাস্ত্রে কোথাও কি এই চিত্রকল্পের উল্লেখ আছে ? থাকলেও কোন্ রূপে কীভাবে কোন্ প্রেক্ষিতে রয়েছে তার তূল্যমূল্য বিচার পণ্ডিত গবেষকদের জন্যই তোলা থাক। তবু যে নামেই থাক, বিষয়টা যে কাব্যসাহিত্যের স্পন্দনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, তাতে বোধ করি কারোরই দ্বিমত নেই। তবে আধুনিক কাব্যকলায় এই চিত্রকল্পই যে কালে কালে বহুল আরাধ্য ও ধারাবাহিক চর্চার জরুরি বিষয় হয়ে ওঠেছে, এতে কোন সন্দেহ নেই।
কাব্যের স্বরূপ
‘উপমাই কবিতা।’ বাংলা কাব্যকলায় ইউরোপীয় সাহিত্যরীতির অভিযোজনের মাধ্যমে তিরিশের দশকের আধুনিকতাবাদী পঞ্চপাণ্ডবের অন্যতম প্রধান পাণ্ডব হিসেবে স্বীকৃত কবি জীবনানন্দ দাশের কথিত এই উক্তিটিতে কাব্যের স্বরূপ অন্বেষণে হাজার বছরের প্রাচীন ভারতীয় বা প্রাচ্য কাব্যতত্ত্বের সাথে কোথাও কোনো বিরোধ আছে কি ? কবিতায় বা আরো সীমিত অর্থে কিশোর কবিতায় চিত্রকল্পের সন্ধান করতে হলে আমাদের কাব্যের স্বরূপটাকে সন্ধান করা আবশ্যক বৈ কি।
কাব্যের আত্মা বা স্বরূপ অন্বেষণ করতে গিয়ে প্রাচ্য কাব্যতত্ত্বে বেশ কিছু মতবাদের উন্মেষ ঘটে। রসবাদ ছাড়াও এর মধ্যে অলঙ্কারবাদ, রীতিবাদ, বক্রোক্তিবাদ, ধ্বনিবাদ প্রসিদ্ধ।
অলঙ্কারবাদ: ষষ্ঠ শতকের আচার্য দণ্ডী তাঁর কাব্যাদর্শে ঘোষণা করেন- ‘কাব্যাশোভাকরণা ধর্ম্মান্ অলঙ্কারাণ্ প্রচক্ষতে’, অর্থাৎ অলঙ্কার কাব্যের সৌন্দর্যবিধায়ক ধর্ম।
সপ্তম শতকের বিখ্যাত অলঙ্কারশাস্ত্রী আচার্য ভামহকেই অলঙ্কার-প্রস্থানের প্রবক্তা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি তাঁর কাব্যালঙ্কার গ্রন্থে ‘শব্দার্থৌ সহিতৌ কাব্যম্’ অর্থাৎ শব্দ ও অর্থের সার্থক মিলনকেই কাব্য বলেছেন। কাব্যালঙ্কারের গুরুত্বকে তিনি তুলে ধরেন এভাবে-
রূপকাদিলঙ্কারস্তস্যানৈর্বহুধোদিতাঃ।
না কান্তমপি নির্ভূষং বিভাতি বণিতামুখম্।।
রূপকাদি অলঙ্কার অন্যের দ্বারা বিচিত্র (হু) ভাবে বর্ণিত, প্রেয়সীর মুখ স্বভাবসুন্দর (কান্ত) হলেও অলঙ্কার ব্যতীত তার সৌন্দর্য প্রকাশ পায় না। ভামহের বিবেচনায় অলঙ্কারই কাব্য এবং কাব্যের কাব্যত্ব অলঙ্কার সংযোগেই সৃষ্ট হয়। তিনি আচার্য ভরত ব্যাখ্যাত রসকেও অলঙ্কার বলে গণ্য করেন।
সাহিত্যের অন্যতম মাধ্যম বয়ানসর্বস্ব পদ্য’র ক্ষেত্রে এই অলঙ্কারবাদ বহুল প্রযোজ্য হলেও কবিতার অন্তর্গত স্বরূপ বিশ্লেষণে অক্ষমতার জন্য শেষপর্যন্ত এই তত্ত্ব পণ্ডিত মহলে আদৌ স্বীকৃত হয়নি।
রীতিবাদ: অষ্টম শতকের শেষভাগ হতে নবম শতকের প্রথমভাগে অবস্থানকারী আচার্য বামনই প্রাচ্যকাব্যতত্ত্বের ইতিহাসে রীতিবাদের প্রধান প্রবক্তা হিসেবে স্বীকৃত। অলঙ্কারবাদীদের বিরোধিতা করে তিনি বলেন-
কাব্যং গ্রাহ্যম্ অলঙ্কারাৎ
সৌন্দর্য্যম্ অলঙ্কারঃ।
কাব্য অলঙ্কার দ্বারাই গ্রাহ্য হয় বটে, তবে সৌন্দর্যেই অলঙ্কার।
বামনের বক্তব্য অনুযায়ী এ সৌন্দর্য কাব্যদেহের রূপলাবণ্য। বাইরের অলঙ্কার বা অনুপ্রাস-উপমাদি এই সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তোলে মাত্র। তাই তিনি কাব্য বিচারে ‘গুণ’ বা মাধুর্যকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বলেন, এই গুণ, যা রমণীদেহের লাবণ্যের সঙ্গে তূল্য, কাব্যের নিত্যধর্ম এবং অলঙ্কার কাব্যের অস্থির বা অনিত্যধর্ম। ‘রীতিরাত্মা কাব্যস্য’, অর্থাৎ গুণাত্মক পদরচনার বিশিষ্ট ‘রীতি’ই কাব্যের আত্মা। অতএব কাব্যকলায় স্টাইল বা রীতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এই স্টাইল হলো মুখশ্রী।
কবিতার স্বরূপ অন্বেষণে এই তত্ত্ব খুব একটা কার্যকর না হলেও কাব্য রচনায় নতুনত্ব বা উপস্থাপনভঙ্গির বৈচিত্র্যকে কেউ অস্বীকার করেন না।
বক্রোক্তিবাদ: দশম থেকে একাদশ শতকের মধ্যভাগীয় প্রসিদ্ধ পণ্ডিত কুন্তক’কেই কাব্যকলায় গুরুত্বপূর্ণ বক্রোক্তিবাদের প্রবর্তক হিসেবে গণ্য করা হয়। ‘বক্রোক্তিজীবিত’ গ্রন্থে তিনি ‘বক্রোক্তি কাব্য জীবিতম্’ বা বক্রোক্তিই কাব্যের জীবন বা আত্মা বলে অভিহিত করেন। আচার্য ভরত ব্যাখ্যাত রস সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, ‘রস কাব্য-প্রাণ বক্রোক্তিকেই পরিপুষ্ট-উপভোগ্য করে তোলে মাত্র।’ তাই অলঙ্কার, রীতি, ধ্বনি বা রস কোনটিতেই কাব্যের আত্মা নয়, কাব্যে জীবন বা আত্মা হচ্ছে একমাত্র ‘বক্রোক্তি’। এই বক্রোক্তির সঙ্গে সমন্বিত না হলে অলঙ্কার, রীতি, রস সব কিছুই আকাঙ্ক্ষিত ফল সরবরাহে ব্যর্থ হয়।
‘বক্রোত্তিরেব বৈদগ্ধ্যভঙ্গীভণিতিরুচ্যতে।’
অর্থাৎ বৈদগ্ধপূর্ণ ভঙ্গিমাময় উক্তিই বক্রোক্তি।
আচার্য মহিম ভট্ট কুন্তকের এই বক্রোক্তির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বলেন-
প্রসিদ্ধং মার্গমুৎসৃজ্য যত্র বৈচিত্র্যসিদ্ধয়ে।
অন্যথৈবোচ্যতে সোহর্থঃ সা বক্রোক্তিরুদাহৃতা।
যেখানে বৈচিত্র উৎপাদনের (সিদ্ধির) জন্য, স্বাভাবিক (প্রসিদ্ধ) পথ (অর্থ) পরিত্যাগ করে ভিন্ন অর্থ গ্রহণ করা হয় (অন্য প্রকার উক্ত হয়), সেই অর্থই বক্রোক্তি বলে কথিত।
প্রাচ্য কাব্যতত্ত্বে কুন্তকের এই বক্রোক্তিবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন, যা আমাদের সমকালীন সাহিত্যেও সমভাবে প্রযোজ্য। কেননা ভরত থেকে শুরু করে অভিনবগুপ্ত এবং পরবর্তীকালে সংস্কৃত-অলঙ্কার শাস্ত্রীদের মতো সমকালীন সাহিত্য সমালোচকরা যেখানে শব্দ, অর্থ, অলঙ্কার বা বিশেষ কোন বাক্য শ্লোক কিংবা শ্লোকার্ধের ওপর নির্ভর করে কাব্যত্ব নির্ণয়ে প্রয়াসী, কাব্যের খণ্ডাংশকে সম্বল করে আত্মার অন্বেষায় ব্রতী, কুন্তক সেখানে সমগ্র কাব্যের বক্তব্য বা সার্বিক উক্তির ওপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি এ সত্য প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন যে, বৈচিত্র্য বা বক্রতা কেবল কাব্যের বিশেষ কোন অংশকে নির্ভর করে নির্মিত হয় না, সমগ্র রচনায় তা প্রকীর্ণ থাকে। তিনি কাব্য নির্মাণে সবসময়ই অভিনবত্বের পক্ষপাতী ছিলেন বলেই প্রচলিত সূত্রে নিজেকে কোথাও সমর্পণ করেন নি। তাঁর উপলব্ধি, ‘কাব্যের প্রকৃত সিদ্ধি কথায়, রচনায় বা উক্তিতে।’ উক্তি বা প্রকাশের ওপরই কাব্যের সার্থকতা বহুলাংশে নির্ভরশীল। সে উক্তি যদি অসাধারণ বক্রোক্তি না হয় তবে কাব্য কোন মতেই শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার হয় না এবং তাঁর ভাষ্য অনুসারে যুগে যুগে কবিগণ তাঁদের কবি-শক্তির বলে কাব্যের উক্তিতে (শব্দ, বাক্য অলঙ্কার সর্বত্র) বিপর্যয় সৃষ্টি করেন বৈচিত্র্য-সৃষ্টির নিমিত্ত, নবতর প্রকাশকে স্বাগত জানানোর জন্যে।
‘যৎ কিঞ্চনাপি বৈচিত্র্য তৎসর্বং প্রতিভোদ্ভবম।’ কুন্তকের কাব্যবিচারের লক্ষ্য স্বাধীন-সার্বভৌম কবি-শক্তি নির্মিত বক্রোক্তি, রস উপলক্ষ মাত্র। কারণ তাঁর মতে কাব্য নির্মাণ রস দিয়ে হয় না, হয় কথা বা উক্তি দিয়ে অর্থাৎ বক্রোক্তির সাহায্যে। কাব্যের উদ্দেশ্য যেখানে রস সৃষ্টি, সেখানেও কবিকে প্রথমেই শরণাপন্ন হতে হয় উক্তি বা বক্রোক্তির। ফলে তাঁর বিচারে রস গভীর অর্থে বক্রোক্তিরই অন্তর্ভূক্ত। কাব্যের সার্থকতা সর্বত্রই কথা বা উক্তি নির্ভর এবং যে উক্তি কখনই কেবল উক্তি নয়- অবশ্যই বক্র উক্তি এবং এ বক্রোক্তি নির্মাণই কবিত্ব।
ছড়াসাহিত্য বিশ্লেষণে এই তত্ত্ব খুবই কার্যকর এবং গুরুত্বপূর্ণ। কবিতার ক্ষেত্রেও তা কোন অংশে ফেলনা নয়।
ধ্বনিবাদ: প্রাচ্য কাব্যতত্ত্ব বিচারে অলঙ্কারশাস্ত্রের ইতিহাসে কাব্য-সংজ্ঞার্থ নির্ণয়ে কিংবা কাব্যের আত্মা নিরূপণে ধ্বনিবাদই এ যাবৎ সবচাইতে প্রতিষ্ঠিত মতবাদ, যা বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য। ‘কাব্যসাত্মা ধ্বনিনিরিতি।’ ধ্বনিই কাব্যের আত্মা, এটাই ধন্যালোকের মর্মবাণী।
আনুমানিক নবম শতকের আচার্য আনন্দবর্ধনকে ধ্বনিবাদের প্রবক্তা হিসেবে ধরা হয়। যদিও ধ্বনিকারিতা গ্রন্থটির মূল রচয়িতার নাম অজ্ঞাত, আনন্দবর্ধন ‘আলোক’ নামে বৃত্তি অংশের লেখক, আর অভিনবগুপ্ত প্রায় একশত বছর পর এই আলোক বা বৃত্তির টীকা লিখেছেন ‘লোচন’ নামে। অর্থাৎ ধন্যালোকের কারিকা (যাঁর নাম জানা যায় নি), তার বৃত্তি বা আলোক (আনন্দবর্ধন) এবং বৃত্তির টীকা লোচন (অভিনবগুপ্ত)- এ তিনের সমন্বিত ফল ধ্বনিবাদ।
‘ধ্বনি’ কাব্যতত্ত্বের একটি পারিভাষিক শব্দ। এ ধ্বনি বলতে বোঝায় কাব্যের একটি বিশেষ অর্থ, যা বাক্যে বা কবিতায় ব্যবহৃত শব্দাবলীর সাক্ষাৎ অর্থ নয়, অথচ সেই শব্দার্থ বা বাচ্যার্থকে অবলম্বন করে ইঙ্গিতে ব্যঞ্জনায় প্রতীয়মান হয়ে ওঠা অন্য একটি অর্থ। যখন কোন সহৃদয় পাঠক কাব্য পড়েন, তখন তিনি কেবল কবিতায় ব্যবহৃত শব্দাবলীর অর্থে তৃপ্ত নন, সেই বাচ্যার্থকে অতিক্রম করে তাঁর চেতনায় প্রতীয়মান হয়ে ওঠে ভিন্ন আরেকটি গভীরতর ব্যঞ্জনাময় অর্থ, কাব্যতত্ত্বের পরিভাষায়- বাচ্যার্থ অতিক্রমী সেই প্রতীয়মান অর্থই ‘ধ্বনি’।
ধ্বনিবাদীদের বক্তব্য হচ্ছে- কাব্যের আত্মা শব্দ নয়, অর্থ নয়, অলঙ্কাররীতিও নয়, এসবের অতিরিক্ত অন্য কিছু। এই ‘অন্যকিছু’ কী ?
প্রতীয়মানং পুনরণ্যদেব বস্তুতি বাণীষু মহাকবিনাম।
য-ওৎ প্রসিদ্ধাবয়ব্যতিরিক্তিং বিভাতি লাবণ্যামিবাঙ্গনাসু।।
-ধ্বন্যালোকে, ১/৪
-মহাকবিদের বাণীতে দেহাতিরিক্ত (শব্দ, অর্থ রীতি) অন্য একটি প্রতীয়মান (অর্থরূপে) বস্তু থাকে। যা রমণীদেহের লাবণ্যের মতোই কাব্যের শরীরে দীপ্তিমান।
এই যে অতিরিক্ত বস্তু, এটাই কাব্যের লাবণ্য বা কান্তি, ধ্বনিবাদীদের ভাষায় এটাই হচ্ছে ধ্বনি। এটা অলঙ্কার রীতি নয়, এখানে শব্দ ও অর্থ গৌণ হয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে প্রতীয়মান অর্থ। বাচ্যার্থকে অতিক্রম করে যায় প্রতীয়মান অর্থ, যদিও বাচ্যার্থের দ্বারাই তার প্রকাশ ঘটে।
যথার্থঃ শব্দো বা তমর্থ মুপসর্জণীকৃত স্বার্থে।
ব্যঙ্গ্যঃ কাব্যবিশেষঃ স ধ্বনিরিতি সুরভিঃ কথিত।।
যেখানে কাব্যের অর্থ ও শব্দ নিজের প্রাধান্য পরিত্যাগ করে প্রতীয়মান অর্থ বা ব্যঙ্গার্থকে প্রকাশ করে, সেখানে সেই ব্যঙ্গার্থ রূপ কাব্যবিশেষই ধ্বনি হিসেবে আখ্যায়িত হয়।
ধ্বনিবাদীদের মতে অলঙ্কার কাব্যের আত্মা বলে বিবেচিত হতে পারে না। কারণ অঙ্গনাদেহে লাবণ্য না থাকলে, শত অলঙ্কারে বিভূষিতা করলে তাকে যেমন সুন্দরী বলা যায় না এবং লাবণ্যময়ী নারীকে কোন অলঙ্কার না পরালেও তার স্বভাব-সৌন্দর্য যেমন ঢাকা পড়ে না, ঠিক তেমনি যমকালো অলঙ্কারে সজ্জিত বাক্যও কাব্য হয় না (ধ্বনির অভাবে) আবার অলঙ্কারহীন বাক্যও সার্থক কাব্য হয় যদি তাতে ‘ধ্বনি’ থাকে দীপ্র।
তবে ধ্বনিবাদীরা রস’কে অস্বীকার করেন নি। ‘নহি তচ্ছূণ্যং কাব্যং কিং চি-দস্তি।’ (-ধন্যালোক, ২/৩ টীকা) অর্থাৎ রসহীন কোন কাব্য নেই। অবশ্য সে রসের প্রকাশ ঘটেছে ধ্বনিরূপে। এবং অভিনবগুপ্তের মতে রসধ্বনিই কাব্যের আত্মা।
প্রাচ্য কাব্যতত্ত্বের উপরোক্ত তত্ত্বগুলোকে মাথায় রেখে আমরা জীবনানন্দের সেই উক্তিটিতে ফিরে যাই আবার, ‘উপমাই কবিতা।’ অলঙ্কার শাস্ত্রে ‘উপমা’ শব্দটি সাধারণত তুলনা অর্থেই বহুল ব্যবহৃত। ইংরেজিতে simile বলতে বিসদৃশ বস্তুর মধ্যে সাদৃশ্য আবিষ্কার বুঝায়। সংস্কৃতে ‘যদতত্তৎসদৃশম ইতি’- (গার্গ্য)। এই সংজ্ঞার অর্থ দাঁড়ায়- ‘যৎ অতৎ তৎ-সদৃশম’ অর্থাৎ যৎ (যে বস্তু) অতৎ (সে বস্তু নয়) তৎ-(যে বস্তুর) সদৃশম (মতন বা ন্যায়)। এক কথায় যে-বস্তু সে-বস্তু নয় (তবু) সেই বস্তুর মতোন।
আধুনিক কালের আলঙ্কারিকদের কাছেও উপমা হচ্ছে- দুই বিজাতীয় বস্তুর মধ্যে সাদৃশ্য আবিষ্কারের ফলে যে চমৎকৃতি, -তা-ই। আর এ কারণেই তুলনার উপর ভিত্তি করে কাব্য-সাহিত্যে যে প্রচুর অলঙ্কার সৃষ্টি , সে অলঙ্কারকেই সাধারণত উপমা বলা হয়। কাব্য সাহিত্যে উপমার ভূমিকা বৈচিত্র্যময় এবং রসসৃষ্টি ক্ষমতাও সন্দেহাতীত ! অলঙ্করশাস্ত্রে উপমার বহু প্রকার ভেদ রয়েছে। তবে ভিন্ন আঙিকে সাহিত্যের অলঙ্কার শাস্ত্রটাকে মূলত উপমানির্ভর দলিল বললে কি খুব অত্যুক্তি হবে ?
বাঁশের মতো লম্বা বা দড়ির মতো সাপ বললে সহজ কিছু উপমা তৈরি হয়ে যায়। এতে আমাদের মনশ্চোখে সাদৃশ্য বিবেচনায় সাধাসিদে একটা পূর্বঅভিজ্ঞতালব্ধ চিত্রও তৈরি হয়ে যায় বৈকি। মেঘকালো কেশ বললে মেঘের কালোত্বের সাথে সাদৃশ্য ভেসে ওঠে। কিন্তু ‘নতুন চরের মতো মুখ’ বা ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ’ পঙক্তিগুলোকে বিশ্লেষণ করলে কি কেবল উপমাই মনে হয় ? মুখ কোনো চর নয়, তবু নতুন চরের সাথে তুলনা টানলেই মনের মধ্যে আমাদেরকে কেবল একটা চিত্র নয় বরং এমন একটা কল্পচিত্র রচনা করার প্রয়াস নিতে হয় যে আমরা কেবল আঁকতেই থাকি, বারবার, তবু তৃপ্তি মেটে না। অর্থাৎ আক্ষরিক বা বাচ্যার্থের বাইরে আরেকটা প্রতীয়মান অর্থ আমাদের উপলব্ধিতে যে অভূতপূর্ব রস নিয়ে উপস্থিত হয়, এর কোনো ব্যাখ্যাই তাকে প্রকৃত ফুটিয়ে তুলতে অক্ষম, কেবল এক চমৎকার উপলব্ধি ছাড়া ! সোজা কথায় ব্যাখ্যাতীত এক চিত্রকল্প তৈরি হয়ে যায়। পাখির নীড়ের মতো চোখের ক্ষেত্রেও এই অভূতপূর্ব অনুভূতিতে আপ্লুত হয়ে অন্য এক তৃপ্তিকর ব্যাখ্যাহীনতার মধ্যে সাঁতরাতে থাকি আমরা। এই যে দুই বিজাতীয় কল্পনার মধ্যে সাদৃশ্য টেনে একটাকে আরেকটার প্রতিতুলনায় নিয়ে এসে বিভ্রম তৈরি করার উপমা ফাঁদা, এটাই চিত্রকল্প। এবং এই চিত্রকল্পতাই কবিতা। এটাকেই জীবনানন্দ বলেছেন উপমা এবং উপমা বলতে তিনি চিত্রকল্পকেই বুঝিয়েছেন।
এই চিত্রকল্পে অলঙ্কার তত্ত্বের শব্দ ও অর্থের সার্থক মিলন যেমন ঘটবে, রীতিবাদের স্টাইলেও থাকবে চমক। বক্রোক্তিবাদের সার্থক প্রয়োগে বৈচিত্র্য বা অভিনবত্ব যেমন আসবে, ধ্বনিবাদের মূলসুর আক্ষরিক অর্থের গভীরে এক অভাবনীয় অর্থময় উপলব্ধিরও জন্মান্তর ঘটবে। তাই আধুনিক কাব্য বিশ্লেষণে কবিতার প্রাণস্বরূপ চিত্রকল্প নামের যে অনিবার্য শর্তটিকে সযত্নে লালন করা হচ্ছে তা যে প্রাচ্যকাব্যতত্ত্বের সমন্বিত রূপটিকেই ধারণ করে নিয়েছে, তা বললে বোধ করি বাড়িয়ে বলা হবে না। এই চিত্রকল্পতাই কবিতার প্রাণ। সে কারণেই পঠিত রচনায় কাঙ্ক্ষিত কবিতাটি খুঁজতে হলে যথার্থ চিত্রকল্পের সাম্পানে চড়ে ভাবের অনির্বচনীয় দোলায় দোলে দোলে অক্ষরের নদীটাকে পারি দিয়ে ভিড়তে হয় ওপারের সেই আশ্চর্যময় জগতে। যেখানে নতুন নতুন উপলব্ধির নিরন্তর অপেক্ষাগুলো বসে থাকে ইন্দ্রিয়ঘন অতৃপ্ত অনুভবের ডালি নিয়ে।
কিশোর-কবিতা, কবিতায় কৈশোর
কিশোর-কবিতা বললেই আমাদেরকে স্বতসিদ্ধভাবেই বুঝে নিতে হয় যে, এটা সেই কবিতা যেখানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষই হোক কৈশোরিক অনুষঙ্গতা অনিবার্য। এবং সেই চিরায়ত কৈশোর যা আমাদের প্রত্যেকের বুকের গভীরে বহমান এক স্থিরিকৃত নদী। যার ঢেউ, যার স্রোত, যার কুলকুল ধ্বনি মানুষ জীবনভর বয়ে যায় শুনে যায়। চিরায়ত কিশোরের এই ব্যক্ত-অব্যক্ত অনুভব ধারণ করে যে কবিতা তা-ই কিশোর-কবিতা। এখানে কবি-পরিচয় মুখ্য নয়, মুখ্য কৈশোরিক অনুভব। প্রবীণ কবির সেই কবিতাটিও কিশোর-কবিতা, যেখানে তাঁর কৈশোরিক মনটা খেলা করে। আবার সেই কিশোরের লেখা কবিতাটাও কিশোর-কবিতা হবে না যদি সেখানে কিশোর অনুষঙ্গতা না থাকে। এ জন্যই কিশোর হয়েও কৈশোরিক উপলব্ধির অনুপস্থিতির কারণে কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের সব কবিতাই কিশোর-কবিতা হয় নি। অনেকগুলোই হয়ে গেছে সাধারণ বা বয়স্ক-মনন কবিতা। যেহেতু সব মানুষের মধ্যেই একটি চিরায়ত কিশোর বাস করে তাই কিশোর-কবিতাকে সবার জন্য কবিতা বলা যেতে পারে। কিন্তু সবার জন্য কবিতাই কিশোর কবিতা নয়।
‘কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি। সে তো ভেসে ওঠা ম্লান
আমার মায়ের মুখ; নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি
পাতার আগুন ঘিরে রাতজাগা ছোট ভাই-বোন
আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি- রাবেয়া রাবেয়া-
আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট!
কবিতা তো ফিরে যাওয়া পার হয়ে হাঁটুজল নদী
কুয়াশায়-ঢাকা-পথ, ভোরের আজান কিম্বা নাড়ার দহন
পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ
মাছের আঁশটে গন্ধ, উঠোনে ছড়ানো জাল আর
বাঁশঝাড়ে ঘাসে ঢাকা দাদার কবর।
কবিতা তো ছেচল্লিশে বেড়ে ওঠা অসুখী কিশোর
ইস্কুল পালানো সভা, স্বাধীনতা, মিছিল, নিশান
চতুর্দিকে হতবাক দাঙ্গার আগুনে
নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসা অগ্রজের কাতর বর্ণনা।
কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস
ম্লান মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর
গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর
কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।’
---(কবিতা এমন/ আল মাহমুদ)
আল মাহমুদের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালি কাবিন’ থেকে নেয়া এই কবিতাটা কি কিশোর-কবিতা ? কৈশোর স্মৃতিকারতা এখানে প্রবলভাবে উপস্থিত হলেও বয়স্ক মননের বেশ কিছু অনুষঙ্গ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকাটাই বলে দেয় এটা কিশোর-কবিতা নয়। একইভাবে নিচের রচনাটিকেও প্রকৃতপক্ষে কিশোরকবিতা বলার উপায় নেই। শৈশব বা কৈশোরের যাবতীয় অনুষঙ্গ উপস্থিত থাকলেও ওটা মূলত শৈশবস্মৃতিকাতর একটা নস্টালজিক বোধে আক্রান্ত বয়স্ক রচনা। এখানে বয়স্ক মনের হাহাকারই প্রধান।
রূপকথা, ছড়া আর
অদেখা ঠাকুরমার-
ঝুলি ভরা গল্পের, কল্পের বই-সব-
কিছু নেই
তাকাতেই পিছু-ভাবি কই-সব
ফেলে আসা
ভাসা-ভাসা, স্মৃতি জুড়ে শৈশব!
ভরা-গাঙে লাফ-ঝাঁপ
বরষার টুপটাপ
পুকুরের তাজা কই, উনুনের খই-সব-
কিছু নেই
তাকাতেই পিছু-ভাবি কই-সব
ফেলে আসা
ভাসা-ভাসা, স্মৃতি জুড়ে শৈশব!
খেজুরের মধু-রস
পাকা আম টসটস
এলোমেলো হাঁটা-পথ, খাঁটি মাঠা-দই সব-
কিছু নেই
তাকাতেই পিছু-ভাবি কই-সব
ফেলে আসা
ভাসা-ভাসা, স্মৃতি জুড়ে শৈশব!
প্রজাপতি সেই মন
ছুটে চলা প্রতিক্ষণ
বড় হওয়া মাছে-ভাতে, গাছে ওঠা মই-সব-
কিছু নেই
তাকাতেই পিছু-ভাবি কই-সব
ফেলে আসা
ভাসা-ভাসা, স্মৃতি জুড়ে শৈশব!
জোছনায় ভেজা-রাত
কত ফাঁকি, অজুহাত
হাসি-খুশি থইথই, প্রিয় হইচই-সব-
কিছু নেই
তাকাতেই পিছু-ভাবি কই-সব
ফেলে আসা
ভাসা-ভাসা, স্মৃতি জুড়ে শৈশব!
---(শৈশব / সাজ্জাদ হুসাইন)
কিন্তু নিচের রচনাটি সেই চিরায়ত কিশোরের উপলব্ধি এমন চমৎকারভাবে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে যে এটাকে একটা সার্থক কিশোরকবিতা না মেনে উপায় আছে কি ?
ও মেঘ ! আমায় সত্যি করে
তোর ঠিকানা বল-
কোত্থেকে তুই পাসরে এতো
স্নিগ্ধ-শীতল জল ?
মিষ্টি পায়ে তোর কি আছে
নূপুর, হীরের মল-
তোর বাড়িতে বাস করে কি
নৃত্য-মেয়ের দল ?
বিজলি পেলো কোথায় অমন
রঙিন আলোর ঢল-
আমায় দে-না তোর পরিচয়
করিসনে আর ছল।
তোর কথা আজ যতই ভাবি
পাই না খুঁজে তল-
মেঘ ; আমাকে বিষ্টি করে
সঙ্গে নিয়ে চল।
---(ও মেঘ / সাজ্জাদ হুসাইন)
একজন কিশোরের মনোজগতে যে বিষয়টিকে ঘিরে তার সামগ্রিক কর্মকাণ্ড পরিবাহিত হয় তা হলো তার স্বপ্ন। তার চলা ফেরা চিন্তা ভাবনা উচ্ছ্বাস আনন্দ বন্ধুসঙ্গ নিঃসঙ্গতা বিষণ্নতা কষ্টবোধ ইত্যাদি সবকিছুর গভীরে প্রভাব সৃষ্টিকারী অনুষঙ্গ এই স্বপ্নকাতরতাই তাকে চেতনে-অবচেতনে এমন বিচিত্র সত্তায় রাঙিয়ে তোলে। কখনো আয়নার মতো স্বচ্ছ, কখনো বা গাঢ় কুজ্ঝটিকাময় আচ্ছন্নতায় সে বিভোর হয়ে থাকে। এই কিশোর-মনন পাঠ না জানলে কারো দ্বারা কিশোর-সাহিত্য রচনা কখনোই সম্ভব নয়। আর সে সাহিত্যটি যদি হতে হয় কিশোর-কবিতা, তাহলে স্বার্থক চিত্রকল্পের গভীরে এই বিভোরতাটুকুই আঁকতে হয় দারুণ দক্ষতায়। সরাসরি বিবরণধর্মীতার ব্যর্থ জোলোপ্রবণতায় আক্রান্ত না হয়ে যথার্থ চিত্রকল্প সৃষ্টির মাধ্যমে আক্ষরিক অর্থময়তার গভীরে শুশুকের মতো ছলকে উঠবে সেই স্বপ্নকাতরতাটুকুই। এখানেই কিশোর-কবিতার স্বার্থকতা।
আমি যখন পদ্য লিখি, সবার খুবই অসন্তোষ
কেউ বা বলেন পক্ক আমি, কেউ বা ধরেন মাথার দোষ!
আমি তখন স্বপ্নে দেখি শক্তি-সুনীল, শঙ্খ ঘোষ।
আমি যখন ছবি আঁকতে খাতার পাতায় টানছি লাইন,
মা বলে যান, ‘পড়তে বসো। আঁকা বন্ধ- বাবার আইন।’
হা হতোস্মি! আমার কেবল স্বপ্নে বিকাশ, গণেশ পাইন!
আমি যখন গান ধরেছি বুকের গভীর আহাদে,
পড়শিগণে টিটকারি দেয়-‘নচির সঙ্গে পাল্লা দে!’
কিন্তু আমার স্বপ্নে আসেন হেমন্ত আর মান্না দে!
আমি এখন পড়ছি শুধু, পড়ছি দিনরাত্রি তাই।
বাবা ভীষণ খুশি এবং মা বলছেন, ‘বল, কী চাই?’
বলবো, ‘শুধু স্বপ্ন দেখার সময় যেন একটু পাই!’
--(স্বপ্ন / প্রমোদ বসু)
একজন কিশোরের জন্য বর্তমান প্রতিকূল বাস্তবতায় স্বপ্ন দেখার একটু ফুরসৎ পাবার এই যে আর্তি এটাই শেষপর্যন্ত স্পষ্ট হয়েছে। যদিও কবিতাটির মধ্যে স্বপ্নদেখার বিষয়টি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে এবং স্পষ্ট উল্লেখ করে বলে দেয়া হয়েছে, আমাদের শিল্পতৃষ্ণার পরিতৃপ্তির চূড়ান্ত উৎকর্ষতা না পেলেও কাব্যগুণে কিশোর-কবিতা হিসেবে উত্তীর্ণ হয়েছে বলে মনে করতে পারি আমরা।
টিনের চালে বৃষ্টি পড়ে
আকাশ থেকে স্বপ্ন ঝরে।
বৃষ্টি ঝরে ঘুমের মতো
শ্রাবণ রাতে অবিরত।
ঘুমের মধ্যে জেগে থাকি
মাথায় ওড়ে সবুজ পাখি।
টিনের চালে বৃষ্টি পড়ে
স্বপ্নে স্বপ্নে দু-চোখ ভরে।
--(টিনের চালে / হুমায়ুন আজাদ)
এইটাও কিশোর-কবিতা হিসেবে উৎড়ে গেলেও চিত্রকল্পের চূড়ান্ত উৎকর্ষতায় অতৃপ্তি রয়ে গেছে। কেননা এখানেও স্বপ্নবোধটাকে আক্ষরিক উল্লেখহেতু আমাদের চিত্র-কল্পনা খুব বেশি গভীরতা পায় না। এই স্বার্থকতাই আমরা নীচের কবিতাটিতে পেয়ে যাই, চমৎকার কিছু ইচ্ছার গভীরে আসলে সেই কৈশোরিক স্বপ্নটাই ফুটে ওঠে যথার্থ চিত্রকল্পতার মাধ্যমে-
আমি যদি হই ফুল, হই ঝুঁটি-বুলবুল হাঁস
মৌমাছি হই একরাশ,
তবে আমি উড়ে যাই, বাড়ি ছেড়ে দূরে যাই,
ছেড়ে যাই ধারাপাত, দুপুরের ভূগোলের ক্লাস।
তবে আমি টুপটুপ, নীল-হ্রদে দিই ডুব রোজ
পায় না আমার কেউ খোঁজ।
তবে আমি উড়ে-উড়ে ফুলেদের পাড়া ঘুরে
মধু এনে দিই এক ভোজ।
হোক আমার এলো চুল, তবু আমি হই ফুল লাল
ভরে দিই ডালিমের ডাল।
ঘড়িতে দুপুর বাজে; বাবা ডুবে যান কাজে;
তবু আর ফুরোয় না আমার সকাল।
--(রুমির ইচ্ছা / নরেশ গুহ)
একটা স্বপ্নাতুর কিশোর যখন তার নিজস্ব গণ্ডি বাড়ির সীমানায় দাঁড়িয়ে বহু দূর দিগন্তের দিকে তাকায়, তার দৃষ্টিরশ্মির সাথে স্বপ্নরাও যে ভোঁ দৌঁড়াতে থাকে তা হয়তো শিশুটির সজ্ঞান উপলব্ধিতে আসে না। কিন্তু মনের গভীরে যে ইচ্ছার বুননটা চলতে থাকে সেই বোধটাই তো কিশোর-ভাবনা-
বহুদূরে মানে দূ-উ-উ-রে।
বাড়ির সীমানা,
যত কিছু জানা-
চেনা মাঠ-ঘাট,
অদূরের হাট,
বুড়ো বটমূল-
আর ইশ্কুল-
সব কিছু ছেড়ে অনেকটা পথ ঘুরে
একাই যাচ্ছি, বহুদূরে মানে দূ-উ-উ-রে।
নেই সংশয়,
বাবা-মার ভয়,
স্কুলের শাসন,
স্যারের ভাষণ,
নেই কিছু নেই
তবু তো আছেই
কত কী না-জানা অজানারা চোখ জুড়ে।
একাই যাচ্ছি বহুদূরে মানে দূ-উ-উ-রে।
দেখি নি যে ফুল,
যে নদীর কূল,
নিঝুম বাদাড়,
বুনো ঝোপ-ঝাড়,
আকাশের নীল,
তারা ঝিলমিল-
অবাক তাকিয়ে বাতাসের সুরে সুরে
একাই যাচ্ছি, বহুদূরে মানে দূ-উ-উ-রে।
আরো দূরে ধু-ধু
দিগন্ত শুধু।
আছে তারপরও
ছবি থরোথরো।
দৃশ্যের টানে
মন হার মানে-
তাইতো যাত্রা সব কিছু ছেড়ে-ছুড়ে।
একাই যাচ্ছি বহুদূরে মানে দূ-উ-উ-রে
দূ-উ-উ-রে
দূ-উ-উ-রে।
--(দূরে / আবু হাসান শাহরিয়ার)
ধরতে না পারা ইচ্ছেটাকে বুড়োরা পরিত্যাগ করলেও চিরায়ত কিশোরের স্বপ্নজগৎ কখনোই তা ত্যাগ করে না। স্বপ্নের কারখানা যে কিশোর মন, সেখানে আরেক বিকল্প স্বপ্ন তৈরি হতেই থাকে তার আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার তীব্র আগ্রহে-
আকাশ তুমি দূরে থাকো
হাত বাড়িয়ে ধরতে পারি নাকো
দূরেই যদি থাকলে তবে নীলের গায়ে তুমি
শাদা মেঘের স্বপ্ন কেন এমন করে আঁকো।
আকাশ তুমি এত্তো বড় কেন?
হাত বাড়িয়ে ধরতে পারি যেন
এমন ছোট হলে তোমার দোষ হতো কি বেশি?
তুমিই বলো আমার কথা খুব কি যেন তেন?
আকাশ তুমি অনেক ছোট হবে
এখন বলো কখন এবং কবে
আসবে কাছে এত্তোটুকু হয়ে আমার মতো
না হলে আর কেমন করে বন্ধু হবে তবে?
শোনো আকাশ তোমার গায়ে কারা
জ্বলে এবং নেভে? যাদের বলে সবাই তারা।
ওরা কি সব তোমার ছেলে নাকি?
তোমার ডাকে দিচ্ছে রোজই এমন করে সাড়া।
তোমার মেয়ে চাঁদকে দেখে আমি
ডাকলে কাছে বললো হেসে, ‘নামি
কেমন করে বলো এখন মায়ের কথা ছাড়া।’
তুমি আকাশ নিজকে কেন ভাবো এতোই দামী?
হতেই যদি ছোট্ট আমার মতো
তোমায় নিয়ে দূরের পাড়া যতো
ঘুরলে বলো কী মজাটাই পেতে তখন তুমি!
এখন বলো কেইবা দেবে তোমায় মজা অতো?
তবু আমার কথাগুলোর কোনো
হলো না দাম আচ্ছা তবে শোনো
বড় হয়েই ছোঁয়াবো হাত তোমার গায়ে আমি।
যতোই তুমি বড় হবার স্বপ্ন মনে বোনো।
--(আকাশ তুমি / আহমাদ মাযহার)
কিশোরের নিষ্কলুষ মনে যা কিছু তার কাছে তার স্বপ্নের সাথে সংগতিহীন মনে হয় তা-ই সে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিতে চায়। তার ইচ্ছের রঙে ভরে তুলতে চায় পৃথিবী-
জল ভর ভর মেঘ ছেড়েছে ঘর
মেঘ ছুঁয়েছে আকাশবাড়ি
ভিজলো জলে নীলের শাড়ি
বৃষ্টি ছুঁলো বনবনানী দিগন্ত প্রান্তর
মন ভর ভর মেঘ ছেড়েছে ঘর
হাওয়ায় চড়ে কোথায় যাবে মেঘ
ধানের চারা দেয় ইশারা
বৃষ্টি তাতে দেয় যে সাড়া
মেঘ ছোটালো তাই কি হাওয়ার বেগ
বাদলা দিনে কোথায় যাবে মেঘ !
--(মেঘ ছেড়েছে ঘর / হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী)
কিন্তু এই স্বপ্নের মধ্যেও কি বিভ্রম জাগে না ? জাগে। কখনো কখনো সে এই বিভ্রমেও আক্রান্ত হয়। সে উপলব্ধি বুঝে না, জানে না উপলব্ধির রঙ। তবু অনুভবে দোলে ওঠা এই অচেনা বিচিত্র ইচ্ছাটাকে চেখে দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাকে ঠিকই তাড়া করে অদ্ভুত মোহে-
শিল্পী তুমি আঁকতে পারো-
ভোরের ছবি?
-পারি
তপ্ত রবি?
-পারি
ফুলের বাগান?
-পারি
মাঠভরা ধান?
-পারি
পাখির ডানা?
-পারি
শিশির দানা?
-পারি
মুক্তিযুদ্ধ?
-না না
একাত্তরের ছবি কি যায়
রঙতুলিতে আনা!
--(শিল্পী ও মুক্তিযুদ্ধ / মুহিব নেছার)
কিশোরের মুক্ত-স্বাধীন মনে চাপিয়ে দেয়া শৃঙ্খলার বাস্তবতা যখন তার ইচ্ছে বা আগ্রহের প্রতিকূল হয়ে ওঠে তখন কিশোর-মনের স্বপ্নময় ইচ্ছাও যে কত যুক্তিহীন হয়ে ওঠে তা হয়তো বুড়োদের কাছে কৌতুককর মনে হতে পারে ! কিন্তু কিশোরের কল্পনা যুক্তি বা বাস্তবতার বাছবিচার করে চলে না। এখানে সে চূড়ান্ত সার্বভৌম-
অঙ্ক নিয়ে বসলে আমার কখন কী যে হয়
টেবিলটাও পর হয়ে যায় বইগুলো সব ভয়।
ভয়ের চোটে ভাবতে থাকি শহর ভেঙে কেউ
দালান কোঠা বিছিয়ে দিয়ে তোলে খেতের ঢেউ।
রাস্তাগুলো নদী এবং গলিরা সব খাল
ইলেকট্রিকের খাম্বাগুলো পাল্টে হলো তাল।
মোটরগাড়ি গরুর পালে হাম্বা তুলে হাঁটে
পুলিশগুলো গুলিস্তানে নিড়ানি ঘাস কাটে।
আব্বা হলেন কাকতাড়ুয়া আম্মা হলুদ পাখি
বুবুরা সব ভুঁইকুমড়ো পাতায় ঢেকে রাখি।
সবাই যখন পাল্টে গেছে নিজের ঘরে নাই
আমিই তখন ইচ্ছে মতন খোকন হয়ে যাই।
কেউ বলে না আঁক কষতে কেউ বলে না লেখ্
কেউ ধরে না কানের লতি, কেউ বলে না শেখ্।
ঢাকা শহর, ঢাকা শহর সবুজ হয়ে যাও
কলেজগুলো সর্ষে বাগান ভার্সিটিতে লাউ।
--(ভয়ের চোটে / আল মাহমুদ)
স্বপ্নময়তাই যেখানে চিরায়ত কিশোর-মনের সহজাত প্রবণতা, সেই নিষ্কলুষতার মধ্যে যদি সামাজিক বিভেদ ব্যবধান কিশোর প্রবৃত্তিকে আহত খণ্ডিত করতে উদ্যত হয়, তা হয়ে ওঠে খুবই বেদনাদায়ক। বড়দের এইসব জটিল কূটিল মনস্তত্ত্বে ছোট্ট কিশোরের থৈ পাওয়ার কথা নয়। এক কঠিন হীনমন্যতাবোধে আক্রান্ত কিশোর তখন মরমে মরে যায়, বিদ্রোহী সত্তা তার ঘৃণা প্রকাশ করে মর্মস্পর্শী শিশুতোষ অভিব্যক্তি দিয়েই-
নাম বলেছি , ধাম বলেছি- এবং বয়স কত
সেই সঙ্গে এও বলেছি মা হয়েছেন গত।
দশখানা আঁক কষতে দিলে একটা হবে ভুল
আমাকে তাও নিতে নারাজ এই তোমাদের স্কুল !
কারণ আমার প্যান্টে ফুটো জামার কলার ফাঁসা
উড়াল সেতুর নীচে আমার পাখ-পাখালির বাসা।
বাবা উধাও পুলিশভ্যানে তখন আমি ছোটো,
মরার আগে মা বলেছেন মানুষ হয়ে ওঠো।
সেই কারণেই বই পড়েছি , পথ কুড়োনো বই
তোমার সঙ্গে আজকে না হোক , কালকে তো খেলবোই।
--(লিখছি আমি / মৃদুল দাশগুপ্ত)
নমূনা হিসেবে এরকম ক্লাসিক উদাহরণ প্রচুর রয়েছে এবং অবারিত না হলেও হয়তো আরও বেশ কিছু উপস্থাপন করার অবকাশ থেকেই যায়। তবে সদিচ্ছা সুদৃঢ় হলে এগুলোর আন্তরিক সংগ্রহ ও অধ্যয়নচর্চার বিষয় করে তোলা অসম্ভব কিছু নয়। স্বপ্নপ্রবণ কিশোর-মনের এই যে চিরায়ত বিস্ময়, অভিব্যক্তির নিরন্তর পরিবর্তনশীলতা, পরিবেশ-প্রকৃতি-সামাজিক শৃঙ্খলার সাথে নিত্যকার দ্বন্দ্ব-বাধ্যবাধকতা এবং তা থেকে মুক্ত হওয়ার বিদ্রোহী ইচ্ছাভ্রমন, তার সবই অক্ষর-বুননে মূর্ত করে তোলা জটিল তো বটেই। কাব্যের তত্ত্ব-তালাশ আয়ত্তে এলেও কিশোর মনন, মনস্তত্ত্ব, মনোজগতের দ্বন্দ্ব বিকাশ এবং সহজাত গতি প্রকৃতিকে যথাযথ আত্মস্থ করতে না পারলে একে কবিতার মোড়কে প্রকাশ করা দুরুহ বৈ কি। অন্যদিকে নিবিড় পর্যবেণগুণে চিরায়ত কিশোর-প্রকৃতির সুলুক-সন্ধান কেউ হয়তো পেয়ে গেলেন ঠিকই, কিন্তু কবিতা কী বা কেন ও কখন একটি রচনা কবিতা হয়ে ওঠে তা যদি উপলব্ধির তারে ঝংকৃত না হয় কিংবা কবিতার রূপ-মাধুর্য্যের প্রয়োজনীয় অধ্যয়ন অধ্যাবসায় না থাকে, তাহলেও শিল্পোত্তীর্ণ কোন কিশোর-কবিতা নির্মাণ শুধু অসম্ভবই নয়, অপচেষ্টাও। বাংলাকাব্যের সম্ভ্রান্ত ঐতিহ্যকে মাথায় রেখে আমাদের ক্লাসিক নিদর্শনগুলোকে যত বেশি চর্চার বিষয় করে তুলতে পারবো আমরা, সৃজনশীলতার গতিধারা ততই লক্ষ্যাভিমুখী ও বেগবান হয়ে উঠবে।
এবং এটা মনে রাখা বোধ করি খুবই জরুরি যে, সাধারণ কবিতার চেয়ে কিশোর-কবিতা নির্মাণ শতগুন জটিল একটা বিষয়। তা যেন আমাদের সৃজনশীল কবিসত্তা কখনোই বিস্মৃত না হয়।
(৩০-০১-২০০৯)
[nirmaan-muktangon]
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment