Thursday, March 5, 2009

# ম্যালা কথা বইমেলায়। ০১। কিছু ঘৃণা, লজ্জা ও কষ্টের কথা।


ম্যালা কথা বইমেলায়। ০১। কিছু ঘৃণা, লজ্জা ও কষ্টের কথা।
রণদীপম বসু

(১)
দেশে এখন একটা থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। যাকে বলে দুঃসহ। ঘর থেকে বেরোলেই চলমান যে মূর্তিগুলো আশেপাশে দেখি, ক’দিন আগেও এরা উজ্জীবিত মানুষ ছিলো ! এখন শুধুই আতঙ্কগ্রস্ত দুপেয়ে প্রাণী এরা, রোবট যেন। পরস্পর অনাস্থা, অবিশ্বাস। এবং অদ্ভুত এক অথর্বতা এসে গ্রাস করে ফেলেছে ! থমকে গেছে সব ! দৈনন্দিকতার শত কষ্ট ব্যথার মধ্যেও যাদের উৎফুল্ল থাকা উদ্ভাসিত মুখগুলোর দিকে তাকালে ভেতরের জমাট দুঃখগুলো গলে যেতো নিমেষেই, সেই সব মুখ এখন জমাট পাথর মেখে অস্থির ! স্বতঃস্ফূর্ত সতেজতার জায়গায় জমে থাকা স্তব্ধতার আঁচড় দেখে মুষড়ে পড়ি। বিষাদে অবসন্ন হয়ে পড়ি। কিন্তু কেন ? কারা এমন করলো ? কাদেরকে দায়ী করবো আমরা ? এরা সেই সব জন্মগ্রন্থিহীন অমানুষ, যারা মানুষকে মানুষকে বলে গণ্য করে না, নিজের দেশকে যারা মাতৃভূমি জ্ঞান করে না, অভিন্ন রক্তধারায় ভাইকে যারা ভাই বলে মানে না। অর্থাৎ নিজস্ব জন্মজটিলতার লজ্জাকে অন্যের মধ্যে সংক্রামিত করার পৈশাচিক আনন্দ খুঁজে খুঁজে যারা মানবিক সমাজ আর সভ্যতার মুখে চুনকালি মাখানোর বিকৃত তাড়নায় তড়পায় কেবল। একতাল ঘৃণা ছুঁড়ে দিলাম সেই সব অদৃশ্য কুশীলবদের প্রতি। বেদনায় মুহ্যমান আমার অক্ষরগুলো যেন চিরকাল তাদের প্রতি ঘৃণা বর্ষণ করে যায়। যখন আমি হাসবো, কাঁদবো, ঘুমাবো, কাজে মগ্ন হবো কিংবা নীরব ও নির্জনতায় হারিয়ে যাবো, আমার বিগত ও আগত অক্ষরগুলো তখনো যেন বিশ্বের সব মানবতা বিরোধী ঘৃণ্য অপচ্ছায়াগুলোর প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে যায়।


(২)
আমাদের প্রাণের মেলা একুশে বইমেলা। গোটা মাস জুড়ে আমাদের সমস্ত সজীবতা দিয়ে যে মাসটিতে আমরা নিজেকে অবাধে মেলে ধরতেই থাকি সেটা ফেব্রুয়ারি। এটা আমাদের সাহসের মাস, গর্বের মাস, ত্যাগের মাস, অর্জনের মাস ও আত্মপরিচয়ের মাস। এবং একইভাবে এখন লজ্জা ও বেদনার মাসও। মেলার শেষ লগ্নে এসে ২৫ তারিখে জাতির অস্তিত্ব কাঁপিয়ে দেয়া পিলখানা ট্র্যাজেডির এতোবড়ো ধাক্কায় সবকিছুই উলটপালট হয়ে গেলো। সেই মেলা আর উচ্ছ্বাসের মেলা রইলো না। হয়ে গেলো স্বজন হারানোর কান্নায় একরাশ রক্তক্ষরণের মেলা। তবু নাড়ির টান কি কেউ ছাড়তে পারে ! মেলার শেষ দিনে তাই অনেকেই এলো। এবং ভীড়ও হলো প্রচুর। হয়তো এর কারণও ছিলো বহুমাত্রিক। শুধু যে শেষ সময়ের কেনাকাটাটা সারতে এলো সবাই, তা মনে হয় না। এতো বেশি স্তব্ধতা, এতো বেশি বেদনার ভার সইতে পারছিলো না বলেই কি ? না কি আপাদমস্তক এক দুর্ভার অস্থিরতা থেকে মুক্তি পেতে ? প্রিয় মুখগুলোকে আবার কবে দেখার দীর্ঘবিরতিপূর্ব নীরবতাগুলো বুকে ধারণ করতে ? না কি অচেনা অভিমানগুলো ধোয়েমুছে নিতে ? হয়তো সবি, অথবা আরো কিছু।


(৩)
২৮ ফেব্রুয়ারি। শেষ দিনের মেলাটাকে শেষবারের মতো ছুঁয়ে দেখছি, এ স্টল থেকে ওই স্টলে। নজরুল মঞ্চ, যেখানে এবারের প্রকাশিত সবগুলো বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, পেছনের নির্দেশক বোর্ডের দিকেই চোখ গেলো প্রথমে, যেখানে গোটা মাস জুড়ে আমাদের প্রিয়তম বাংলা ভাষাকে নেংটা করা লজ্জাটা নির্লজ্জভাবে চোখ টাটাচ্ছিলো সেদিনও, ইতিপূর্বে দেখা ২৪ তারিখ পর্যন্ত। সেখানে শেষ মুহূর্তের লজ্জা নিবারণের দাগটা দেখে আশ্বস্ত হলাম। যাক্, এতোদিন যে উলঙ্গ ছিলাম, শেষ সময়ে এসে অন্তত তা যে বুঝতে পেরেছি আমরা এটাই বা কম কীসে ! ‘উম্মোচন’ শেষতক ‘উন্মোচন’ তো হলো...!

[sachalayatan]

No comments: