Friday, May 15, 2009

# ছেঁড়া ঘুড্ডি। ০৩। শেষ মুহূর্তের আগে...


শেষ মুহূর্তের আগে...
রণদীপম বসু

০১.
বুকের ভেতরে কোথায় যেন একটা পাথর আটকে গেছে ! শ্বাস নিতে পারছি না। ভয়ঙ্কর হাসফাস হচ্ছে। আগুনের তীব্র হল্কায় ভেতরে ঝলসে যাচ্ছে সব। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। খাড়া করা দড়ির মতো ভারসাম্যহারা শরীরটা মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। এরপর যা ঘটতে লাগলো, অবিশ্বাস্য, আরো ভয়ঙ্কর ! চোখ দুটো বুজে এসেছে প্রায়। কিন্তু এ কী দেখছি আমি ! এক তীব্র অজানা আতঙ্কে সিটিয়ে যাচ্ছি ক্রমশই। ব্যায়ামপুষ্ট তরতাজা শরীরটা শুকনো ফোটা পাকা আমের বাকলের মতো এমন অদ্ভুত কুঁকড়ে যেতে লাগলো, খলবলে পেশীবান ভেজা উরুটা দেখতে দেখতেই চিপসে অর্ধেক হয়ে গেলো ! ধনুকের ছিলার মতো তারুণ্যের উজ্জ্বল টানটান চামড়া যেন সহস্রভাঁজে ঝুলে পড়েছে। কে বলবে এটা বিরানব্বই বছরের পুষ্টিহীন কোন অশীতিপর বার্ধক্য আক্রান্ত উরু নয় ! মাংসপেশীগুলো জমে পাথর হয়ে যাচ্ছে সব। গোটা শরীরটাই কি এমন বীভৎস হয়ে গেলো !

একটা বিকৃত কদাকার পাথর-শরীর চৈতের কাঠফাটা আগুনে পোড়া মাঠের মধ্যে অসহায় তড়পাচ্ছে কেবল। প্রচণ্ড বিশ্বাসী এই শরীরের অস্বাভাবিক রূপান্তরে হতবাক আমি আকুল হয়ে ওঠার সময় পেলাম কিনা জানি না, তার আগেই সব কিছু ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো। মাঠভর্তি হৈ-হল্লা চিৎকার চেচামেচি গুঞ্জন সব মন্থর থেকে মন্থর হয়ে আসছে। এবং আশ্চর্য ! হঠাৎ করে তীব্রতম সব অস্বস্তি, কষ্ট, ভোগান্তি, যন্ত্রণা স-ব একে একে বেমালুম মুছে যাচ্ছে ! আহ্ কী শান্তি ! অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে ডুবে যাচ্ছি। এক বিশাল শূন্যতা বুঝি ধেয়ে আসছে আমার দিকে। বুঝলাম, সময় নেই। তবে কি মারা যাচ্ছি আমি ! আহা, কারো কাছে ক্ষমাটুকু চেয়ে নেয়ার ফুরসতটাও পেলাম না ! ভীষণ আফসোস হলো, হায়, কেন যে এমন হঠকারি কাজটা করতে গেলাম ! প্লীজ, আমাকে মাফ করে দিয়ো, বন্ধুরা...সবাই...

০২.
...গভীর এক নৈঃশব্দের মধ্যে কতোকাল ধরে শরীরটা দুলছে ! গাড়িতে চড়লে কি এমন হয় ! পৃথিবীর অন্ধকার অতল কোন গহ্বর থেকে অসম্ভব মৃদু কিছু গুঞ্জন, ভাসছে... বাড়ছে..!

০৩.
ছেলেটা ঠিক মা’র চেহারা পেয়েছে ! দেখলেই ওর মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে।
ঠিকই।
তবে হ্যাঁ, এই ছেলেরা কিন্তু ভাগ্যবান হয় !
হাহ্ ! ভাগ্যবান ! ........
.....................
যাহ্, তোর সাথে আর খেলমু না !
কেন, খেলবি না কেন ?
তুই খালি চুরি করস ! দে আমার মারবেলগুলা দে !
কিসের মারবেল তোর ! এইগুলা সব আমার। যা ভাগ্ !
দেখ্, ভালো হইবো না কইলাম !
ইহ্, ভালো হইবো না মানে ! কী ভালো হইবো না !...
ও মাগো... আমারে মাইরা ফালাইলো গো.......
...............................
এই আমারে একটা হাওয়াই মিঠাই দে।
দশ পইসা কিন্তু !
ইশ্, দশ পইসা ! পাঁচ পয়সা দিমু, দে !
না...!
আইচ্ছা ঠিক আছে যাহ্, দশ পয়সাই। দে একটা দে। পয়সা কাইল ইস্কুলে আইয়া নিস্।
না, আম্মায় বাকি দিতে মানা করছে ! বাকি দিমু না আমি।
কী ! দিবি না ! দাঁড়া দেখাইতাছি......!
আ..আ..আ..., আমার বাক্স গেলাস ভাইঙ্গা ফালাইছে...আ..আ..আ.......
................................
গর্দভের দল ! ইস্কুলটা কি ফাজলামী করার জায়গা ! বেয়াদ্দপ কোথাকার ! এই, এদিকে আয় ! পড়া আনিস নি কেন ? কানে ধইরা এইখানে পঞ্চাশবার উঠবস কর ! এই তুইও এদিকে আয়। দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া তুই গুনতে থাকবি...। ... আচ্ছা গতকাল আমরা কত পৃষ্ঠায় শেষ করছিলাম ?...
ফটিকরে তার মামায় আইসা লইয়া গেছে...
এক..দুই..তিন......নয়..দশ......পনের..ষোল......একত্রিশ..বত্রিশ......পঁচিশ..ছাব্বিশ...
দেখ্, ভালা হইবো না কইলাম !
রবীন্দ্রনাথ এখানে বলতে চেয়েছেন যে...
...উনত্রিশ..ত্রিশ......বাইশ..তেইশ...
ওই, ফাইজলামি করস ! চল্লিশরে বাইশ গনতাছস ! কেলাশ শেষে শালা তোর নাকের বদনাটা ফাটাইছি আইজ !...
এই বয়েসটার মতো এমন বালাই আর নেই কেন ? ...এই হইছে তোদের !
জ্বী.. তিরিশবার হইছে স্যার !
না স্যার ! এই হালার পুতে মিছা কইতেছে ! আমার পঞ্চাশবার পুরা হইছে...
চুপ ! কত্তোবড়ো বেয়াদপ ! এই যা তো, অফিসরুম থাইকা লম্বা বেতটা নিয়া আয়..!......
................................
ইশশিরে ! এইমাত্র না তারে গাছে দেখলাম ! ওই আগায় বইসা কী জানি খাইতেছিল। হঠাৎ এমোন পাকনা তালের মতো...
আরে ভাই আগে তোলা দিয়া পুকুরে নেন...
আরে আরে কথা কইতে পারতেছে না তো ! এই ধর ধর...
না না এইভাবে না ! পানিতে বুকটারে চুবাইয়া বসান তাড়াতাড়ি...গোঙানি বাইর হইলে হাসপাতালে নিয়া ......
................................
এই ছেলে ! বেয়াক্কেলের মতো স্টেজে এতো পা কাঁপাচ্ছিলে কেন এ্যাঁ ? আর কী আশ্চর্য ! একই ডায়লগ বারবার বলছিলি কেন শুনি !
জ্বী স্যার, মানে.....
................................!
তোরা যে আইজকাইল কী হইছস না ! থাকিস হুস্টেলে ! মাস-দু’মাসেও কি বাড়িতে একটা চিঠি লেখা যায় না ! পোস্ট অফিস থাইকা একটা পোস্টকার্ড নিয়া কিচ্ছু তো লেখাও লাগে না ! ভালো আছি এই কথাটা লেইখাই ছাইড়া দিলে হয় !
ঠিক আছে, দিমু।
প্রতিবারই তো ঠিক আছে বইলা যাস্ ! বুঝবি কেমনে ! যেদিন বাবা হইবি, সেদিন বুঝবি বাবারা কেন এইরকম কথা কয় !......
................................
কী ব্যাপার, কাঁদছো কেনো ?
কই, কাঁদছি না তো ! ইউনিভার্সিটিতে কতো সুন্দর সুন্দর মেয়ে আছে ! সেইখানে গিয়া কি আমারে আর মনে থাকবো তোমার !
দূর পাগলি ! এই বুকটারে যেইভাবে জুইড়া রাখছো তুমি, তোমারে না দেইখা আদৌ কি হলে থাকতে পারমু ! শেষপর্যন্ত লেখাপড়া শিকায় তুইল্যা ম্ক্তুকচ্ছ হইয়া তোমার এই দিওয়ানা মজনু রাস্তায় রাস্তায় লাইলী কই লাইলী কই কইয়া দৌঁড়তে থাকে কিনা কে জানে !
যাও, তুমি কী যে কও না !
তাইলে এবার কও, চিঠি পাবো তো ? সেইরকম...মাখানো ?
দ্যাখো ......
................................
গ্ল্যাড টু মিট য়্যু ! আমি... ম্যান অব কুমিল্লা, আপনি ?... আমি সিলেট। ......দোস্ত, বাগান থেকে অরিজিনাল চা-পাতা চাই। ...... আপনাকে না খুব জলি মনে হয়!....লজ্জা পাইলাম....আপনার মতো মেয়ের কাছে এলে পাথরও ফুল ফোটাতে শুরু করে যে !.......কী যে বলেন, আপনারা জুয়েল স্টুডেন্ট, তার উপরে...... এই দোস্ত, তুমি তো ব্যায়ামবীর মানুষ, নাম দিবা নাকি কম্পিটিশনে ?......কী ব্যাপার কবিতার কুস্তি হবে নাকি !...... আরে নাহ্.এথলেটিকস।......
... হাই দোস্ত, ফার্স্ট হওয়া চাই কিন্তু ! শাটল ট্রেন ভইরা ডিসি হিল যামু।.. প্রমিজ, তেয়ারি ফ্রি !...লিসেন টু মি...প্রথম চক্করে কেউ ট্র্যাক চেঞ্জ করতে পারবে না......বাঁ দিক দিয়ে ওভারটেক করলে ডিসকোয়ালিফাইড !......সাড়ে বারো চক্করে পাঁচ হাজার মিটার হবে...ঠিক আছে ?... প্রথম বাঁশি এলার্ট, দ্বিতীয় বাঁশি গো !
...... সাব্বাশ দোস্ত, আরো জোরে !......আগ বাড়ো দোস্ত আগ বাড়ো, সুবর্ণার কসম কইলাম !...... ইশ্, কী রোদ !...... দোস্ত, এই নাও, দাঁতে চাইপ্যা রাখো !...... এই এই পানি মার, পানি মার !...... আর মাত্র তিন চক্কর...... সাইড দিবা না দোস্ত ! কোনোমতেই......জোরসে জোরসে ! আর একটু বাকি !......আইসা গেছো দোস্ত, আইসা গেছো.....হ হ... হুররে......সেকেন্ড সেকেন্ড !......না না থার্ড হইছে...... আরে আরে কী হইছে দেখ্ তো !...... এই ধর ধর !...... অ্যাম্বুলেন্স লাগবো, অ্যাম্বুলেন্স !...... আরে ! এ তো শক্ত হইয়া গেছে !...... ম্যাসেজ ম্যাসেজ...... ইমার্জেন্সী ! ইমার্জেন্সী !......
প্রেশার ? ...স্যার আর্জেন্ট স্যালাইন পুশ করে দেই ?... না ! সাথে সাথেই প্যাসেন্ট এক্সপায়ার করবে !...কিছুতেই স্যালাইন পুশ করা যাবে না ! ... সিভিয়ার সান-স্ট্রোক !... র‌্যাপিড স্যালাইন মেসেজ, অল ওভার দ্য বডি, কুইক ! ......এই, ভিসিকে ফোন করো ! এদেরকে মার্ডার কেসে দেয়া উচিৎ !... থার্টি এইট ডিগ্রী সেলসিয়াসে এই আহাম্মক ছেলেপেলেগুলারে মারতে নামাইছে !... জানাইয়া দাও, থার্ড টাইম কোন প্যাসেন্ট রিসিভ করবো না আমি... সোজা চিটাগাং রেফার করবো !...ওয়ার্থলেস এইসব খুনের দায় আমি কেন নেবো ! রাবিশ ! ......

০৪.
পৃথিবীটা খুব দ্রুত কোলাহলময় হয়ে ওঠতে লাগলো। আশে পাশে ঠুংঠাং, ধুপধাপ, ক্যাচকোচ কতো রকমের শব্দ-স্রোত। কথাবলার আওয়াজও পাচ্ছি। দুই ঠোঁটের ফাঁকে কাপড় বা তুলা জাতিয় কিছু গুঁজে দেয়া হয়তো। হালকা নোনা স্বাদ আঠালো মুখটাতে ছড়িয়ে আছে। মুখে কি মাক্স লাগানো ? পায়ের আঙুল থেকে হাঁটু উরু কোমর পেট বুক হাত বা পিঠের ধারে কিরকম ঘষাঘষি টের পাচ্ছি যেন। চোখ খুলে সাথে সাথে বন্ধ করে নিলাম। অসহ্য ঝাঁঝালো আলো ! আবার খুললাম, এবারে চোখে সয়ে এসেছে। উৎকণ্ঠিত সহপাঠি বন্ধুদের মুখ। চিৎ হয়ে শোয়া আমাকে সমানে ম্যাসেজ করে যাচ্ছে ওরা। হঠাৎ চোখ খুলতে দেখেই হয়তো উজ্জ্বল হয়ে ওঠলো তাদের মুখ। মানে এবারের মতো বেঁচে গেলাম আমি ! আশপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারছি এটা ইউনিভার্সিটি হেলথ ক্লিনিক, যেখান থেকে আমরা হলের ছাত্ররা প্রায়ই ফালতু রোগ সাজিয়ে বিনে পয়সার ঔষধ নিয়ে যাই।

সংজ্ঞাহীন হবার আগমুহূর্তটা মনে পড়ে গেলো। শিরশির করে সেই আতঙ্কটাই চেপে বসছে আবার ! চোখ খুলতেই ভয় হচ্ছে এবার। কী না কী দেখবো ! না না, এমন বীভৎস শরীর চেহারা নিয়ে বেঁচে থাকার অভিশাপ কী করে বইবো আমি ! এর চেয়ে তো মৃত্যুই ভালো ! নিজের বালসুলভ হঠকারিতা, গোয়ার্তুমি, হতাশা, দুঃখে বুকটা ভেঙে হা হা করে কান্না আসছে। কুড়ি বছরের তরতাজা বয়সে থুত্থুরে কোঁচকানো অশীতিপর পরিত্যক্ত একটা দেহ নিয়ে কার কাছে যাবো আমি ! নিজের গড়া এই দুঃসহ নিয়তিই কি শেষপর্যন্ত সঙ্গি হলো আমার ! নাহ্, এর একটা সুরাহা তো আমার নিজেকেই করতে হবে ! নিয়তির মুখোমুখি হতে এবার মরিয়া হয়েই চোখ খুললাম, তাকালাম পায়ের দিকে। ওমা এ কী ! এ তো আমার সেই আগের পা ! আগের শরীরই ! ক্ষাণিকটা মলিন তবু আহ্, কী সুন্দর ! হুড়মুড় করে উঠে বসলাম। রে রে করে ওঠলো সবাই- আস্তে, আস্তে ! কিন্তু কে শোনে কার কথা ! অসম্ভব সুন্দর একটা পৃথিবীতে তখন অবস্থান করছি আমি !

পরনে সেই শর্টস, যেটা পড়ে পাঁচ হাজার মিটার দৌঁড়ের আন্ত-হল কম্পিটিশনে নেমেছিলাম। কিনিক ইন-চার্জ ডাক্তারের সামনে যেতেই নিগ্রোমার্কা বিশাল শরীরটার উপরে ঘাড় ধরে বসানো ছোট্টখাট্ট মাথাটা একটু উপর দিকে তুলে পিটপিট করে তাকালেন। খসখস করে একটা প্যাডে কী যেন লিখে বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে- সোজা হলে গিয়ে শাওয়ারের তলে মিনিমাম আধা ঘণ্টা !
মাথা চুলকে বললাম, কিন্তু স্যার, আমি যে দশ হাজার মিটারেও নাম দিয়েছি !
হোয়াট ! ফাজলামী করছো ! দুর্বাসার দৃষ্টিতে কটমট করে বিদ্রূপ মাখানো হুঙ্কার - তখন আর এতো কষ্ট করে এখান পর্যন্ত আসতে হবে না ! ... গেট লস্ট !
টুপ করে বেরিয়ে পড়লাম আমি। তাঁর বাজখাই গলা তখনো কিনিক জুড়ে গমগম করছে।

অ্যাম্বুলেন্স থেকেই উচ্ছ্বাসে-উৎসবে আন্দোলিত মাঠটা দেখা যাচ্ছে। রেজিস্টার বিল্ডিং-এর টিলাটার ঢাল বেয়ে চলে যাওয়া বৃত্তাকার সরু পাকা রাস্তাটার পাশেই বেশ নিচে বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠটা। মাঠের এক কোণায় কিনিকের সামনে থেকে শ্যামলে সবুজে পাহাড়ে টিলায় ঘেরা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার নয়নাভিরাম দৃশ্য যেটুকু চোখে পড়ছে, তা-ই আরো বেশি মনোরম হয়ে ওঠেছে আমার চোখে। অ্যাম্বুলেন্সটা বাঁক ঘুরতেই মাঠটা হারিয়ে গেলো। তবু মাইকের ছড়ানো আওয়াজে কোলাহলটা ঠিকই শোনা যাচ্ছে। পাশ থেকে বন্ধুটি এবার মুখ খুললো- বিশ্বাস করবি কিনা দোস্ত, যে মুহূর্তে মনে হচ্ছিল আমার প্রিয় বন্ধুটি আমার কোলেই মারা যাচ্ছে, কয়েক মুহূর্ত আমারও মনে হয় জ্ঞান ছিলো না।
বন্ধুভাগ্যে অহঙ্কারী আমি তাঁর চোখে চোখ রেখে বললাম, আমাকে মাঠ থেকে ক্লিনিকে নিয়ে আসতে কতক্ষণ লেগেছে বল তো ?
বেশি না, এই দেড় কি দু’মিনিট !
না দোস্ত, আমার তা মনে হয় না। তোরা আমাকে বিশ বছর বয়ে এনেছিস !
মানে ! সন্দিগ্ধ কণ্ঠ তাঁর।
মানে বিশ বছর ! আচ্ছা বল তো, মৃত্যুর আগ-মুহূর্তে মানুষ কি তার ফেলে আসা গোটা জীবনটাকে এক পলকে দেখে ফেলতে পারে ?
একথা কেন বলছিস ?
সত্যিই সংজ্ঞাহীন ছিলাম কিনা জানি না। তবে ওই সময়ে এক আশ্চর্য কাণ্ড ঘটে গেছে ! জীবন্ত চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে আমি আমার জীবনের গোটা সময়টা, এমনকি প্রতিটা মুহূর্ত ছুঁয়ে ছুঁয়ে এক দীর্ঘ ভ্রমণ সেরে এসেছি ! একেবারে সেই শৈশব থেকে...
কী বলছিস ! তা কী করে সম্ভব ! এক আশ্চর্য বিহ্বলতায় আমার কথার মাঝখানেই তাঁর বিস্ময় ঝরে পড়লো।
আদৌ তা সম্ভব কিনা, সে প্রশ্নটা এখন শুধুই অবান্তর আমার কাছে। তবু পৃথিবীতে প্রশ্নরা বুঝি অন্তহীনভাবে বইতে থাকে। যার কোন উত্তরই জানা নেই আমার। ভেতরের গুনগুন করা স্বগতোক্তিগুলো অবাধ্য এ জিহ্বাটায় নাড়াচাড়া খেয়ে ছলকে ওঠছে কেবল-
জানি না দোস্ত। খুব ছোট্ট এই জীবনে কতো মানুষকেই যে কষ্ট দিয়ে এসেছি আমি ! সেসব তো ভুলেই গিয়েছিলাম !...
অবারিত বিস্ময় নিয়ে বন্ধুটি আমার মুখের দিকে চেয়েই রইলো। সোহরাওয়ার্দী হলের গেটে এসে অ্যাম্বুলেন্সটা ব্রেক করলো ঠিকই। কিন্তু সেই বিস্ময়টা অদ্ভুত এক আচ্ছন্নতা নিয়ে আমার মাথার ভেতরে ঘুরঘুর করতে থাকলো...
Image: from internet.
(০৭/০৫/২০০৯)

# [রম্য-গল্প] --- চটাশ !


...চটাশ !
রণদীপম বসু

চটাশ্ !
চমকে ঘুরে তাকালাম। হতভম্ব লোকটা ডান হাত দিয়ে সম্ভবত বাঁ গালটাকে চেপে রেখেছে। অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না এরকম কিছু ঘটতে পারে ! তাঁর বাঁ হাতটা টেনে ধরে মেয়েটি এক ঝটকায় পাশের খালি রিক্সাটায় উঠে বসলো এবং লোকটাকে টানতে লাগলো। শাহবাগের এই জনাকীর্ণ মোড়ে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এমন অভূতপূর্ব ঘটনায় আমার মতো কৌতুহলী দর্শকের অভাব থাকার কথা নয়। লোকটা কী বুঝলো কে জানে, আশপাশ তাকিয়ে ঝট করে সেও উঠে বসলো মেয়েটির পাশে।

কী বুঝলি ?
মামা’র দিকে তাকিয়ে আমি মাথাটা এদিক-ওদিক বার দেড়েক নাড়ালাম শুধু। অর্থাৎ কিছুই বুঝি নি।
তুই একটা গাধা !
বাসা থেকে মামা’র সাথে বেরোনোর পর বিগত ঘণ্টা-দুয়েকের মধ্যে সম্ভবত এটা আমার ছাব্বিশতম খেতাব অর্জণ ! ভীষণ বিজ্ঞ টাইপ ব্যক্তি হিসেবে মামা’কে আমার খুবই পছন্দ। পৃথিবীতে হয়তো এমন কোন বিষয়ই নেই যা জানতে চাইলে মামা তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে এর একটা না একটা ব্যাখ্যা দেবেন না। ব্যাখ্যা তো নয়, বক্তৃতা ! জীবনে একবারই ইস্কুলের ডায়াসে উপস্থিত বক্তৃতা করতে দাঁড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে পড়েই যাচ্ছিলাম। সেদিনই বুঝেছিলাম, বক্তৃতা করাটা হচ্ছে পৃথিবীর কঠিনতম কাজের একটি। যার জন্য কিনা ভয়ঙ্কর বিজ্ঞতা আর যোগ্যতা থাকা অতি জরুরি। আর এই কাজটিই যখন-তখন যেখানে-সেখানে অবলীলায় করে ফেলার মতো লোক পৃথিবীতে হাতে গোনা ক’টি আছে ! তাদের মধ্যে আমার মামা যে একজন হবেনই, তাতে আর সন্দেহ কী ! অতএব তাঁর কাছ থেকে এরকম পাঁঠা, ছাগল, উল্লুক, গাধা, বলদ, খাটাশ এজাতীয় নিরীহ প্রাণীজ টাইটেল পেতে পেতে আমার যে আর একটুও খারাপ লাগে না, মামাও তা জানেন। এবং মামা যে জানেন, সেটাই হয়েছে জ্বালা ! কিন্তু মামা’র তাতে বিন্দুমাত্র সমস্যা বা বিরক্তি আছে বলে মনে হয় না। বরং অজ্ঞানকে জ্ঞান বিতরণের দাতব্য উদ্যমে মামা’র কোন ঘাটতি কখনোই দেখা যায় নি। আর এ মুহূর্তে আপন ভাগ্নের অজ্ঞানতাকে হেলাফেলা করার তো প্রশ্নই আসে না !

এটাকেই বলে প্রেম, বুঝলি !
প্রেম ! বলে কী ! আমার ছোট্ট আলজিহ্বাটা গলায় পেঁচিয়ে যাবার জোগাড় !
আরে ! এতে আশ্চর্যের কী আছে ! রামছাগলের মতো এমন হা করে আছিস কেন ?
কোথায় যেন পড়েছিলাম, ছাগলই নাকি একমাত্র দার্শনিক প্রাণী, জবাই করার আগেও যে নির্বিকার থাকে। এটা নাকি তার চোখ দেখলেই বুঝা যায়। কিন্তু মামা’র দেয়া তথ্যের সাথে সেটা যে কিছুতেই সাপোর্ট করছে না ! সেইসব তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণের আগেই মামার দ্বিতীয় পর্বের জ্ঞানদান শুরু, তাও একেবারে সাধু ভাষায়-
এই চর্মচক্ষে যাহা দেখা যায়, তাহা সত্য নহে; চক্ষের আড়ালে যাহা ঘটিয়া থাকে তাহাই সত্য ! গাধারাই কেবল যাহা দেখে তাহাই সত্য ভাবে। এই যেমন ধর্...
মামা’র জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতার তোড় যত বাড়ছে, আমার মাথাটাও তত জোরে ঘুরতে লাগলো। এবং আফসোসের সাথে আশঙ্কাটাও পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগলো, সুবর্ণার সাথে বিকেলের প্রোগামটায় টাইমলি এটেন্ড করতে পারবো তো ! সে আশায় গুড়েবালি হবার সমূহ ইঙ্গিত এখনই টের পাচ্ছি। ফলে মামা’র প্রতিও বুঝি এক ধরনের অসন্তোষ ভেতরে ভেতরে তৈরি হতে লাগলো।
কীরে ! উল্লুকের মতো এমন মোচড়ামোচড়ি করছিস কেন ? কথা বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি ! আয় আমার সাথে...
আহ্ হা ! থাক না মামা !
কে শুনে কার কথা ! হাত ইশারায় একটা রিক্সা ডাকলেন। আমার আপত্তি অগ্রাহ্য করেই রিক্সার দিকে এগিয়ে গেলেন। ইশ্ ! কী কুক্ষণে যে মামার সাথে বেরোতে গেলাম ! এখন নিজেই নিজের চুল ছিঁড়া ছাড়া কিচ্ছু করার নেই !

মামা’কে নিয়ে এই এক বিপদ। কোথাও বেরোবে, সাথে সাথে ভাগ্নের তলব। কিন্তু আমার যে কলেজ আছে মামা !
সে কী রে ! তুই তো দেখি সত্যি সত্যি অপদার্থই রয়ে গেলি !
কেন ? একথা বলছো কেন মামা ?
বল্ তো, শিক্ষা মানে কী ? শুরু হয়ে গেলো মামা’র জেরা।
নিরীহ ছাত্রের মতো বলি- শিক্ষা মানে কিছু জানা বা শেখা !
তুই একটা মূর্খ !
ভাগ্নের অজ্ঞতায় মামা রীতিমতো তাঁর অসন্তুষ্টি ঝাড়তে লাগলেন- শোন্, শিক্ষা হচ্ছে জ্ঞানার্জনের উৎকৃষ্ট উপায় অনুসন্ধান। তুই যে কলেজে যেতে চাচ্ছিস, কেন জানিস ?
আশ্চর্য ! আমি কেন কলেজে যাবো, আমি জানবো না !
না, তুই জানিস না। তুই যেতে চাচ্ছিস জ্ঞান নয়, জ্ঞানার্জনের উপায় খুঁজতে। আর আমার সাথে এখন যে বেরোবি, তাতে কী হবে বল্ তো ? তোর অনেক উপকার হয়ে যাবে। অনেক কিছুই জানতে পারবি তুই। প্রত্যক্ষ জ্ঞান। ওই কলেজ সাত জন্মেও তোকে ওগুলো দিতে পারবে ?
এবার হয়তো কিছুটা আঁচ করতে পারছি, সেই প্রথম বয়সে কেন মামা হঠাৎ করে কলেজ যাওয়া বন্ধ করে পড়ালেখার পাটটাই চুকিয়ে দিয়েছিলেন।

তবে অসম্ভব পড়ুয়া হিসেবে মামা’র নামডাক যে-কারোর জন্যেই ঈর্ষণীয় হতে পারে বৈ কি ! অত্যাবশ্যকীয় সঙ্গি হিসেবে নানান কিসিমের বই সংগ্রহের প্রবল তাড়নায় ঘরের ধান চাল হলদি মরিচ ইত্যাদি জিনিসপত্র বেমালুম হাওয়া করে দিয়ে মাঝে মাঝেই মামা যে নানার অনিবার্য খড়ম-চিকিৎসা আর ঘাড়ধাক্কা খেয়ে দিন-কয়েকের জন্য অদৃশ্য হয়ে যেতেন, সেটা আমাদের স্কুল পড়ুয়া ভাগনেদের কাছে তখন তো খুবই রোমঞ্চকর ঘটনা হিসেবেই মর্যাদা পেতো। রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষাগুলো শেষ হতে চাইতো না, কবে মামা ফিরে এলে রোমহর্ষক অভিযানের গল্পগুলো রসিয়ে রসিয়ে জাবর কাটবো। আমাদের ঢাকার বাসার গেটে মামার হাঁক-ডাক শুনা মাত্র মা ঠিকই দরজা আগলে দাঁড়িয়ে যেতেন- শোন্, এটা তোর বাড়ি না। ঘরের একটা জিনিস এদিক-ওদিক হবে তো...
দেখ্ বুবু, তুই এখনো তোর সেই বিশ বছর আগের অপরিণত জ্ঞান নিয়ে অপরিপক্কই রয়ে গেছিস। এই অজ্ঞানতা নিয়ে তোর ঘুম আসে কী করে !
কী বললি ! আমি অপরিপক্ক ! অপরিণত ! বেরো, এক্ষুনি বেরো ! খবরদার, তুই ঘরে ঢুকবি না বলছি !

মাকে চটিয়ে দেয়া মানে সন্ধ্যায় বাবা না ফেরা পর্যন্ত বাসায় এই টর্ণেডোর ঘূর্ণি আর থামছে না, এই নিশ্চিত পূর্বাভাস সবারই জানা। তবু কেন যে মামা প্রতিবারই এরকমটা করেন তা আমার কাছে বোধগম্য না। মা’র পায়ের কাছে ব্যাগটা ফেলেই বলবে- আমি তো বেরোতেই এসেছি ! এই নে, ব্যাগটা রাখ্। এরপর ‘ভাগ্নে’ বলে একটা হাঁক দিয়েই সোজা বাইরে। আমিও সুরুৎ করে মামার পিছু। বাবা না ফেরা পর্যন্ত বাসাটা যে কিছুতেই আর নিরাপদ নয়, সেই টেটনা বয়সেই এ অভিজ্ঞতার পাঠ নেয়া সম্পন্ন আমার। ঝড়ের বেগে শহরটাকে চষে ফেলে প্রাথমিক অভিযানটা সেরে সন্ধ্যে নাগাদ গেটের ধারে বারার জন্য অপেক্ষা আমাদের। অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশি উৎফুল্ল বাবা রিক্সা থেকে নেমেই মামার সাথে চোখাচোখি সেরে মার সামনে গিয়ে পকেটে হাতটা ঢুকিয়ে দেবেন। বাবার মুচকি মুচকি হাসিটা সেদিন বেশ দেখার মতো হয়। ততক্ষণে মার দিকে বাড়িয়ে ধরেছেন এক পাতা প্রেসারের টেবলেট। আর এদিকে দ্রুত আমরা আমাদের কক্ষের নিরাপদ আশ্রয়ের শেল্টার নিতে দে ছুট।

কিন্তু নানা’র মৃত্যুর এক মাসের মধ্যে নানীও মারা যাবার পর এবারই প্রথম একটু ভিন্নতা দেখা গেলো। বাসার গেটে মামার হাঁকডাক শোনা গেলেও মা আর আগের মতো এসে দরজা আগলে দাঁড়ালেন না। রুমে ঢুকেই কাঁধ থেকে ব্যাগটা প্রায় ছুঁড়ে ফেলে মামা’র খলবলে প্রশ্ন- কীরে ভাগ্নে, বুবুর তবিয়ত ঠিক আছে তো !
কেন, কী হয়েছে মামা ! এ কথা বলছো যে ?
চল্ চল্ দেখে আসি !
মামা’র পিছু পিছু আমিও মা’র ঘরের দিকে এগিয়ে যাই। তবে দরজার বাইরে থেকেই আমি ভাই-বোনের কুশল-বিনিময়ের আলামত শুনতে পাই। কোন ভূমিকা ছাড়াই মা’র বাক্যবর্ষণ শুরু হয়ে গেলো- দেখ্, তোর কারণে আব্বা-আম্মা এতো তাড়াতাড়ি চলে গেছে। তোর যদি একটুও হায়া-শরম থাকতো, তাইলে আরো ক’টা দিন হয়তো তাঁরা নতুন বৌয়ের মুখ দেখে সেবা-যত্ন নিয়ে শান্তিমতোই...
কথা আর শেষ হয় না। তার আগেই মা’র ফোঁপানো শুরু হয়ে যায়।
দেখ্ বুবু, এসব ফুৎফাৎ আমার সামনে করবি না ! কথা যা বলার শেষ করে তারপর আরামসে বসে যত খুশি ফুৎ ফাৎ করতে থাক্, আমার অনেক কাজ আছে।
মামা’র এই চোটপেটে কথা শেষ হতে না হতেই মা-ও ফোঁস করে ওঠেন- এই, তোর কাজ কী রে ? বারো ভুতের জিম্মায় ঘর-বাড়ি জমিজমা ফেলে বাদাইম্যাগিরি করতে এসেছিস। এটাই বুঝি তোর কাজ ! একটা বৌ জোটানোর মুরোদ নাই যার, তার আবার এতো সিনাজুড়ি কিসের শুনি !
হা হা হা হা ! এই হলো তোদের মেয়েদের সাইকোলোজি, বুঝলি ? পুওর, ভেরি পুওর...!
কথাটা বোধয় অসম্পূর্ণই থেকে গেলো। হুটহাট করে মামা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। আমাকে দেখেই এমনভাবে দাঁড়িয়ে গেলেন, যেনো কত্তো তাড়া রয়েছে তাঁর !
চল্ ভাগ্নে চল্, হাতে অনেক কাজ !
জীবনভর এতো ব্যস্ত-সমস্ত মামা’র আসল কাজটা যে কী, এটা আর জানার সৌভাগ্য হয়নি আমার ! কিন্তু আজ তো সে রিস্ক নেয়া যায় না ! সুবর্ণার সাথে প্রথম প্রোগ্রাম আমার। কথা ঘুরিয়ে বলি, মামা, আজ যে একটু ব্যস্ত আমি ?
বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কতক্ষণ। এই, তোর বয়স কতো হয়েছে রে ?
হুট করে এমন প্রশ্নে কিছুটা অস্বস্তি নিয়েই বললাম- হঠাৎ এরকম বয়স নিয়ে টানাটানি শুরু করলে যে !
হা হা হা ! আমার গর্দভ ভাগ্নেটা বড় হয়ে যাচ্ছে রে !
ঘরের ভেতরে মা রীতিমতো ফুঁসে আছে। তার ওপরে মামা’র কথা বে-লাইনে চলে যাবার আশঙ্কা চাপা দিতেই তাড়াতাড়ি বললাম- ঠিক আছে, চলো। এই চলো’টাই যে আমাকে এতো ফক্করে ফেলবে, তা কে জানতো !

আগের রিক্সাটাকে ফলো করেই কিছুদূর গিয়ে রিক্সা থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলেন মামা। আমিও ফেউয়ের মতো তাঁর সাথে। রমনা পার্কের ভেতরে ঢুকে গেলো ওরা। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে মেয়েটি সেই লোকটির হাত ছাড়ে নি এখনো। দিনের এ সময়টাতে ভালো করে লোকজনের ভিড় জমে ওঠেনি। লেকের পাড়ের নির্জন কোণাটাতে যেখানে ঝোপঝাড় একটু বেশিই মনে হচ্ছে, বড় গাছটাকে আড়ালে রেখে খালি বেঞ্চটাতে বসে পড়লো ওরা। গাছটাকে লক্ষ্য করে শিকারি কুকুরের মতো মামা এগিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে পাশেই আরেক ঝোপের আড়ালে দুটো ছেলে আর মেয়ের ঠোঁটগুলোকে কারা যেন সুপার-গ্লু দিয়ে একজায়গায় এনে আটকে দিয়েছে ! মামা’র সেদিকে খেয়ালই নেই। একটা অস্বস্তির মতো কি যেন বুকের মধ্যে খুট খুট করতে লাগলো। থেমে গেলাম আমি। এরং সাথে সাথেই টান পড়লো হাতে। কখন যে মামা আমার হাতটা ধরেছেন, আগে টের পাইনি।
না মামা, আমি আর যাবো না।
যাবি না মানে ! শিখে যা গর্দভ ! জীবনে কাজে লাগবে।
গাছটাকে কোণাকোণি আড়াল বানিয়ে নিপাট ভালোমানুষের মতো কাছাকাছি যেতেই চাপা ধস্তাধস্তির খশখশ আওয়াজ- অই মাগির পুত, তর বাপেও কি মাইয়া মাইনষের গতর দেহে নাই... !
থমকে গেলাম ! কানের মধ্যে কে যেন গরম সীসা ঢেলে দিয়েছে। দেখি মামা’র বিস্ফারিত গোল গোল চোখ দুটো বেরিয়ে আসতে চাইছে ! হঠাৎ পাগলের মতো আমার হাতটাকে ফের খপ করে ধরে হিড়হিড় করে আমাকে টেনে নিয়ে ছুটলেন রুদ্ধশ্বাসে, গেটের দিকে।

হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন- তুই কি কিছু শুনেছিস ?
হাঁ শুনলাম তো... !
চুপ চুপ ! মূর্খ ! এই বেয়াক্কেলের মতো ঝুলে পড়া কান দুটো দিয়ে যা শোনা যায় তা-ই পারফেক্ট সত্য না ! সত্য হচ্ছে...
মামা’র লেকচার তুবড়ি ছুটানোর আগেই এগিয়ে আসা টাউনবাসটার দিকে ছুটলাম আমি- মামা তুমি পরে আসো, আমি গেলাম।
সুবর্ণার সাথে প্রোগ্রামের টাইম ছাড়িয়ে ঘড়ির লম্বা কাটাটা আগে আগে ছুটছে তখন...!
Image: 'Syndafall' by Michelangelo.
(১৪/০৫/২০০৯)

[sachalayatan]

# যৌন হয়রানি : অচেনা নারীকে ‘সুন্দরী’ বলা থেকে সাবধান !


যৌন হয়রানি : অচেনা নারীকে ‘সুন্দরী’ বলা থেকে সাবধান !
রণদীপম বসু

যৌন হয়রানি রোধে এক যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রে এবং রাস্তাঘাটে নারী ও শিশুদের যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন রোধে সরকারের কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় সরকারকে একটি সাধারণ নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ দিয়ে গত ১৪ মে, ২০০৯ তারিখ এ রায় দেয়া হয়। রায়ে বলা হয়েছে, এ সংক্রান্ত আইন পাস না হওয়া পর্যন্ত সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্টের দেয়া দিকনির্দেশনামূলক এই নীতিমালা বাধ্যতামূলকভাবে মেনে চলতে হবে। আর সরকারি নীতিমালা না হওয়া পর্যন্ত রায়টি অনুসরণের জন্য আদালত থেকে কয়েকটি দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ দীর্ঘ শুনানি শেষে ১৪ মে, ২০০৯ তারিখ বৃহষ্পতিরার এ রায় দেন। (সূত্র: সমকাল, ১৫মে,২০০৯)

কর্মস্থলে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারী ও শিশুদের যৌন হয়রানি বন্ধে দিক নির্দেশনা চেয়ে জনস্বার্থে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির পক্ষে সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী ২০০৮ সালের ৭ আগস্ট একটি রিট আবেদন দায়ের করেন। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি শেষে এ রায়ে শারীরিক-মানসিক যৌন হয়রানিসহ মোবাইল ফোনে এসএমএস, দেয়াললিখন, পর্নোগ্রাফি, যৌন উস্কানিমূলক মন্তব্যসহ মোট ১১ ধরনের কাজকে যৌন নিপীড়নমূলক বলে চিহ্ণিত করা হয়েছে।

এই সংজ্ঞায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সব কর্মক্ষেত্রে সরাসরি যৌন হয়রানি; নারী ও শিশুদের ব্যাপারে কুৎসা রটানো, চরিত্র হননের চেষ্টা, শারীরিক নির্যাতনের চেষ্টা; পথেঘাটে কোন নারীকে অসৎ উদ্দেশ্যে ‘সুন্দরী’ বলা, কুদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা; ই-মেইল, এসএমএস বা টেলিফোনে উত্যক্ত করা; প্রতারণা, ব্ল্যাকমেইল, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও জালিয়াতি; উদ্দেশ্যমূলকভাবে শরীরের বিশেষ অঙ্গে স্পর্শ করা বা শরীরের কোথাও আঘাত করা; রাস্তাঘাট ও পাবলিক প্লেসে উত্যক্ত করা (ইভটিজিং); নারী ও শিশুদের নগ্ন ছবি ও কার্টুন ইত্যাদি আঁকা বা প্রকাশ ও প্রদর্শন করাকে যৌন নিপীড়ন বলে চিহ্ণিত করা হয়েছে।

সরকারকে আদালতের দেয়া দিকনির্দেশনায় বলা হয়েছে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নারী ও শিশুদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধে একটি অভিযোগকেন্দ্র থাকবে। এই অভিযোগকেন্দ্র পরিচালনার জন্য ন্যুনতম পাঁচ সদস্যের কমিটি থাকবে। কমিটির প্রধান হবেন একজন নারী। এ ছাড়া কমিটিতে একাধিক নারী সদস্যও থাকবেন। যারা হয়রানির শিকার হবেন তারা এ কমিটিতে অভিযোগ করবেন। কমিটি কোন অভিযোগ পেলে তদন্ত ও অনুসন্ধান শেষে পুলিশের কাছে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পাঠাবেন। এরপর দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী অপরাধের ধরন ও মাত্রা অনুযায়ী বিচার বিভাগ যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন। নির্যাতন সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া এবং পুলিশের কাছে অভিযুক্তকে সোপর্দ করার আগে নির্যাতিত ও অভিযুক্ত ব্যক্তির কোনো পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না। রায়ে যৌন নিপীড়ন এবং এর শাস্তি সম্পর্কে সর্বস্তরে সচেতনতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়।

এসবের বাস্তবায়ন করতে আইন সচিব, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, শিক্ষা সচিব, শ্রম সচিব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, ইউসিজি, বিকেএমইএ, বিজিএমইএ, বার কাউন্সিল, পুলিশ ও তথ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেয়া হয়।

মামলাটি পরিচালনা করেন জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম ফিরোজ ও অ্যাডভোকেট সীমা জহুর। অন্যদিকে সরকার পক্ষে ছিলেন ডেপুটি এটর্নি জেনারেল রাজিব আল জলিল।

আসুন এ যুগান্তকারী দিকনির্দেশনাকে আইন হিসেবে যথাযথ শ্রদ্ধা দেখিয়ে নিজেরা মেনে চলি এবং অন্যকেও উদ্বুদ্ধ করি।
Image: Bangladesh Supreme Court, by Tanzirian (from SkyscraparPageForum)

[sachalayatan]

Monday, May 11, 2009

# [অনুগল্প] --- ভৃঙ্গু কোবরেজ!


ভৃঙ্গু কোবরেজ
রণদীপম বসু

ধারণা করা হয ভৃঙ্গু কোবরেজের নামটা তাঁর পিতৃ-প্রদত্ত নাম নয়। তবুও এই নামটাই তাঁর আদিনাম ছাপিয়ে কী করে যে দশ গ্রাম পেরিয়ে বহু দূর দেশেও খ্যাতি পেয়ে গেলো, এর কোষ্ঠি বিচার করার বয়েসী কেউ আর জীবিত নেই এখন। কিংবা আদৌ তাঁর কোন আদিনাম ছিলো কিনা সেটাও কোবরেজের নির্বিকার ঘোলা চোখ পাঠ করে কোন সুরাহা মেলে না। তাই সবক্ষেত্রে যা হয়, ক্লু হারিয়ে নাম নিয়ে আগ্রহ বা কৌতুহলগুলো তাঁর বয়সটার মতোই বহুকাল আগেই থমকে গেছে।

আর বয়সের কথা বললে, সেই যেবার তাঁর সদ্য বিয়ে করা বড় ছেলেটা অজানা মাড়িতে ভুগে ঘরের খুঁটির সাথে বাঁধা থাকা অবস্থায় মরে গেলো, সেবার মালোপাড়ার দক্ষিণ চাতালে মেয়ে বিয়োতে গিয়ে মরে যাওয়া আবিয়ত্তা মেয়েটার পিতৃপরিচয়হীন সদ্যজাত যে অভাগা মেয়েটাকে ভৃঙ্গু কোবরেজই কোলে করে নিয়ে এসে নিজেই লালন পালন করতে থাকে, কী আশ্চর্য, সেই মেয়েটাই লকলকিয়ে বেড়ে ওঠে কবে থেকে যে বছর বছর মরা বাচ্চা প্রসব করে যাচ্ছে, অথচ কোবরেজের কাচাপাকা চুলগুলো ঠিক সেরকমই রয়ে গেছে আজো ! কেউ বলে কোবরেজের অপ্রকৃতিস্থ ছোট ছেলেটা, যে নাকি মাঝে মাঝেই কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গিয়ে আবার ফিরেও আসে, তার সাথেই মেয়েটার বিয়ে হয়েছিলো, কেউ বলে হয় নি। তবে এ নিয়ে গ্রামের কাউকেই খুব একটা মাথা ঘামাতে দেখা যায় না।

গ্রামের একপাশে নির্বিবাদে পড়ে থাকা কোবরেজের আদিবাস নিয়েও কেমন একটা ঘোরপ্যাঁচ রহস্য রয়ে গেছে। কবে কোন্কালে কিভাবে কোবরেজি চিকিৎসায় দত্তবাড়ির কাকে সারিয়ে তোলার সৌজন্যে দানস্বত্বে পাওয়া একটুকরো জংলা জমিতে ছোট্ট একটা ঘর তুলে বসবাসের পত্তন করে পসার জমিয়ে তুলেছিলো, সেকালের সাক্ষী কেউ বেঁচে থাকলে হয়তো তা জানা যেতো। সাথে এটাও জানা যেতো, যে বউটি যুবতীকালে দুটো বাচ্চা বিইয়ে রেখে একদিন কোথায় হারিয়ে গেলো, তাকে কি কোবরেজ সত্যি সত্যি বিয়ে করে এনেছিলো, না কি ভাগিয়ে এনেছিলো ?

পরতে পরতে এমন রহস্য জমে থাকাটা চিকিৎসা পসারের ক্ষেত্রে অনুকূল হবে নিশ্চয়ই। নইলে কালেভদ্রে দুয়েকটা অসমর্থিত খবরের বাইরে কোথাও কোনো আরোগ্য সংবাদ পাওয়া না গেলেও ধন্বন্তরি তাবিজের খোঁজে এই অজপাড়াগাঁয়ে দূরাগত রোগীদের পুরনো কাৎড়ানো শুনা যাবে কেন ! বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, মরে যাবার আগেও মৃত্যুপথযাত্রী এই সব রোগীরা তাবিজের অলৌকিক গুণে এতটুকু অবিশ্বাস বা অশ্রদ্ধা তো দেখায়ই না, বরং কুদরতি তাবিজের শর্ত না মানার দোষে নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করতে করতেই এরা পরপারের মিছিলে দিব্যি সামিল হয়ে যায় ! এইসব গরম খবর কিছুদিন পরই ঠাণ্ডা হয়ে চাপাও পড়ে যায় দ্রুত।

কেউ কেউ বলেন, ভৃঙ্গু কোবরেজের মতো তাঁর তেলেসমাতি তাবিজের কার্যপ্রণালী বুঝি আরো বেশি রহস্যাবৃত। তা জানতে হলে প্রকৃতই জটিল কোন রোগী হয়ে তাঁর কাছে হন্যি দেয়া ছাড়া অন্য কোন পথ খোলা আছে কিনা জানা নেই। কেননা কাক-পক্ষিরও অগোচরে রাখা তাবিজের অবশ্য পালনীয় গুপ্ত শর্তটি শেষপর্যন্ত রোগীর সাথেই স্বর্গ কিংবা জান্নাতবাসী হয়ে গেলে ইহলোক থেকে সংযোগরক্ষার প্রচেষ্টায় কাউকে আর আগ্রহী হতে দেখা যায় না। আর নিতান্তই আরোগ্যবাসী কোন রোগী আরোগ্যকালের দীর্ঘস্থায়ীত্বের জন্য মরে গেলেও গুপ্তকথা ফাঁস না করার শর্ত ভেঙে ঝুঁকি নেবার নজির স্থাপন করেছে এমনটাও এযাবৎ দেখা যায় নি।

তবু কিছু কিছু কাহিনী যেভাবে নিজস্ব শক্তিমত্তা বা কৌতুকের উৎস হয়ে আকাশে বাতাসে কিছুকাল ছড়িয়ে থাকে, তা কি কারো কৌতুহলসৃষ্ট গুজব, না কি লিক হয়ে বেরিয়ে আসা কোন গুপ্তকথা, এর সত্যাসত্য নির্ণয় করার উপায় কারোরই থাকে না। কেননা পড়শিগঞ্জের বিদেহী রোগীটি সব কূল সেরে শেষচেষ্টা হিসেবে প্রথম যেদিন ভৃঙ্গু কোবরেজের ডেরায় এসে হামলে পড়েছিলো, কোবরেজ তাকে সত্যি সত্যি সর্বোচ্চ হাদিয়ার বিনিময়ে এক হপ্তায় সম্পূর্ণ আরোগ্য হবার একশতভাগ গ্যারান্টিসহ সর্বরোগহরা তেলেসমাতি তাবিজটি হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলো দ্রুত। শর্ত অনুযায়ী অক্ষরে অক্ষরে প্রতি প্রত্যুষ আর প্রদোষের ব্রাহ্মমুহূর্তে কাঁসার গেলাসে তাবিজের তিনচুবা পানি একনিঃশ্বাসে পান করে গেছে ঠিকই। কিন্তু তাগুদে পানি পান করার সময় কিছুতেই কোন ইতর বানরের কথা মনে না আনার পুনঃপুন সতর্কবাণী নিজের দোষেই চাপা পড়ে গেলো গেলাস হাতে নিয়েই। চোখের সামনে শুধু বানর আর বানরের ছবিই ভাসতে থাকলো। কিছুক্ষণ চুল ছিঁড়ে, কিছুক্ষণ নিজের বাপান্ত শাপান্ত করতে করতে রোগী বাবাজী দ্বিতীয়বার কোবরেজ পর্যন্ত আর পৌঁছতে পারলো না। পথেই মরে রইলো। এ খবর আস্তানায় এসে পৌঁছালে তাবিজের এমন জীবন্ত ক্ষমতার প্রমাণ হাতেনাতে পেয়ে তাবিজের প্রতি অপেক্ষমান রোগীদের আস্থা আরো বহুগুণ বেড়ে গেলো।

এসব তো বহু আগেকার কথা ! তাবিজের জীবন্ত তেজ তো চোখের সামনেই অনেকে দেখেছে ! এক্কেবারে নিজের ঘরে হলে কী হবে, তাবিজ অমান্য করায় কোবরেজের বড় ছেলেটি রাতের খাবারটাও শেষ করতে পারলো না, মাথা ঘুরে পড়ে আবোল-তাবোল বকতে লাগলো। এক্কেবারে উন্মাদ দশায় খুঁটির সাথে বেঁধে রেখেও শেষপর্যন্ত সারানো গেলো না। ভাগ্যিস কোবরেজ তাঁর গুণীন মন্ত্র দিয়ে ঠিকই ধরে ফেলেছিলো, বৌ’টি যে ভয়ঙ্কর একটা উপরি আছর নিয়ে কোবরেজ বাড়িতে ঢুকেছিলো। যে কিনা দেশগ্রামে অন্যের আলগা-আছড় আর কু-প্রভাব সারিয়ে বেড়ায়, তার ঘরেই হানা ! সাংঘাতিক ব্যাপার ! এটা যে গোটা গ্রামের জন্যই ঘোর অমঙ্গল !

অতঃপর রাত-বিরেতে বৌটির আর্ত চিৎকারে আশেপাশের সবাই আশ্বস্ত হতে শুরু করলো যে, কোবরেজের গুণীন শক্তির কাছে অপশক্তিটি ধীরে ধীরে নিরস্ত হচ্ছে। দিনের পর দিন এই অতিলৌকিক শক্তি-লড়াই শেষে কু-আছরটিকে গ্রামছাড়া করা হলো ঠিকই, তবে যাবার আগে সে কোবরেজের বড় ক্ষতিটি করে গেলো। ভোর রাতে দেখা গেলো বৌটি পেছনের গাব গাছে ঝুলে আছে অনেকটা উদোম হয়ে। গাঁয়ের লোক ভেঙে পড়লো কোবরেজ বাড়িতে। অবাক বিস্ময়ে সবাই দেখলো, অপশক্তির আছর কিভাবে একটি তন্বী নারীর নরম শরীর নির্বিচার ফালাফালা করে দিয়ে যায় ! মেয়ের মতো লক্ষ্মী বৌটির এহেন দুর্দশায় বিমর্ষ কোবরেজের মুখে বহুদিন স্থিরতা দেখেনি কেউ। পালিত কন্যাটি সেবা শুশ্রূষা করার মতো ডাঙর হয়ে ওঠলে বহুদিন পর কোবরেজের মুখে হাসি ফিরে আসে।

অচিনপুর গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবনে এসব ঘটনার ঢেউ মাঝে মাঝে একঘেয়েমীর পাথরটাকে একটু আধটু নাড়া দিয়ে যায় বলেই জীবনটা এখনো বহমান তাদের কাছে। একেকটি ঘটনার লবণ তাদের পানসে জিহ্বায় অনেকদিন ধরে যে নোনা স্বাদটুকু ধরে রাখে তার একমাত্র উৎস ওই কোবরেজ বাড়িটাতে আবার একদিন গ্রামের লোক ভেঙে পড়লো। বহু রহস্যের জন্মদাতা ভৃঙ্গু কোবরেজই এবার আজব এক অচেনা রোগের শিকার !

সেই যে পিতৃপরিচয়হীন পালিত কন্যাটি, যে কিনা ফি বছর মৃত সন্তান বিয়ানোতে কখনোই ক্ষান্ত দেয়নি, কখন যে কোবরেজের সমস্ত গুণীনবিদ্যা আয়ত্ত করে নিয়েছে কেউ খেয়ালও করে নি ! খুঁটির সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা ভাঙাচোরা চেহারার ভৃঙ্গু কোবরেজকে অচেনা অপশক্তিটি যে সত্যি সত্যি কাবু করে ফেলেছে, তা তাঁর ঝুলে পড়া চেহারা দেখেই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। পাশেই চেলাকাঠ হাতে দাঁড়ানো কোবরেজের অপ্রকৃতিস্থ ছোট ছেলেটি কার চিকিৎসায় হঠাৎ সুস্থ হয়ে ওঠেছে তা নিশ্চিৎ হওয়া না গেলেও ভৃঙ্গু কোবরেজকে সারিয়ে তোলার সর্বাত্মক চেষ্টায় মেয়েটির কোন খামতি দেখা গেলো না।
তাঁর মুখের কাছে পানি ভর্তি গেলাসটি ঠেলে দিয়ে চিৎকার করে বলছে সে- বল্, এই তাবিজের পানি খাবার সময় কার চেহারা মনে আনা যাবে না, বল ?
বজ্রপাতের তীব্রতায় ঝলসে যাওয়া বৃক্ষের ভেঙে পড়া শব্দের মতো কোবরেজের কণ্ঠ ভেঙে মড়মড় আওয়াজ বেরিয়ে এলো- ‘...মেয়েমানুষের চেহারা !’
(১০/০৫/২০০৯)
Image: 'apilogue' from internet.

[sachalayatan]
[khabor.com]
[mukto-mona]
[sa7rong]

Saturday, May 2, 2009

# যুক্তরাষ্ট্র : যে দেশে 'মে দিবস' উপেক্ষিত !


যুক্তরাষ্ট্র : যে দেশে 'মে দিবস' উপেক্ষিত !
রণদীপম বসু

১৮৮৬ সালে শিকাগোর হে মার্কেটে দৈনিক শ্রমঘণ্টা কমিয়ে দিনে আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে বিক্ষুব্ধ মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত শ্রমিকদের আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে বিশ্বব্যাপি পহেলা মে’র দিনটিকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে বেছে নেয়া হয়।


জাতিসংঘও এ দিনটিকে অনুমোদন করে। শ্রদ্ধাজ্ঞাপনকারী প্রায় সব রাষ্ট্রগুলোতে দিনটিকে সরকারিভাবে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ যে দেশে এই মে দিবসের সৃষ্টি, যুক্তরাষ্ট্র, সেখানে শ্রমিকরা একতরফা দিনটিকে পালন করলেও সরকারিভাবে নাকি মে দিবস পালিত হয় না ! ওখানে যে দিনটিকে লেবার ডে হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয় তা হচ্ছে পহেলা সেপ্টেম্বর। মজার ব্যাপার, সেপ্টেম্বরের প্রথম দিনটি হচ্ছে গ্রীষ্মকালকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানানোর দিন। এ দিনটিকে আবার শ্রমিক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সবাই একত্রে পালন করে থাকে।


১৮৮৬ সালে হে মার্কেটের এই ঘটনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ধনিক শ্রেণীর পক্ষ হতে শ্রমিকদেরকেই বেশি দায়ী করা হয়। শ্রমিক সমাবেশ থেকে পুলিশের ওপর নিক্ষিপ্ত বোমায় একজন পুলিশ মারা যায়। এবং এ কারণেই পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলি চালাতে বাধ্য হয় বলে দাবী করা হয়। পুলিশের গুলিতে অনেক শ্রমিক হতাহত হলেও মেথিয়াস জে ডিগান নামের নিহত সেই পুলিশের স্মরণে ১৮৮৯ সালে হে মার্কেট স্কোয়ারে একটি মনুমেন্ট নির্মাণ করা হয়। সেদিন অর্ধশতাধিক পুলিশ আহত হয় এবং এ ঘটনাকে পুলিশের নথিতে দাঙ্গা হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়।


ডিগানকে খুন করার জন্য যে বিচারের আয়োজন করা হয়, সেই বিচারে সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলে বিশ্বব্যাপি শ্রমিক জনগণ মিছিল-সমাবেশের মাধ্যমে এর প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পরে তিনজনের মৃত্যুদণ্ড রহিত করা হলেও বাকি চারজন স্পাইস, পারসন্স, ফিশার ও এঞ্জেল'কে ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ফাঁসির রজ্জু গলায় পরার সময় এই সাহসী বীরেরা আন্তর্জাতিক বিপ্লবী সঙ্গীত গাইতে থাকেন।


শিকাগোর ফরেস্ট পার্কে জার্মান ওয়াল্ডহেইম কবরস্থানে যেখানে তাঁদেরকে সমাহিত করা হয়, ১৮৯৩ সালে সেখানে তাঁদের স্মরণে একটি মনুমেন্ট নির্মাণ করা হয়। আর একশ’ বছর পরে এসে ভাস্কর আলবার্ট ওয়েইনার্ট নির্মিত এই মনুমেন্টকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ন্যাশনাল হিস্টরিক ল্যান্ডমার্ক হিসেবে ঘোষণা করে।
এখন তাহলে প্রশ্নটা থেকেই যায়, মে দিবসের কী হবে ?
(more picture)

[sachalayatan]

Friday, May 1, 2009

# পুষ্প তোমার নাম কী। ০১। কদম্ব


পুষ্প তোমার নাম কী। ০১। কদম্ব
রণদীপম বসু

রাগ করেছি ঠিক করেছি
মুখ ফুলিয়ে সই,
তাই বলে তো কারো সাথেই
করছি না হৈ চৈ !

করছি না তো ঝগড়া-ফ্যাসাদ
করছি না দম্ভ,
জিদ তো হবেই- বলবে কেন
মুখটা কদম্ব !

কদম্ব পরিচিতি:


কদমকে বর্ষার দূত বলা হয়। ‘সখী, ঐ শুনো কদম্বতলে বংশী বাজায় কে’ (উত্তরবঙ্গের লোকগীতি)। বৈষ্ণব সাহিত্য থেকে লোকগাথা, পল্লীগীতি, রবীন্দ্র-কাব্য সহ গোটা বাংলা সাহিত্যে বহুল উপমায় প্রশস্তিতে ভরে আছে কদমের গুণগাথা।

বৈজ্ঞানিক নাম: অ্যানথোসেপেল্যস চায়নেনসিস (Anthocephalus chinensis), যার সঠিক বঙ্গানুবাদে অর্থ দাঁড়ায় মস্তকাকৃতি ফুল। ফ্যামিলি বা গোত্র: রুবিয়্যাসি (Rubiaceae)।

পুষ্প: একটি পূর্ণ মঞ্জরিকে সাধারণত একটি ফুল বলে মনে হয়। পূর্ণ মঞ্জরিটি দেখতে বলের মতো গোল, মাংসল পুষ্পাধারে অজস্র সরু সরু ফুলের বিকীর্ণ বিন্যাস থাকে। পূর্ণ প্রস্ফুটিত মঞ্জরির রং সাদা-হলুদে মেশানো। প্রতিটি ফুল খুবই ছোট, বৃতি সাদা, দল হলুদ, পরাগচক্র সাদা এবং বহির্মুখীন, গর্ভদণ্ড দীর্ঘ। বৃন্ত ১-২ ইঞ্চি দীর্ঘ। মঞ্জরি একক, গোল, দেড় থেকে দু’ইঞ্চি প্রশস্ত। মঞ্জরি দণ্ড এক থেকে দেড় ইঞ্চি।

ফল: গোল, হলুদ, মাংসল এবং দুই থেকে আড়াই ইঞ্চি চওড়া। টক স্বাদ। বাদুড় ও কাঠবিড়ালীর প্রিয় খাদ্য, ওরাই বীজ ছড়ানোর বাহন।


বৃক্ষ: কদম দীর্ঘাকৃতি, বহুশাখী, পত্রমোচী বৃক্ষ। কদমের কাণ্ড সরল, উন্নত, ধূসর থেকে প্রায় কালো এবং বহু ফাটলে রুক্ষ, কর্কশ। শাখা অজস্র এবং মাটির সমান্তরালে প্রসারিত। পাতা বড়, লম্বায় ৫ থেকে ৯ ইঞ্চি, চওড়া ৩ থেকে ৭ ইঞ্চি। ডিম্বাকৃতি কিংবা লম্ব-ডিম্বাকৃতি, চার্ম, উপরিভাগ তেল-চকচকে মসৃণ, বিন্যাসে বিপ্রতীপ, পৃষ্ঠ রোমশ, উজ্জ্বল সবুজ। উপপত্রিকা অত্যন্ত স্বল্পস্থায়ী বিধায় পরিণত পাতা অনুপপত্রিক। বোঁটা খুবই ছোট। অল্পবয়স্ক গাছের পাতা বৃহত্তর।

সতর্কতা: নিষ্পাপ শিশুদের মুখকে কখনোই কদম্বের সাথে তুলনা করা চলবে না। তাহলে ঠিক ঠিকই মুখটাকে কদম্বের মতোই বানিয়ে ফেলতে পারে। যা সঠিকমাত্রায় পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা বহুত শ্রমসাধ্য হয়ে ওঠবে। হা হা হা !

তথ্যসূত্র: শ্যামলী নিসর্গ/ দ্বিজেন শর্মা/ প্রকাশক- বাংলা একাডেমী/ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭ সংস্করণ।
(০১/০৫/২০০৯)

[sachalayatan]