Friday, February 27, 2009
# অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০০৯ এবং ক্ষীণদৃষ্টি পণ্ডিতজনের চশমাগুলো...
অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০০৯ এবং ক্ষীণদৃষ্টি পণ্ডিতজনের চশমাগুলো...
রণদীপম বসু
বাংলাদেশে গোটা বছর যে পরিমাণ গ্রন্থ প্রকাশিত হয় তার সিংহভাগ হয়ে থাকে ফেব্রুয়ারিতে। কেন হয় তা সবাই মোটামুটি অবগত। এরই মধ্যে ফেব্রুয়ারি শেষ হয়ে এলো। বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে চলমান এবারের একুশে বইমেলায় যাঁরা ইতোমধ্যেই এক বা একাধিকবার ঘুরে এসেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই একাডেমীর অন্যতম কৌতুহলী জায়গাটাকেও চিনতে ভুল করেন নি। ‘নজরুল মঞ্চ’।
লেখক প্রকাশক পাঠক ও আগ্রহী মানুষের ভীড়ে এই মঞ্চটা এবার প্রতিদিনই সরগরম থেকেছে শতশত বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের সরবতায়। চেনা-অচেনা খ্যাত-অখ্যাত তারকা-অতারকা কতো রকম মানুষের আনাগোনায় আন্দোলিত হয়েছে এবং হচ্ছে এই মঞ্চটা। বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ এ জন্যেই এ জায়গাটাকে নির্ধারিত করে দিয়েছেন। আর এই নির্ধারণসূত্র অনুযায়ী তাঁরা বিলবোর্ডের মতো বিশাল পর্দাও টাঙ্গিয়ে রেখেছেন মোড়ক উন্মোচনের জায়গা হিসেবে। সবাই হয়তো খেয়াল করেছেন জাতিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আবক্ষ ভাস্কর্য মূর্তিটির দুপাশে দুটো বড় পর্দায় বিরাট অক্ষরে লেখাগুলো- ‘..নতুন বইয়ের মোড়ক উম্মোচন’ ! লেখাটা পড়ে কি কোন সন্দেহ দেখা দিচ্ছে ?
আমি হয়তোবা একজন সাধারণ পাঠক। আমার মতো সাধারণের বাইরে অন্য যেকোন জায়গার তুলনায় আমি নিশ্চিত যে এই বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণেই দেশের জ্ঞানী গুণী বিজ্ঞ অভিজ্ঞ প্রাজ্ঞ পণ্ডিতজনদের আগমন সবচাইতে বেশি মাত্রায় ঘটেছে। কিন্তু যা ঘটেনি তা হয়তো আমাদের অহঙ্কারমুখ ক্ষীণদৃষ্টি পণ্ডিতজনের চশমাগুলো সাথে নেয়া...। নইলে গোটা একটা মাসেও কারো চোখে পড়লো না এমন মারাত্মক একটা ঘটনা, যা নাকি প্রতিদিনই ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে মুহূর্তেই তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েও যাচ্ছে সচিত্র সরবতা নিয়ে !
বাংলা একাডেমীর ইতিহাস আমাদের গর্বের ইতিহাস। এর ঐতিহ্য আমাদের অহঙ্কার। স্বেচ্ছাচারিতা রোধকল্পে বাংলা বানানের ক্ষেত্রে ঐক্য সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের একটি নিয়ম প্রণয়ন করে। পরবর্তীতে বাংলা একাডেমীর অভিধানসমূহ ঐ বানান রীতিই অনুসরণ করে। প্রথম প্রথম এ নিয়ে যথেষ্ট মতপার্থক্য দেখা গেলেও পর্যায়ক্রমে তা মিইয়ে আসে এবং বাংলা ভাষা ব্যবহার ও চর্চা করেন যাঁরা, বাংলা একাডেমীই যেহেতু রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারক হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত প্রতিষ্ঠান, তাই সবাই এই নিয়মকেই যথাযথ মান্য করায় ব্রতী হন। বাংলা ভাষায় একটি আদর্শ অভিধান প্রণয়নই ছিলো জন্মলগ্ন থেকে বাংলা একাডেমীর প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প।
আনুপূর্বিক ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে, বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠার পরপরই “পূর্ব পাকিস্তানী ভাষার আদর্শ অভিধান” নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, যে প্রকল্পের অধীনে আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, ব্যবহারিক বাংলা অভিধান ও বাংলা সাহিত্যকোষ নামে তিন খণ্ড অভিধান প্রণয়নের পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল। ঐ পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ নামক প্রথম খণ্ডের কাজ শুরু হয় ১৯৫৮ সালে এবং ১৯৬৪ সালে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সম্পাদনায় তা প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে ব্যবহারিক অভিধান নামক দ্বিতীয় খণ্ডের কাজ ১৯৬১ সালে শুরু হলেও এর স্বরবর্ণ অংশ ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের সম্পাদনায় ১৯৭৪ সালে এবং অধ্যাপক শিবপ্রসন্ন লাহিড়ীর সম্পাদনায় ব্যঞ্জনবর্ণ অংশ ১৯৮৪ সালে প্রকাশ পায়। প্রথম প্রকাশের সময় এর নাম ছিল ‘বাংলাদেশের ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’। ১৯৯২ সালে ‘দ্বিতীয় সংস্করণ’ নামে পুনর্মুদ্রন করার সময়ে অভিধানটির নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ রাখা হয়। পরবর্তিতে একই নামে এরই পরিমার্জিত সংস্করণটি প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে।
এই পরিমার্জিত সংস্করণের ভূমিকাতে সংক্ষেপে বিধৃত বাংলা একাডেমীর এই অভিধান প্রকল্পের ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে, সৈয়দ আলী আহসান, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, মুনীর চৌধুরী, অজিত কুমার গুহ, আহমদ শরীফ, মুহম্মদ আবদুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ আবদুল কাইউম, তারাপদ ভট্টাচার্য, গোলাম সামদানী কোরায়শী, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত প্রমুখের মতো তখন ও এখনকার বাংলা ভাষার প্রায় সব প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ ও পণ্ডিতজন প্রকল্পটির সাথে শুরু থেকেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং এখনও আছেন। কালে কালে প্রকল্পটি এতোই আকর্ষণীয় ও সর্বজনস্বীকৃত হয়ে উঠে যে, এখনও বাংলা ভাষা-ভাষিদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু থেকে এই অভিধান বিষয়ক কৌতুহল একবিন্দুও কমে নি বলেই ধারণা। আর তাই একুশে বইমেলায় বাংলা একাডেমীর নিজস্ব স্থায়ী বিক্রয়কেন্দ্রটির প্রতি সবশ্রেণীর পাঠক-ক্রেতার একটা বিশেষ আগ্রহ সবসময়ই লক্ষ্য করা যায়। প্রতি মেলাতেই ওখানে হুমড়ি খাওয়া ভীড়ের উপস্থিতিকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি এবং বিষয়ভিত্তিক গবেষণামূলক প্রকল্প হিসেবে বিভিন্ন প্রকাশনাগুলো পাঠকের হাতে সাশ্রয়ী মূল্যে তুলে দেয়ার বিষয়টাকে (৩০% এবং ৫০% মূল্যহ্রাসের আকর্ষণীয় সুবিধা পাওয়া) কেউ কেউ প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্ণিত করতে পারেন হয়তো। তবে প্রতি মেলাতেই দ্রুত অভিধান স্টক ফুরিয়ে যাওয়ার বিষয়টাও উল্লেখযোগ্য নয় কি ?
এবারের মেলাতেও, যাকে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০০৯’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে, পাঠক ক্রেতাদের বিপুল আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে বাংলা একাডেমীর বানান অভিধানটির দিকে। এ অভিধানটিও উল্টেপাল্টে দেখার চেষ্টা করলাম, ‘উম্মোচন’ নামের কোন বাংলা শব্দ আমাদের কোন শব্দ-পরিভাষায় রয়েছে কিনা। অথবা বাংলা একাডেমীর স্বসৃষ্ট শব্দ কিনা। কিন্তু কোথাও তা পেলাম না কেবল ওই নজরুল মঞ্চে টাঙ্গানো বোর্ডটি ছাড়া। একাডেমী কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোন ব্যাখ্যা বা বিবৃতি দিয়েছেন বলেও জানা নেই। মায়ের ভাষা রক্ষায় অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেয়া ভাষা শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ যখন অন্যকে প্রমিত বানান ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার গুরুদায়িত্ব নিয়েছেন, তাঁদেরকে শুদ্ধ বানান ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার দায়িত্ব কারা নেবেন তা জানার অধিকার কি আমাদের আছে ? নিজেদের আঙ্গিনায় নিজেদের দায়িত্বে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এমন সংবেদনশীল একটা স্থানে এরকম দায়িত্বহীন ভুলকে সারাবিশ্বে প্রতিফলিত করে জাতির জন্য যে লজ্জার আরেকটি উপাদান তাঁরা যুক্ত করলেন এর দায়-দায়িত্ব কি কারোরই নেই ? কেউ কি একবারও অবহিত করলো না তাঁদেরকে ! অথবা কোন্ অজ্ঞাত কারণে এটাকে অবজ্ঞা করা হলো এর জবাবদিহি করার কেউ কি এখন আর বর্তমান নেই ?
অন্য কোথাও থাকে কিনা জানা নেই, তবে ভুত যে আসলে সর্ষেতেই থাকে তা বোধ করি অসত্য নয় !
[আরো ছবি এখানে এবং এইখানে]
[sachalayatan]
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment