Friday, August 28, 2009

# টান নেই আঁচড় নেই শুধুই বিষাদ - ০৩ (কবিতাগুচ্ছ)


টান নেই আঁচড় নেই শুধুই বিষাদ - ০৩ (কবিতাগুচ্ছ)
-রণদীপম বসু


দেউটিতে বসে নেই কেউ
রণদীপম বসু

দেউটিতে বসে নেই কেউ, বসবেও না আর।
নির্জলা আকাশটাকে ভাঁজ করতে করতে করতে করতে
যে নাকি একদিন নিজেই এক হয়ে যেতো খাপখোলা আকাশ
সে এখন জলডুবি হ্রদের স্বচ্ছ অতলে ডুবে মেঘেদের মিতালি পাতায়,
মাছেদের নির্জন সঙ্গমচিহ্ণ খুটে খুটে উরুর জমিনে আঁকে বৃষ্টির ক্ষত।

সংসার উচ্ছন্নে যায়।
দেউটির শূন্যতা ডিঙিয়ে উন্মুক্ত কবাটে লাগে বাতাসের ঢেউ
এক চিমটি আর্দ্রতার সুখ ঘরময় ছোটাছুটি হাহাকার ছড়ায়
বসতে বলে না কেউ, বলবেও না আর
মোমরঙে আঁকাবুকো জ্যোৎস্নার আকাশ
বৃষ্টি নয়, রোদের উষ্ণতায় গলে ছিঁড়েখুড়ে নৈঃশব্দে হারায়।

দেউটিতে বসে নেই কেউ।
হয়তো বসবে এসে কখনো আবার কেউ
ইচ্ছের ভ্রুকুটি-জলে আবার ভাসাবে কেউ নতুন আকাশ
এ খবর রটায় না কেউ, তবু কেউ কেউ জেনে যায়
খিড়কি খুলে উঁকিঝুঁকি দেয়- কখন সঙ্গপ্রিয় পিঁপড়েরা
কুটিকুটি কেটেকুটে সার বেধে নিয়ে যাবে পুরনো আকাশ...!
(২৭-০৮-২০০৯)



আমার দক্ষিণা কই
রণদীপম বসু

মন্ত্র পড়ে অগ্নিরুদ্ধ করলেন তিনি
আগুনের লোলুপ জিহ্বা এ বাড়ি ছোঁবে না আর
ত্রিসীমায় মন্ত্রঃপূত যষ্টির অস্থির গণ্ডি এঁকে জানালেন-
কু-প্রভাব মুক্ত হলো এ বাড়ির প্রতিটা নিঃশ্বাস,
এবার মন্ত্রের দক্ষিণা দাও।

আগুনের হল্লামাখা গুণীনের রুষ্ট চোখে কেউ রাখে না চোখ
কিভাবে জানবে তবে অগ্নিমান মন্ত্রের অমূল্য দক্ষিণা কতো !
নিয়ে যাও ও-গুণীন তোমার যা ইচ্ছে তা-
শুধু রক্ষা চাই মুক্তি চাই বংশের সুখ্যাতি চাই
ভিটের আদরমাখা দুচোখে নিদ্রা চাই
তোমার মন্ত্রের দোহাই শুধু এটুকু ভিক্ষা চাই।

এই নাও জষ্ঠি আমের গাছ, ঘাটলাভরা পুকুরের খলবলে মাছ
ধবলি গাইয়ের বাট যত পারো নাও দুধ, ফসলের হাসিমাখা
ভাড়ারের চাবি আছে, পৈত্রিক সিন্দুক এই, আর কী কী চাও বলো ?
পিতৃপুরুষ সাক্ষী, পুঁথির অক্ষর গুনে যতগুলো মুদ্রা চাও
দিতে পারি তাও, তবু...

কিছুই চাই না তার !
গুণীনের লুব্ধ-চোখে গেঁথে থাকে এ বাড়ির দু’দুটো আকাশ-
‘ও গুণীন, আমার দক্ষিণা কই ?’
(২৭-০৮-২০০৯)



অনেক ঘুমের দেনা
রণদীপম বসু


খেলাপির কৃষ্ণখাতায় সাক্ষরিত নামের বানানে ভুল ছিলো না,
ভুল ছিলো না স্তুপীকৃত বকেয়ার অংকেও-
অনেক ঘুমের দেনা পড়েছিলো তাঁর।

লালঘুম নীলঘুম চিকন সবুজ ঘুম
কতোশতো নাম আর রঙের বাহারে মোড়া
কলাপাতা চোখে চাওয়া কিশোরী কিশোরী ঘুম
কুয়াশার ঝাঁপ খুলে হঠাৎ বেরিয়ে আসা সতেজ তরুণীঘুম
হুক-খোলা যৌবনা দুধারে প্লাবন-ডাকা সর্বনাশা ঘুম
জলঘুম চিনিঘুম উতলা-বেহুশ ঘুম তিক্তবিরক্তঘুম
বিগত স্মৃতির ভারে ন্যুব্জদেহ ভগ্ন-ধুসর ঘুম
এতোসব ঘুমের পাথর কেটে সময়ের ছেনি-কোপে
কিসের আদল খোঁজে একবুক নির্ঘুম চোখের আকাশ ?

একজোড়া হাতের অন্বিষ্ট পারে মুছে দিতে লক্ষকোটি চোখের শিশির
বিশ্বস্ত পাঁজরে ঘেরা এক বুক উদ্ভ্রান্তি মুহূর্তেই ছুঁতে পারে ডানার সাহস
যতই দীর্ঘ হোক এক জোড়া পায়ের অঢেল স্রোত
অনায়াসে গুনে যায় অসংখ্য গুণকে বাঁধা গ্রন্থিময় পথের নিঃশ্বাস
কটিবন্ধে ঝুলে থাকা অনড় প্রতিজ্ঞা পারে ভেঙে দিতে প্রচল বন্ধন সব
একটি আকাশমুখ নাক কান চোখ গাল চিবুক কপালের ভাঁজে
আশার অমিত মুখে গেঁথে রাখে জীবনের সংগুপ্ত মন্ত্রের স্বর-
আজন্ম ঘুমের পাথর কেটে
কেটে কেটে যে আদল গড়তে গড়তে সে জমিয়েছে ঘুমের দেনার স্তুপ
তা কি আর অপরিশোধ্য হয় ? বাড়ন্ত ও অবহ দেনার ভারে
শেষমেশ পাথরই বন্দী হয় পাথরের হাতে !

রয়ে গেলো অঙ্কুরের অসমাপ্ত মুখ-
একদিন কালঘুম ডাক দিলো তাঁকে।
(৩১-০৮-২০০৯)
[sachalayatan]



ঘুম তুই যাবি যা...
রণদীপম বসু

চৈতের ঘুমগুলো হঠাৎ অনার্য হাওয়ায় উড়ে যায়
ছিটেফোটা খড়কুটো সজোরে জাপটে ধরে পড়ে থাকি-
ঘুম তুই যাবি যা, যেখানে সেখানে খুশি যা...

আমি তো উড়বো না কখনোই, কোথাও পারবি না নিতে
বনলতা না-ই থাক, আমার তন্দ্রিতা আছে
ভুল হাতে ভুল কালে তাকেই টংকার দেবো,
শূন্য খোড়লে জেগে একটাই তো জন্মের ফারাক
ইনিয়ে বিনিয়ে দেখিস কাটিয়ে দেবোই ঠিক

ঘুম তুই যাবি যা, যেখানে সেখানে খুশি যা...
যাবিই তো ! শেষমেশ তুইও নির্ঘুম হলি...!
(২১-০৯-২০০৯)

Thursday, August 20, 2009

| প্রফেসর ইউনূস ও অমর্ত্য সেন, ভিন্ন স্রোতেও এক অভিন্ন মুখ !


প্রফেসর ইউনূস ও অমর্ত্য সেন, ভিন্ন স্রোতেও এক অভিন্ন মুখ !
-রণদীপম বসু


দু’জনকে দুই মেরুর অর্থনীতিবিদ বলা হয়। কেন বলা হয় তা বুঝি না আমি। অর্থনীতি আমার পঠিত বিষয় নয়, কিংবা এ বিষয়ে খুব একটা জানিও না। যেটুকু জানি, দুজনই বাঙালি, অর্থনীতির ছাত্র ও অধ্যাপক এবং নোবেল লরিয়েটও। অমর্ত্য সেন (Amartya Sen), একজন তাত্ত্বিক অর্থনীতিবিদ, যাঁকে কল্যাণমূলক অর্থনীতির প্রবক্তা বলা হয়। তিনি তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, দুর্ভিক্ষের সাথে উৎপাদনের সম্পর্ক ক্ষীণ, বরং খাদ্যের অসম বণ্টন ও ক্রয় ক্ষমতা বা খাদ্য সংগ্রহের বিপর্যয়ই দুর্ভিক্ষের মূল কারণ। বিশ্বের যেসব দেশ বিভিন্ন সময়ে যে বছর দুর্ভিক্ষে পতিত হয়েছিলো, তিনি দেখিয়েছেন, বিস্ময়করভাবে সেই বছর সেই দেশটিতে খাদ্যের বাম্পার ফলনের রেকর্ড রয়েছে অর্থাৎ গড় উৎপাদনের চাইতে ফলন বেশি ছিলো। আরো অনেক অনেক বিষয়ই ছিলো, যা এ বিষয়ে বিজ্ঞজনরাই ভালো বলতে পারবেন। অর্থনীতির তাত্ত্বিক দুনিয়ায় অনন্য অবদানের জন্য অমর্ত্য সেনকে ১৯৯৮ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।

অন্যদিকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে (Muhammad Yunus) প্রাযোগিক অর্থনীতিতে ক্ষুদ্রঋণ তত্ত্বের জনক বলা হয়, যার ইংরেজী পরিভাষা মাইক্রো-ক্রেডিট নামটাকে পাল্টে বর্তমানে মাইক্রো-ফিনান্স নামেই অভিহিত করা হচ্ছে সর্বত্র। জামানতের বিনিময়ে যাদের কোন প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ নেবার ক্ষমতা বা যোগ্যতা কোনটাই নেই এবং যারা জনগোষ্ঠির ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, তাদের জন্য পেশা বা দক্ষতাভিত্তিক জামানত বিহীন প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ব্যবস্থা করে প্রচলিত ব্যাংকিং ধারণাটাকে উল্টে দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। বলা হয়ে থাকে, দারিদ্র্য থেকে মুক্তিই শান্তির পথে যাত্রা শুরুর প্রথম ও প্রধান নিয়ামক। এই দুঃসহ দারিদ্র্য থেকে মুক্তির অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিশ্বব্যাপি ক্ষুদ্রঋণের কার্যকারিতার সফল স্বীকৃতি স্বরূপ ড. ইউনূস’কে ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। দু’জনই আমাদের গর্ব এবং গোটা মানব জাতির সম্পদ এঁরা। তাঁদেরকে নিয়ে তাই সবার কৌতুহল একটু বেশি থাকাই স্বাভাবিক। আমার কৌতুহলের জায়গাটা একটু ভিন্ন।

যতটুকু জানি ব্যক্তিগত জীবনে দুজনই খুব সাদাসিধে জীবন যাপন করেন এবং উভয়েই একটি করে কন্যা সন্তানের (যারা পরবর্তী জীবনে স্বনামখ্যাত) জনক হয়ে তাঁদের নিজ নিজ প্রথম বিয়ের বিচ্ছেদ ঘটে। এই অদ্ভুত মিলগুলো আমার কৌতুহলের বিষয়বস্তু নয়। দুজনেই খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ এবং মানুষ ও দারিদ্র্য নিয়ে দুজনের চিন্তা ও দর্শন জগৎ নিয়ত ঘুরপাক খায় বলে জানি। অথচ চিরায়ত মানবজাতির কল্যাণকামী এই দু’জন নাকি দুমেরুর স্বীকৃত আর্থ-দর্শনে বিশ্বাসী ! অর্থনীতি বুঝি না বলে এই গেরোটা আর আলগা করা সম্ভব হয় না আমার। অথচ ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, গ্রেট ম্যান থিঙ্কস এলাইক। আমার কৌতুহলটা এই এলাইকনেস বা সাযুজ্যটাকেই খুঁজতে থাকে। সম্প্রতি দুজনেই আবার প্রায় একই সময়ে মিডিয়াতে আলোড়ন তুললেন। প্রফেসর ইউনূস গত ১২ আগষ্ট ২০০৯ তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদক ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’ গলায় পরলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার হাত দিয়ে। আর অমর্ত্য সেন তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ ‘দ্য আইডিয়া অব জাস্টিস’-এর প্রকাশনায় ‘আয় দারিদ্র্য নিরূপণের সঠিক মাপকাঠি নয়’ বলে এক চিন্তা-দর্শন ছড়িয়ে দিলেন। বিষয় সংশ্লিষ্টতা ধরে রাখতে আমরা বরং তাঁদের দুজনের দারিদ্র্য বিষয়ক চিন্তা-দর্শনেই এক পলক দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে পারি।

গত ১৮ আগস্ট ২০০৯ তারিখের অনেকগুলো দৈনিকে অমর্ত্য সেনকে নিয়ে ‘আয় দারিদ্র্য নিরূপণের সঠিক মাপকাঠি নয়’ শিরোনামে একটি খবর কম-বেশি প্রকাশিত হয় পিটিআই অনলাইন নয়াদিল্লির বরাত দিয়ে। খবরটি হলো-


নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার নতুন বইয়ে বলেছেন, বেশিরভাগ সরকার ব্যক্তি বা পরিবারের মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে যেভাবে মানুষের দারিদ্র্য পরিমাপ করে থাকে, তা সামাজিক দৃষ্টিতে কল্যাণের একটি ত্রুটিপূর্ণ ধারণা। অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ অমর্ত্য সেন তার সর্বশেষ বই ‘দ্য আইডিয়া অব জাস্টিস’-এ বলেছেন, দারিদ্র্য নিরূপণের আয়ভিত্তিক পদ্ধতি মানুষ কতটা ভালো জীবনযাপন করে, তা পরিমাপের যথাযথ প্রক্রিয়া নয়। এ পদ্ধতিতে বার্ষিক একটি নির্দিষ্ট পরিমাপ অর্থের কম উপার্জন করে এমন লোকদের দরিদ্র হিসেবে গণ্য করা হয়। এটা সঠিক মাপকাঠি নয়।
অমর্ত্য সেন এ পদ্ধতির পরিবর্তে জীবনযাত্রার এবং জীবনযাত্রা বাছাইয়ের সামর্থ্য বা সক্ষমতাকে অগ্রাধিকার দেন। অমর্ত্য সেন বলেন, পরিবারের ভেতর আয় বণ্টনে তারতম্যের কারণে আয় থেকে যতটুকু ধারণা পাওয়া যায়, দারিদ্র্য তার চেয়ে অনেক বেশি তীব্র হতে পারে।
তিনি বলেন, সম্পদ ও দারিদ্র্যের সম্পর্ক অনেকটা জটিল। এটি পরিবর্তনশীল এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার প্রাকৃতিক ও সামাজিক উভয় পরিবেশের বৈশিষ্ঠ্যের ওপর নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত।
সেন বলেন, আয় ব্যক্তির জীবনযাত্রার মানের সূচক নয়। মানুষের জীবনযাত্রার মান ভৌত পরিবেশের বৈচিত্র্য, সামাজিক পরিবেশের তারতম্য ও সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতের পার্থক্যের ওপর নির্ভরশীল। তিনি বলেন, বার্ধক্য, প্রতিবন্ধিতা ও অসুস্থতা ইত্যাদি বাধা মানুষের উপার্জন ক্ষমতা হ্রাস করে। এমন বাধা আয়কে সক্ষমতায় রূপান্তরিত করাকেও কঠিনতর করে তোলে। কেননা, অপেক্ষাকৃত বয়স্ক বা অধিক শারীরিক প্রতিবন্ধীকে একই জীবনযাত্রা অর্জন করতে অধিকতর পরিশ্রম করতে হয়। দারিদ্র্য অনুধাবন ও দারিদ্র্য মোকাবেলায় সরকারী নীতি নির্ধারণে সক্ষমতা বঞ্চিতদের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন অসুবিধা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হতে পারে।
সম্ভবত এটিই অমর্ত্য সেনের উল্লিখিত বইটির চুম্বক বক্তব্য, যা তাঁর দারিদ্র্য সম্পর্কিত চিন্তা-দর্শনকে সঠিকমাত্রায় প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে বলেই মনে হয়।


অন্যদিকে একটি প্রায়োগিক গবেষণার বীজ তিন দশক ধরে একটু একটু করে প্রস্ফুটিত হয়ে কিভাবে বিশাল মহীরুহে রূপান্তরিত হয়ে ছায়া মেলে দিলো গোটা বিশ্বে, সেই অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে ডক্টর ইউনূস তাঁর “গ্রামীণ ব্যাংক ও আমার জীবন” গ্রন্থের প্রথম বাংলাদেশ সংস্করণ ২০০৪-এ দীর্ঘ ভূমিকাটি শুরু করেছেন এভাবে-
‘গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমার মনে একটা প্রগাঢ় প্রতীতী জন্মেছে যে, সকল মানুষের মধ্যে সীমাহীন সৃজনশীলতা লুকিয়ে আছে। এটা শুধু আবিষ্কারের অপেক্ষায় থাকে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন কাটাবার ভাগ্য নিয়ে কোনও মানুষ জন্মগ্রহণ করেনি। যাঁরা দরিদ্র তাঁদের এই দারিদ্র্য আমরা তাঁদের উপর চাপিয়ে দিয়েছি। দু’ভাবে আমরা এটা তাঁদের উপর চাপিয়ে রেখেছি। প্রথমত তাঁদের নিজস্ব সৃজনশীলতা সম্মন্ধে সন্ধান পাবার কোনও সুযোগ আমরা তাঁদের জন্য রাখিনি। দ্বিতীয়ত তাঁদের দারিদ্র্যের জন্য আমরা তাঁদের উপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের দায়িত্বমুক্ত রাখার সুবন্দোবস্ত করে রেখেছি।
দৃঢ়ভাবে এবং গভীরভাবে আমার মনে এই বিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে যে, আমরা এমন একটি পৃথিবী তৈরি করতে পারি যেখানে একজন মানুষও দরিদ্র থাকবে না। এটা সম্পূর্ণ আমাদের সমবেত ইচ্ছার উপর নির্ভর করছে। এই রকম একটা পৃথিবী সৃষ্টি করা সম্ভব হবে যদি সবাই মিলে এটা আমরা চাই। যা নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখি, শুধুমাত্র তা-ই আমরা অর্জন করতে পারি। অর্জনের আগে স্বপ্ন দেখাটা একটা জরুরি শর্ত। দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী সৃষ্টি করা যে কোনও অলীক স্বপ্ন নয় সেটা গ্রামীণ ব্যাংকের কাজ করতে গিয়ে প্রতিদিন প্রমাণ পেয়েছি। সামান্য পুঁজি হাতে পেয়ে গরিব মহিলা কীভাবে নিজেকে বিকশিত করতে থাকে সেটা দেখে যাচ্ছি অবিরামভাবে । এতে আমার বিশ্বাস কেবল দৃঢ়তরই হচ্ছে। এ পর্যন্ত বিশ্বাসে কখনও ফাটল ধরার কোন অবকাশ ঘটেনি।
শুধু ক্ষুদ্রপুঁজির ব্যবস্থা করলেই দারিদ্রের সমাধান হয়ে যাবে এ কথা মনে করলে বড় রকমের ভুল করা হবে। আমি বারে বারে স্মরণ করিয়ে দিয়েছি ক্ষুদ্রপুঁজি আসলে গরিব মানুষের জন্য একটা উপলক্ষ সৃষ্টি করে। একে কেন্দ্র করে মানুষ নিজের দিকে তাকাবার সুযোগ পায়, নিজের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ পায়। টাকা মানুষকে পরিবর্তন করে না। মানুষ নিজেই নিজেকে পরিবর্তন করে। কিন্তু তার হাতে একটা হাতিয়ার দরকার। যতদিন হাতে তলোয়ার আসেনি ততদিন বীর যোদ্ধা বুঝতে পারেননি তিনি কত বড় বীর। যতদিন হাতে রংতুলি আসেনি ততদিন শিল্পী বুঝতে পারেননি তিনি কত বড় শিল্পী। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে হলে অবশ্যই পুঁজির তলোয়ার দরকার। এই লড়াইয়ে তাঁর জেতা সহজ করার জন্য আরো আনুষঙ্গিক অনেক কিছু দরকার। যেমন প্রথম থেকে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে, দারিদ্র্য গরিব মানুষের নিজের তৈরি জিনিস নয়। এটা তাদের ওপর চাপানো একটা পরিস্থিতি। মানুষ সম্মন্ধে আমাদের ধারণা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, তার ভিত্তিতে তৈরি আমাদের নীতিমালা সব মিলে দারিদ্র্য সৃষ্টি করেছে। দারিদ্র্য দূর করতে হলে মানুষ ও তার সম্ভাবনা সম্বন্ধে আমাদের ধারণা পাল্টাতে হবে, তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো রচনা করতে হবে, নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। তবেই সহজে এবং স্থায়ীভাবে দারিদ্র্য দূর হবে।” ভূমিকাংশটির এই উদ্বৃতির মধ্যেই ডক্টর ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ তত্ত্বের প্রয়োগিক দর্শনটি নিহিত বলে মনে হয়। এবং দারিদ্র্যকে তিনি কিভাবে দেখেন তার আভাসও এতে ফুটে উঠে।

এছাড়াও অন্তত একযুগ আগেই তাঁর দৃষ্টিতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যের দারিদ্র্যমুক্তির দশটি নির্ধারক চিহ্ণিত করা হয়েছে এভাবে-
(১) সদস্যের পরিবার পরিজন নিয়ে সম্মানজনকভাবে বসবাস করার জন্য টিনের ছাউনিযুক্ত ঘর অথবা ন্যূনতম ২৫,০০০/- (পঁচিশ হাজার) টাকা মূল্যের ঘর আছে এবং পরিবারের সদস্যদের মেঝেতে না ঘুমিয়ে চৌকি কিংবা খাটে ঘুমানোর ব্যবস্থা আছে। (২) নিরাপদ নলকূপের পানি অথবা পানি ফুটিয়ে/ ফিটকারী/ আর্সেনিক মুক্ত/ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ব্যবহার করে পানি পান করেন অথবা পানি বিশুদ্ধ করার জন্য যখন দরকার কলসী ফিল্টার ব্যবহার করেন। অর্থাৎ খাওয়ার জন্য বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করেন। (৩) সদস্যদের পরিবারের ৬ বছর ও ততোধিক বয়সের ছেলে-মেয়ে যারা শারীরিক ও মানসিকভাবে স্কুলে যেতে সম তারা সবাই লেখাপড়া করেন। (৪) সদস্য নিজ আয় থেকে সাপ্তাহিক ২০০/- (দুইশত) টাকা বা তার বেশি কিস্তি প্রদান করেন। (৫) পরিবারের সকল সদস্য স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করেন। (৬) পরিবারের সদস্যদের নিত্য ব্যবহার্য কাপড়-চোপড় আছে। শীত নিবারণের জন্য শীতবস্ত্র যেমনঃ কাঁথা, চাদর, সুয়েটার, লেপ, কম্বল ইত্যাদি এবং মশার উপদ্রব থেকে রক্ষা করার জন্য মশারি আছে। (৭) সদস্যদের সংসারের উন্নতির জন্য বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা থাকা, যেমনঃ বাড়ির আঙ্গিনায় শাক সব্জি চাষ, গাছ লাগানো ইত্যাদি। যাতে করে সদস্যগণ বাড়তি আয় থেকে কিস্তি পরিশোধের সুযোগ পান। (৮) ব্যাংকে গড়ে বছরে অন্ততঃ ৫০০০/- টাকা সঞ্চয় জমা থাকে। (৯) পরিবারের সদস্যদের সারা বছর ধরে তিন বেলা খাওয়ার সামর্থ্য রয়েছে অর্থাৎ পরিবারে কোন খাদ্যাভাব নেই। (১০) পরিবারের সদস্যগণ স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন। পরিবারের কেউ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লে সাথে সাথে তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়াসহ চিকিৎসা খরচ নির্বাহ করার সামর্থ্য রয়েছে।

দারিদ্র্যমুক্ত অবস্থা নির্ণয়ে ড. ইউনূস চিহ্ণিত গ্রামভিত্তিক জীবনযাত্রার মাননির্ভর এই নির্ধারকগুলো পড়ে চমকে ওঠি অমর্ত্য সেনের দারিদ্র্য নিরূপণ বিষয়ক বর্তমান ধারণার সাথে মিলিয়ে ! আর অনভিজ্ঞ চিন্তাচ্ছন্নতার মধ্যেও কেন যেন মনে হচ্ছে, পরস্পর ভিন্নমেরুর হলেও দারিদ্র্যকে চিহ্ণিত করার ক্ষেত্রে দু’জনের মধ্যে কোথায় যেন একটা অদ্ভুত মিল বা গভীর সামঞ্জস্য রয়ে গেছে। ভিন্ন স্রোতের অভিন্ন সঙ্গমে এসে খাপে খাপে মিলে যায় যেন ! আমার অস্বচ্ছ ধারণা দিয়ে তা প্রকাশ বা ব্যাখ্যা করতে আপাত অক্ষম হলেও ঘুরেফিরে যে বোধটা বারবার এসে ভেতরে নাড়া দিয়ে যায়, তা হলো- সত্যিই, গ্রেট ম্যান থিঙ্ক এলাইক...!
(১৯-০৮-২০০৯)

[sachalayatan]
[mukto-mona]
[somewherein|alternative]

| ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননায় ভূষিত প্রথম বাঙালি |


‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’,
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননায় ভূষিত প্রথম বাঙালি

-রণদীপম বসু


গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আরেকটি বিরল সম্মান বয়ে আনলেন বাঙালি ও বাংলাদেশের জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’-এ ভূষিত হলেন তিনি। ১২ আগস্ট ২০০৯ বুধবার বাংলাদেশ সময় দিবাগত রাত প্রায় ৩.০০ টায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা হোয়াইট হাউসের ইস্ট রুমে আয়োজিত অনুষ্ঠানে জাকজমকের সাথে মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে দিয়ে নিজ হাতে ড. ইউনূসের গলায় এ পদক পরিয়ে দেন। এ সময় তাঁকে সহায়তা করেন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা।


বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, ক্রীড়া, সঙ্গীত ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে অনন্য সাধারণ অবদান রাখার জন্য এই সম্মাননা জানাতে নির্বাচিত ১৬ জনের নাম গত জুলাই ২০০৯ মাসেই ঘোষণা করা হয়েছিলো। এদের মধ্যে ১২ জন আমেরিকান এবং ৪ জন আমেরিকার বাইরের। ড. ইউনূস ছাড়া বাকিরা হচ্ছেন দক্ষিণ আফ্রিকার আর্চ বিশপ ডেসমন্ড টুটু, ব্রিটিশ পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং, মার্কিন সিনেটর রবার্ট এডোয়ার্ড কেনেডি, প্রখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতা সিডনি পয়টিয়ার, সাবেক প্রথম মহিলা আইরিশ প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন, অভিনেত্রী চিতা রিভেরা, নাগরিক আন্দোলনের নেতা রেভারেন্ড জোসেফ-ই-লোয়ারি, আমেরিকান আদিবাসী ঐতিহাসিক ও শিক্ষাবিদ জোসেফ মেডিসিন ক্রো, সমাজকর্মী ন্যান্সি গুডমান ব্রিঙ্কার, চিকিৎসা বিজ্ঞানী ড. জানেট ডেভিসন রাউলি, সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি সান্ড্রা ডে ও’কনর, টেনিস তারকা বিলি জিন কিং, মানবতাবাদী হিস্পানিক চিকিৎসক ড. পেড্রো জোসে গ্রিয়ান জুনিয়র প্রমুখ।
দু’জনকে মরণোত্তর পুরস্কার দেয়া হয়। তাঁরা হলেন রিপাবলিকান দলের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো কেম্প এবং সমকামী অধিকার আন্দোলনের নেতা হার্ভে মিল্ক। অসুস্থতার জন্য সিনেটর রবার্ট এডোয়ার্ড কেনেডি অনুষ্ঠানে আসতে না পারায় তাঁর পক্ষে পদক নেন তাঁর কন্যা কার কেনেডি।


১৯৪৫ সাল থেকে চালু হওয়া এই সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক (presidential medal of freedom) প্রদানের মাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিশ্বের বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরকে সম্মানিত করে থাকেন। বিগত ৬৪ বছরের ইতিহাসে এশিয়া মহাদেশ থেকে মাত্র পাঁচজন এ পদকে ভূষিত হন। তাঁদের মধ্যে ভারতের মাদার তেরেসা, মায়ানমারের ওঙ সান সুকি অন্যতম। প্রফেসর ইউনূস হচ্ছেন পঞ্চম এশিয়ান ও প্রথম বাঙালি যিনি এই সম্মান লাভ করলেন।

প্রত্যেককে পদক পরিয়ে দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁদের সম্পর্কে পরিচিতিমূলক সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। বারাক ওবামা বাংলাদেশের ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পদক পরিয়ে দেয়ার সময় বলেন, জনগণকে স্বনির্ভর করার লক্ষ্যে মুহাম্মদ ইউনূস অর্থ ব্যবস্থা ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগের চেহারা পাল্টে দিয়েছেন। জনগণকে দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্ত করতে তিনি ক্ষুদ্রঋণ লাভের সুযোগ সৃষ্টির জন্য ব্যাংকিং খাতে বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর জনগণকে লাভজনক ব্যবসার পথ দেখিয়েছেন। এভাবে মুহাম্মদ ইউনূস সৃষ্টিশীলতার নব দিগন্ত উন্মোচন করেছেন এবং বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষকে নিজস্ব ক্ষমতার প্রতি সচেতন করেছেন।


এর আগে এই পদক সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেন- এটি আমি এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এদেশ ও অন্যসব দেশের কিছু সর্বোত্তম নাগরিককে ধন্যবাদ জানানোর একটি সুযোগ। এমন এক সময়ে যখন প্রায়ই আমাদের মাঝে নৈরাশ্যবাদ ও সংশয় দেখা দেয়, পরস্পরের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা অনেক সময়ই ভুলে যাই, আমাদের সামনে চলার পথটি অনেক দীর্ঘ ও বন্ধুর মনে হয়, তখন এ অসামান্য মানুষগুলো, এ পরিবর্তনের নায়করা আমাদের এ কথাই স্মরণ করিয়ে দেন, উৎকর্ষ অর্জন আমাদের সাধ্যের বাইরে নয়। তারা আমাদের আশার বাণী শোনান। তারা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, স্বপ্ন পূরণ, অন্যের স্বপ্নকে এগিয়ে নেয়া এবং আমাদের সন্তানদের জন্য এ পৃথিবীকে নতুন করে গড়ে তোলার ক্ষমতা আমাদের প্রত্যেকের মাঝেই রয়েছে।

বারাক ওবামার এমন আবেগময় চমৎকার বাণী সবার মধ্যেই সাহস ও আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে সক্ষম বৈ কি। এবং ভাবতে ভীষণ গর্ব হয় যে, আমেরিকার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত কালো মানুষ বারাক ওবামা, যাকে একজন মানবতাবাদী তরুণ নেতা ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে গোটা বিশ্ব ভাবতে পছন্দ করে, তাঁর সাহসের প্রেরণাদায়ী ব্যক্তিত্বদের মধ্যে একজন বাঙালিও রয়েছেন, যিনি আমাদেরই লোক, ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

এ পর্যন্ত এসে লেখাটা শেষ হয়ে যেতে পারতো। অন্তত বাঙালি হিসেবে সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম আমি। কিন্তু তা যে হলো না, এর কারণ নিউজ ওয়ার্ল্ড নিউইয়র্ক-এর একটি খবরে কতকগুলো বিষণ্ন প্রশ্ন এসে ভর করলো মনে। তার ব্যাখ্যা আর নাই দিলাম। তার চে’ ‘যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা পেলেও ড. ইউনূসের খোঁজ নেয় নি বাংলাদেশ দূতাবাস’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরটাই না হয় হুবহু উদ্ধৃত করি-


‘যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মাননা অনুষ্ঠানে ড. ইউনূসকে কোনো সম্মান দেখায়নি বাংলাদেশ দূতাবাস। নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউইয়র্কে বাংলাদেশী একজন কূটনীতিক বলেন, সরকার থেকে আমাদের কোন নির্দেশনা দেয়া হয়নি। ফলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাকে সালাম জানাতেও যেতে পারিনি।
১২ আগস্ট হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ওবামা বিশ্বের ১৬ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করেন। মূলত এটা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা।
অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট ওবামা নিজ হাতে সম্মাননার মেডেলটি পরিয়ে দেন ড. ইউনূসের গলায়। বাংলাদেশী ড. ইউনূসের নাম ঘোষণার সাথে সাথে হোয়াইট হাউসের পাম রুম উল্লসিত হয়ে উঠেছিল। সেখানে প্রেসিডেন্ট ওবামা বললেন, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের আত্মবিশ্বাসকে জাগ্রত করেছেন ড. ইউনূস।
মেডেল নেয়ার বিভিন্ন দেশ তাদের কৃতী সন্তানদের অভিবাদন জানাতে প্রেরণ করেছিল স্ব স্ব দেশের দূতদের। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ছিল ব্যতিক্রম। হোয়াইট হাউসের সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না কোনো বাংলাদেশী কূটনীতিক।
পুরস্কৃত ব্যক্তিত্বদের সম্মানে স্ব স্ব দেশের দূতাবাস সংবর্ধনা ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালায় তাদের এই অর্জনকে তুলে ধরার উদ্যোগ নেয়। এ ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ দূতাবাস ছিল নির্বিকার।
১১ থেকে ১৪ আগস্ট চার দিন ওয়াশিংটনে অবস্থান করেছেন ড. ইউনূস। কিন্তু বাংলাদেশী কূটনীতিকরা তাকে কুশলবিনিময়ের ন্যূনতম সৌজন্য দেখাননি।
নিউইয়র্কের জেএফকে এয়ারপোর্টে তিনি এসে নামলে শত আমেরিকানের বিমুগ্ধ চোখ ছিল ড. ইউনূসকে ঘিরে।
গত শুক্রবার দেশে ফেরার সময়ও জেএফকে টার্মিনালে অজানা-অচেনা শত মানুষ ঘিরে ধরেছিল তাকে একনজর দেখতে। হুড়োহুড়ি লেগে গিয়েছিল ছবি তোলার জন্য। ড. ইউনূস ছিলেন একা। নিজে নিজেই বোর্ডিং কার্ড নিয়েছেন। সেখানেও বাংলাদেশী কোনো কর্মকর্তাকে দেখা যায়নি। বিষয়টি এয়ারপোর্টে উপস্থিত অনেক বাংলাদেশীর চোখ এড়ায়নি। এ জন্য তার প্রতিবাদ করেছেন প্রকাশ্যে। জানতে চেয়েছেন এই উপেক্ষা-অবহেলার হেতু কী।’



রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ হয়তো বুঝি না। তবে কৈশোরের পাঠ্যে শিখে নেয়া প্রবাদটি ঠিকই মনে পড়ে যায়- গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। একান্তই বাঙালি প্রবাদ। এই যোগী যে ভিখ পায় না, তা কি গ্রামবাসীর স্বচ্ছ স্মৃতিতে যোগীর বেড়ে ওঠার ভাঙাচোরা ছবি-কণার অহেতুক উৎপীড়ন, না কি যোগীকে ধারণ করার ক্ষমতা গ্রামবাসীর থাকে না, কে জানে। তবে এটা ঠিক যে, তপস্যার সঙ্কুল পথ ও যাত্রা যোগীকে পরিচিতির মগ্নতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সময়ের পরিশ্রুত প্রজন্মের নির্মোহ চোখই পারে যোগীর যোগ্যতা মেপে দেখার স্থিতি ধারণ করতে।

ড. ইউনূস কে ও কী, তা জানতেও হয়তো আমাদেরকে আরো কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে, সময়ের সেই পরিশ্রুত প্রজন্মের জন্যে।
(১৯-০৮-২০০৯)

[sachalayatan]
[mukto-mona]
[somewherein]

Friday, August 14, 2009

| …সাহিত্যের দিনমজুর !


…সাহিত্যের দিনমজুর !
রণদীপম বসু
.
(০১)
‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে…’, রবীন্দ্রনাথের এই সঙ্গীতটিকে ঋদ্ধি ও মননে ধারণ করেছিলেন বললে হয়তো ভুলভাবে বলা হবে ; বলতে হবে, ওই সঙ্গীতের মন্থিত জীবন-রসের সবটুকু মাধুর্যকেই বুকে আগলে নিয়েছিলেন তিনি। শুধু কি আগলেই নিয়েছিলেন ? আগুনের ওই পরশমণির অনিন্দ্য ছোঁয়ায় অগ্নিশুদ্ধ হয়ে নিজেকে এমন এক জীবনশিল্পীর মর্যাদায় আলোকিত করে নেন, সমকালীন বাস্তবতায় কী সাহিত্যে কী সাংবাদিকতায় কী চিন্তা চেতনা জীবনাচারে সময়ের চেয়েও এক অগ্রবর্তী পুরুষে উত্তীর্ণ হন তিনি। আর সময়ের চেয়ে এগিয়ে গেলে যা হয়, চলনে বলনে যাপনে সহজ সারল্যের প্রকাশ সত্ত্বেও সাধারণের চোখে হয়ে যান দুর্নিবার বিস্ময়, জিজ্ঞাসায় মোড়ানো এক রহস্য পুরুষ ! মাহবুব-উল আলম ছিলেনও তা-ই।

ধন্দে পড়তে হয় তাঁর নামের আগে প্রয়োগযোগ্য একক কোনো বিশেষণের খোঁজে। কথাশিল্পী ? হতেই পারে। সাহিত্যে মৌলিক চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির জন্য যিনি সর্বোচ্চ পুরস্কার হিসেবে ১৯৬৫ সালে ‘বাংলা একাডেমী পুরস্কার’, ১৯৬৭ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দেয়া পুরস্কার ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’ এবং ১৯৭৮ সালে ‘একুশে পদকে’ ভূষিত হন, ‘কথাসাহিত্যিক’ বিশেষণটা যে তাঁর একান্ত নিজস্ব শব্দমালার অংশ হয়ে যায়, তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে ! প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ার কর্তৃক আমন্ত্রিত লেখক হিসেবে আমেরিকা সফরে (১৯৫৯ সালে) পাওয়া ‘He is a man of unusual talent’ অভিধা যাঁর স্বীকৃতিপত্রে ঝলমল করতে থাকে, বিশেষণ নিজেও হয়তো বিশেষায়িত হয়ে যায় মাহবুব-উল আলম নামটির সাথে একাত্ম হতে পেরে।

মাত্র উনিশ বছর বয়সে প্রথম মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় রচিত ‘পল্টনজীবনের স্মৃতি’ (১৯৪০), ‘বর্মার হাঙ্গামা’ (১৯৪০), সাড়া জাগানো আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘মোমেনের জবানবন্দী’ এবং ‘পঞ্চ অন্ন’ (১৯৪৬), সমকালীনতা উত্তীর্ণ আধুনিক শিল্পকর্ম রূপে স্বীকৃত ও সমাদৃত উপন্যাসিকা ‘মফিজন’, হাস্য-রসাত্মক গল্প সংকলন ‘গোঁফ সন্দেশ’ (১৯৫৩) সহ ৩৪টিরও অধিক গ্রন্থ সেই সাক্ষ্যই বহন করে। তাঁর ‘মোমেনের জবানবন্দী’ গ্রন্থটি ইংরেজী ও উর্দুতে অনুদিত হয় তখনই। ইংরেজীতে অনুবাদ করেন অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্ত্রী শ্রীমতি লীলা রায় ‘Confessions of a Believer’ নামে (১৯৪৬)। অসাধারণ জীবনদৃষ্টি সম্পন্ন এই বইটি তৎকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকায়ও অন্তর্ভূক্ত হয়। তিনটি ভ্রমণ কাহিনী ইন্দোনেশিয়া (১৯৫৯), তুর্কী (১৯৬০) ও সৌদী আরব (১৯৬০) ছাড়াও তাঁর মরণোত্তর প্রকাশিত হাস্য-রসাত্মক গল্প সংকলন ‘প্রধান অতিথি ও তাজা শিংগী মাছের ঝোল’, ‘রঙবেরঙ’, ‘পল্টনে’ এবং ‘সাত সতেরো’ সে সময়ে পাঠক মহলে যথেষ্ট সাড়া জাগায়। অন্নদাশঙ্কর রায়ের সাথে দীর্ঘদিনের পত্রালাপের প্রেক্ষিতে বাংলা সাহিত্য ঋদ্ধ হয় আরো দুটো পত্র-সাহিত্য গ্রন্থ পেয়ে- ‘আলাপ’ ও ‘আলাপ: নবপর্যায়’।

কথাসাহিত্য চর্চার পাশাপাশি অত্যন্ত মননশীল ও শ্রমসাধ্য ইতিহাস রচনায় নিজেকে ব্রতী রেখেছেন এমন নজির বাংলা সাহিত্যে খুব একটা চোখে পড়ে না আমাদের। অথচ কী বিস্ময়করভাবে দেখি অভূতপূর্ব প্রকরণ, প্রক্রিয়া ও উপকরণ মিশিয়ে তিন খণ্ডে চট্টগ্রামের ইতিহাসের এক সমৃদ্ধ জগতের উপহার তুলে ধরেন পাঠকের হাতে- পুরানা আমল, নবাবী আমল ও কোম্পানী আমল নামে। আরো বিস্ময় অপেক্ষা করে জীবদ্দশায় সর্বশেষ যে দুঃসাধ্য কাজটি করে গেলেন তিনি, তা দেখে ! সাত বছরের একাগ্র সাধনা ও একক প্রচেষ্টায় সর্বাধিক তথ্যসমৃদ্ধ চার খণ্ডে রচিত ১২০০ পৃষ্ঠার বাঙ্গালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত, যার অসামান্য শিরোনাম- ‘রক্ত আগুন অশ্রুজল: স্বাধীনতা’। অশ্রু যখন কাব্যিক ব্যাপ্তি নিয়ে অশ্রুজল হয়ে ওঠে, এর নৈর্ব্যক্তিক গভীরতা স্বাধীনতা শব্দটির সাথেই শুধু মাখামাখি হয় না, স্বাধীনতার বোধটিও কেমন যেন বেদনাসিক্ত হয়ে ওঠে আমাদের বুকের কোণে। ভাবতেই অবাক লাগে, যে বয়সে একজন ব্যক্তি-মানুষ ব্যবহারিক জীবন থেকে নিজকে বিশ্লিষ্ট করে অসহায় সীমাবদ্ধতায় আটকে নিজেকে গুণ্ঠিত করে নেয় আত্মজৈবনিক স্মৃতিমত্ততায়, সেই বয়সে এসে কী করে একজন মাহবুব-উল আলম গোটা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়টাতে হেঁটে হেঁটে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য কুড়িয়ে এতো বিশাল ইতিহাস গ্রন্থের কাঁচামাল সংগ্রহ করেন ! ভাবতেই গা শিহড়ে ওঠে ! নামের পাশে একটা ‘ইতিহাসবিদ’ বিশেষণ ধারণ করতেও এতো বিশাল কর্মকুশল আয়োজনের প্রয়োজন পড়ে কি ! কিন্তু তাঁর তো ইতিহাসবিদ বিশেষণের চাওয়া ছিলো না। দরকার ছিলো আগুনের পরশমণির ছোঁয়ায় ভেতরে ধারণ করা ব্যক্তিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতার উন্মুক্ত জানালা দিয়ে যত কঠিনই হোক সত্য আর সুন্দরের সুবাতাস বইয়ে দিয়ে এই জনগোষ্ঠিকে ইতিহাসমনস্ক করে তোলা। কতোটা যোগ্যতা, সামর্থ আর নিজের উপর কঠিন আত্মবিশ্বাস থাকলে এরকম একক ও বিশাল একটা কাজের পরতে পরতে আন্তরিক কুশলতা ছুঁয়ে থাকে, তা বিস্ময়কর বৈ কি !

প্রজাতন্ত্রের চাকুরি থেকে অবসর নিয়েই ১৯৫৩ সালে মাহবুব-উল আলম ‘জমানা’ নামে চট্টগ্রামের প্রাচীনতম যে সাপ্তাহিক পত্রিকাটি বের করেন এবং পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে তা ‘দৈনিক জমানা’য় রূপান্তর ও প্রতিষ্ঠিত করেন, এর মধ্য দিয়ে তিনি যে শুধু নিজেকে সাংবাদিকতায় নিয়োজিত করেন তাই নয়, সম্পাদকীয় বিষয় নির্বাচন ও রচনারীতিতে স্বাতন্ত্র্যের জন্য সাংবাদিকতায়ও রীতিমতো পথিকৃতের মর্যাদা লাভ করেন।

জীবনকে ভেতর থেকে কৌতুকময় দৃষ্টিতে দেখা এবং চতুর্মাত্রিক দৃষ্টিকোণে গভীর উপলব্ধির মধ্য দিয়ে তাকে যাচাই বাছাই করার বিশ্লেষণধর্মী সারস্বত ক্ষমতা সবাই পায় না। কাউকে কাউকে তা অর্জন করতে হয় প্রচুর অধ্যয়ন অধ্যবসায় আর অগ্নিশুদ্ধ জীবনবোধ দিয়ে। মাহবুব-উল আলম তাঁদেরই একজন। পরম হংসের মতো জীবনের সারটুকু ছেঁকে নিয়ে নিজের জন্য জমিয়ে রাখেন নি তা, আমাদের সাহিত্য পাতে ঢেলে দিয়েছেন শিল্পমমত্ব দিয়ে। নিজেকে এই সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির বাইরের কেউ ভাবেন নি বা মানুষ ও সমাজের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত দায়বদ্ধতাকেও গোপন করেন নি কখনো। তাই হয়তো তাঁর সহজাত কৌতুকময়তা দিয়ে নিজেকে সাহিত্যের একজন দিনমজুর হিসেবে আখ্যায়িত করতে একটুও কুণ্ঠাবোধ না করেই নির্দ্বিধায় বলে ফেলেন- ‘… আমি সাহিত্যের দিনমজুর !’ এখানেই তাঁর দায়বোধ কড়ায়গণ্ডায় উশুল করে দিয়ে যান তিনি। কিন্তু উত্তর প্রজন্ম হিসেবে আমরা কি তাঁর চর্চা করছি ? চাইলেও তাঁর সেই আলোচিত বইগুলো এখন কোথাও পাওয়া যায় না। এবং যতটুকু জানি তাঁর কোন রচনা-সমগ্রও প্রকাশিত হয় নি আজতক। আমাদের এই লজ্জাজনক সীমাবদ্ধতাকে আর কতোকাল অক্ষম পরিতাপ দিয়ে ঢেকে রাখবো আমরা ?

আমাদের সাহিত্যপাড়ায় বহু অঘা-মঘাকে নিয়েও আলোচনা হতে দেখা যায় বিস্তর। কিন্তু কী আশ্চর্য, মাহবুব-উল আলম’কে নিয়ে কোন আলোচনা আদৌ কি হয় ? তাহলে বর্তমান প্রজন্ম তাঁর সম্পর্কে জানবে কোত্থেকে ? যাঁর মেধা ও কাজের তুলনায় বহুগুণে তুচ্ছ ও নগন্য কাজ দিয়েও একালের সাহিত্যপাড়ায় রীতিমতো আলোচিত হয়ে ওঠা কোনো বিষয়ই নয়, সেখানে নতুন প্রজন্ম এ সম্পর্কে কিছুই জানে না যে, আমাদের এমন একজন মাহবুব-উল আলম ছিলেন যিনি তাঁর মননশীলতার অনেক বড় ও ঈর্ষণীয় স্বীকৃতি পেয়েও নিজেকে সাহিত্যের একজন দিনমজুর পরিচয় দিতেই ভালোবাসতেন। ব্যক্তি ও কর্মযজ্ঞে কী ছিলেন তিনি- তা জানার দায়বোধ উত্তর প্রজন্ম হিসেবে আমাদের মধ্যে যদি সঞ্চারিত না হয়, এবং তা অর্জনেও যদি অক্ষম হয়ে পড়ি, এই দায়-দায়িত্ব কি এড়াতে পারবো আমরা ? কেননা, আমাদের পরেও আরো প্রজন্ম আসবে এবং আসতেই থাকবে।

(০২)
৭ আগষ্ট ২০০৯, শুক্রবার। নির্ধারিত সময় সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা পেরিয়ে গেছে। ৩২, তোপখানা রোডের চট্টগ্রাম ভবনের নয় তলার তাপানুকুল হলরুমে যখন ঢুকলাম ততক্ষণে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। কথাশিল্পী সাংবাদিক ইতিহাসবিদ মাহবুব-উল আলম-এর ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানমঞ্চ আলোকিত করে বসে আছেন ডান থেকে ড.রফিকুল ইসলাম, ড.মাহমুদ শাহ কোরেশি, সভাপতি সবিহ-উল আলম, ড.আনিসুজ্জামান ও ড.মনিরুজ্জামান। দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে পরিচিত-অপরিচিত বহু মুখ। তবে এরা প্রায় সবাই যে সাহিত্যপাড়া সংশ্লিষ্ট, তা বলার বাকি রাখে না। একে একে আলোচনা করলেন অনেকেই। মঞ্চে উপবিষ্টরা ছাড়াও দর্শক সারি থেকে রণজিৎ বিশ্বাস, সুব্রত বড়ুয়া, ড.মনসুর মুসা, আলী ইমাম প্রমুখরা মাহবুব-উল আলমের জীবন ও কর্মমুখরতা নিয়ে স্মৃতিচারণ আর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার পাতাগুলো উল্টেপাল্টে সন্ধ্যাটাকেই সার্থক করে দিলেন বলা যায়।


তাঁকে নিয়ে কৌতুহল আমার দীর্ঘদিনের। কিন্তু প্রয়োজনীয় রচনাবলী বা প্রতিনিধিত্বশীল গ্রন্থের অভাববোধ এই কৌতুহল নিবৃত্তির কোন সুযোগ দেয় নি বলে চাপা পড়ে ছিলো। হঠাৎ করে মাসিক শিশু-কিশোর পত্রিকা ‘টইটম্বুর’-এর আমন্ত্রণপত্রটি পেয়ে সে সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না। মাহবুব-উল আলমের জোটবদ্ধ বংশধারা চট্টগ্রামের বিখ্যাত সেই আলম পরিবারই মূলত সতের বছর ধরে টইটম্বুর পত্রিকাটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে শিশু-সাহিত্যের একটা ক্লাসিক ধারা জিইয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এবং কালে কালে এর লেখক পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের নিয়ে বৃহৎ পরিসরে একটা টইটম্বুর পরিবারই গড়ে উঠেছে বলা যায়। তাদের সাগ্রহ প্রশ্রয়ে মাঝেমধ্যে দুয়েকটা লেখালেখির সূত্র ধরে নিজেকেও আমি কখন যে এই টইটম্বুর পরিবারের অবাধ্য একজন হিসেবে ভাবতে শুরু করেছিলাম জানি না। তাই মাহবুব-উল আলম সম্পর্কে আমার জানার পরিধিটা যে প্রায় না-জানার পর্যায়ে ছিলো তা টের পেলাম এ অনুষ্ঠানে এসে।

চট্টগ্রামের ফতেহাবাদ গ্রামে ১লা মে ১৮৯৮ সালে জন্ম আর ৭ই আগষ্ট ১৯৮১ মালে কাজির দেউড়ীস্থ নিজ বাসভবনে মৃত্যু, ৮৩ বছরের এই ক্ষণজন্মা পুরুষ মাহবুব-উল আলম ছিলেন পিতা মৌলভী নসিহউদ্দিন সাহেবের দ্বিতীয় পুত্র। তাঁর অন্য ভাইরা হচ্ছেন শামসুল আলম, দিদার-উল আলম ও ওহীদুল আলম। মৌলভীর পুত্র খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মৌলভী না হয়ে যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ফতেয়াবাদ মিডল ইংলিশ স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে তৎকালীন দেশসেরা কলেজ চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়ে কিছুকাল লেখাপড়া করেন, তৎকালীন সামাজিক বাস্তবতায় এটা একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় বৈ কি। তাঁর কোন ভাই-ই মৌলভী হন নি। চট্টগ্রাম কলেজের পড়ালেখা চলছিলো ভালোই। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে মনোযোগ চলে গেলো যুদ্ধের ময়দানে। যাকে বলা হতো পল্টন। ১৯১৭ সালে উনিশের সে তারুণ্য তাঁকে নিয়ে গেলো সেখানেই। যুদ্ধ করতে করতে চলে গেলেন মেসোপটোমিয়া। ১৯১৯-এ সেখান থেকে ফিরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-দৌঁড়ে সহপাঠিদের থেকে পিছিয়ে পড়া অত্যন্ত মেধাবী মাহবুব-উল আলমের শিক্ষাজীবনে আর ফেরা হলো না। সোজা কর্মজীবনেই ঢুকে গেলেন। প্রজাতন্ত্রের সাব-রেজিস্টার থেকে কর্ম পরিক্রমায় হলেন ডিস্ট্রিক্ট সাব-রেজিস্টার। তারপর ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্টার এবং সবশেষে ইন্সপেক্টর অব রেজিস্ট্রেশন।

৩৪ বছরের চাকুরিকালেই ফাঁকেফোকে লেখালেখির চর্চা আর অবসর গ্রহণ করে লেখা ও প্রকাশনায় পুরোপুরি জড়িয়ে যাওয়া এ মানুষটির স্চ্ছলতায় কোন ঘাটতি ছিলো না। কিন্তু কাজির দেউড়ী থেকে বেরিয়ে রোজ হেঁটে হেঁটে শহরময় ঘুরে বেড়ানো এ মানুষটিকে কখনো রিক্সায় চড়তে দেখেছেন কিনা, প্রত্যক্ষদর্শী কেউ তা মনে করতে পারলেন না। এক বগলে কতকগুলো বই আর অন্য হাতে ছাতা ধরে চিরকালীন সাদা টুপি পরিহিত এই মানুষটি গোটা চট্রগ্রামবাসীর চোখে এমনই এক আর্কিটাইপ ব্যক্তিত্বের প্রতীকে পরিণত হয়ে গেলেন যে, এর বাইরে তাঁর অন্য কোন প্রতিকৃতি থাকতে পারে তা যেন একেবারে অকল্পনীয় ছিলো। কখনো টাউন বাসের ভীড়ের মধ্যে গুটিশুটি মেরে বসে থাকা সেই বই-বগলে মানুষটি এভাবেই বুঝি অত্যন্ত সঙ্গত ও স্বাভাবিক। বক্তাদের স্মৃতিচারণার মধ্য দিয়ে কল্পনায় আমিও যেন স্পষ্ট দেখছিলাম তাঁকে। বাসের টিকেট, হ্যান্ডবিল কিংবা হাতে নেয়া কোন ঠোঙ্গা ইত্যাদি বিভিন্ন আকার আকৃতি আর ঢঙের উদ্ভট সব কাগজের ফাঁকা পিঠে গুটগুট অক্ষরে লিখে ফেলা কথাগুলোই যখন অবিকৃতভাবে একত্র গ্রন্থিত হয়ে কোন মহার্ঘ রচনার অদ্ভুত পাণ্ডুলিপির চেহারা পেতো, তা হাতে পেয়ে প্রকাশকদের যেরকম আক্কেলগুড়ুম চেহারা হতো, কল্পনায় আমি ঠিকই দেখতে পাচ্ছি যেন। স্রষ্টারা নাকি এরকম খেয়ালিই থাকেন। একেকজনের খেয়াল হয়তো একেকরকম। কিন্তু মাহবুব-উল আলমের মতো এমন বিচিত্র খেয়াল আর কোন লেখকের কোথাও কোনকালে ছিলো কিনা ড. আনিসুজ্জামানও তা বলতে পারলেন না।

এরকম বহু স্মৃতির ঝাঁপি খুলে গেলো সেদিন চট্টগ্রাম ভবনের নবম তলার হলরুমটিতে। আমার জন্য তা খুবই আকর্ষণীয় ছিলো। তাই অনুষ্ঠান শেষ হয়ে এলেও কথাশিল্পী মাহবুব-উল আলমের সুযোগ্য জ্যেষ্ঠ পুত্র সবিহ-উল আলম, যিনি দীর্ঘদিন পিতার সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁর কথাটা তখনও বুকের ভেতর অনুরণিত হচ্ছিল- ‘আমার জীবনশিল্পী বাবা বলতেন, তিনটা বিষয় মেনে চলার চেষ্টা করো। এক, বছরে একবার হলেও সমুদ্রের কাছে যাবে ; সমুদ্রের বিশালতার পাশে নিজের ক্ষুদ্রত্ব ও নগন্যতাকে উপলব্ধি করে নিজেকে চিনতে পারবে। দুই, সম্ভব হলে বছরে একবারের জন্য সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টার চূড়ায় উঠবে ; উপর থেকে নিচের ছোট-বড় ভেদাভেদগুলো মুছে কিভাবে সবকিছু সমান হয়ে যায় তা শিখবে। তিন, বছরে অন্তত একটা রাত পূর্ণ জ্যোৎস্নায় কাটাবে ; সূর্যালোকের প্রখর তীব্রতার বিপরীতে চাঁদনির মোহনীয় স্নিগ্ধতায় মানবিক সৌন্দর্যবোধের পরিচর্যা হবে।

ব্যাখ্যার চেয়ে কথাগুলোর উপলব্ধিজাত অনুভবই বুকের মধ্যে একটা স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিলো। লিফট থেকে বেরিয়ে যখন রাস্তায় নামলাম, খুব ইচ্ছে হলো, আহা, আমিও যদি সাহিত্যের নগন্যতম কোন এক দিনমজুর হতে পারতাম…!

তথ্যসূত্র:
০১) মাহবুব-উল আলম কেন প্রাসঙ্গিক/ রণজিৎ বিশ্বাস।
০২) আজ কথাশিল্পী মাহবুব-উল আলম-এর ২৮তম মৃত্যু বার্ষিকী/ অনুষ্ঠান আয়োজনা।


.
[sachalayatan]
[mukto-mona blog]
[somewherein|alternative]

# একটি ফকির প্রজন্ম ও এক টাকা ছাড় !


একটি ফকির প্রজন্ম ও এক টাকা ছাড় !
রণদীপম বসু


গরীবের বউ...
ফকিরের ঘরে ফকির জন্মাবে ধনীর ঘরে ধনী, এটা খুবই প্রাথমিক ও প্রকৃতিগত সত্য কথা। কেননা জন্মমাত্র ফকির পরিবারের সদস্য হিসেবে সে তো ফকিরই হবে। এর অন্যথা হবার কোন কারণ দেখি না। তেমনি ধনীর দুলালের ক্ষেত্রেও বিষয়টা অনুরূপই হয়। তবে জন্ম-পরবর্তী সে কি ফকিরই থাকবে, না কি থাকবে না, কিংবা ধনীর দুলাল কি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পদে আজীবন সম্পদশালী থাকবে, না কি নিঃস্ব হয়ে যাবে তা নির্ভর করবে তার পরবর্তী জীবনের কর্মকৃতি বা কৃতকর্মের উপর। নিজ যোগ্যতা, শ্রম, স্বপ্ন ও দুর্নিবার ইচ্ছাশক্তির ব্যবহার করে জন্মফকির যে কৃতি সম্পদশালী হয়ে উঠতে পারবে না, এমন নিষেধাজ্ঞা কি কোথাও নাজেল হয়েছে ? হয নি। তাই এর নজির যেমন রয়েছে অনেক, তেমনি চুরি-চামারি-ছিনতাই-রাহাজানি-ডাকাতি-প্রতারণা ইত্যাদি অবৈধ পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় কাড়ি কাড়ি অর্থসম্পত্তির মালিক বনে যাওয়ার নমুনারও অভাব নেই, বরং একটু বেশিই আছে। আবার উত্তরাধিকারসূত্রে প্রচুর অর্থসম্পদশালী হয়েও দূরদৃষ্টিহীন অথর্বতা অযোগ্যতা বা অমিতব্যয়ী অবিমৃষ্যকারিতা ইত্যাদি ইত্যাদি কারণে ফকির হয়ে যাবার ইতিহাসও কম নেই। এজন্যেই হয়তো বিবেকের-কবি গেয়ে উঠেন- ‘আজকে যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়, চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়...।’ এই যে চিরদিন কারো সমান যায় না, এর মাজেজাও হয়তো অনেক।

আজ যে ফকির, সে হয়তো কাল রাজা হতেও পারে বা উল্টোটাও সম্ভব। এ হচ্ছে দৃশ্যমান ফকিরত্বের কথা। কিন্তু যে ফকিরত্ব মনের গভীরে বা ব্যক্তিসত্ত্বার মর্মমূলে ঘাঁটি গেড়ে থাকে, তা কি সহজে অপসারণযোগ্য হয় ? মনে হয় না। ফকিরত্বের সৃষ্ট হিনমন্যতাবোধ বড় কঠিন। অস্তিত্বের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জালের মতো বিস্তৃত শিকড় ছড়িয়ে ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠি বা জাতিকে আক্রান্ত করে ফেলে নির্মমভাবে, তা দূর করা দুঃসাধ্য বৈ কি। সময়ান্তরে যে ফকির সত্ত্বা রাজকীয় সম্পদের অধিকারী হয়ে ওঠে, বাইরের ঠমক রাজকীয় হলে কী হবে, ভেতরে যে ফকির সে ফকিরই থেকে যায় ! এর প্রভাব বলয় এতোটাই সুদৃঢ় ও শক্তগ্রন্থিত যে, প্রতিটা কাজে-কর্মে আচারে-বিচারে প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষেই হোক তা প্রকাশিত হতেই থাকে। আগ্রহ বা প্রতিজ্ঞা অনমনীয় না হলে এই ইচ্ছা নিরপেক্ষ প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করা খুব সহজ কথা নয়।

মানুষ নিজে নিজে তো আর নিজের চেহারা দেখতে পায় না। এ জন্যে দরকার হয় কোন আয়না বা প্রতিফলকের। সাহিত্য বা সংস্কৃতিই হচ্ছে কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠি বা জাতির সবচাইতে বিশ্বস্ত আয়না বা প্রতিফলক। জানতে বা অজান্তে আমাদের জীবনাচারের অবিকৃত প্রতিফলনটা সেখানেই ভেসে ওঠে। এর কল্যাণে নিজেদেরকে যেমন আমরা প্রতিফলিত হতে দেখি, তেমনি অন্যেরাও আমাদেরকে দেখতে পায় ঠিকই। সব জাতিগোষ্ঠির জন্যই তা সমানভাবে প্রযোজ্য। তাই খুব সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন আসে, জীবনাচারে আমাদের প্রকৃত প্রতিফলনটা আসলে কেমন ? এক্ষেত্রে মিডিয়ায় প্রতিফলিত সাম্প্রতিক কিছু ঝোঁক বা হুজুগের বিশ্লেষণ করলে আমাদের মনোজগতের ভূমিটাও কিঞ্চিৎ খনন করা হয়ে যাবে বলে মনে হয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের গবেষকদের জন্য প্রচুর মশলা-উপাত্ত রয়ে গেছে হয়তো। কিন্তু আমি তো আর গবেষক নই, আকস্মিক বোধাক্রান্ত নিরীহ নাগরিক মাত্র। তাৎক্ষণিক প্রণোদনাই উপজীব্য যেখানে।

...সবার ভাবী
নানাবিধ কারণে ইদানিং খুব একটা টিভি দেখা হয় না। তবে পারিবারিক আবহে থাকায় টিভির দৈনন্দিন খোঁজ-খবরটা ঠিকই কানে চলে আসে। এই কিছুকাল আগেও একটা বিজ্ঞাপনচিত্র দেখতাম, খুব সম্ভবত সাবানের। একটা প্রাইভেট কার এসে ঘ্যাচ করে ব্রেক কশলো একটা শপিং মলের সামনে। ভেতর থেকে পুরুষ ও রমণীটি বেরিয়েই রীতিমতো উর্ধ্বশ্বাসে ছুটলো শপিং মলের দিকে। ব্যাপার কী ! খুব সাংঘাতিক ব্যাপার ! নয় টাকা না কি চৌদ্দ টাকা দামের সাবানের প্যাকেটে এখন এক টাকা ছাড় ! কি জানি স্টক ফুরিয়ে যায়, তাই হন্তদন্ত হয়ে সেদিকেই ছুটছে ওরা।

বিজ্ঞাপনচিত্রটি দেখে প্রথম প্রথম ছাগলামিপনা ভেবে হাসতাম। প্রাইভেট কার পোষার সামর্থ রয়েছে যে ব্যক্তি বা পরিবারের, সে কিনা স্বল্পমূল্যের দৈনন্দিন ব্যবহারোপকরণে একটাকা ছাড় ঘোষণায় এভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ! নিশ্চয়ই এটা বিশাল কোনো ব্যবসায়িক টেন্ডার বা এলসি খোলাজনিত কোন বিষয় নয়। বিজ্ঞাপন নির্মাতার মাথায় গোবরের আধিক্য যে একটু বেশিই ছিলো তাতে কোনো সন্দেহ ছিলো না। কিন্তু হঠাৎ করে মাথায় এলো সেই বিষয়টা ! গোবড়ের পরিমাণ তো নির্মাতার মাথায় নয়, আমার মাথাতেই হয়তো বেশি ছিলো। নইলে সাথে সাথে মাথায় এলো না কেন যে, উঠতি বড়লোক হলে কী হবে, এ যে আমাদের জিনে করে বয়ে আনা সেই ফকিরি মানসিকতা ! অবচেতন সত্ত্বায় গেঁথে থাকা সেই ভিক্ষাবৃত্তিক মনেবৃত্তির আদি ধারা ! এ থেকে এতো সহজে রেহাই কই আমাদের ! অথচ এরাই আমাদের জাতি বা রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী মুখ। যা মুহূর্তেই মিডিয়া প্রচারে ছড়িয়ে যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী। বিজ্ঞাপনটি এখনো অন এয়ারে আছে কিনা জানি না। তবে একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এরকম কাসুন্দির যে অভাব হবে না তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এই ঢাকা শহরে এরকম ফ্রি-এর ট্যাগ লাগানো ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের কি অভাব আছে ! বাজার করতে কোন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢুকুন, ঘোষণা শুনবেন, দেড়হাজার টাকার বাজার করলে একটি সুদৃশ্য বাটি ফ্রি, দু’হাজার বা আড়াই-হাজার টাকার মালামাল কিনলে এক কেজি চিনি ফ্রি ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ক্রেতা কিন্তু আমাদের সমাজের উপরের দিকের উচ্চবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্তরাই। যাঁরা দেড় হাজার বা দু’হাজার টাকার খরচের বিষয়টা বেমালুম ভুলে গিয়ে তিরিশ টাকা দামের একটা বাটি বা চল্লিশ টাকা মূল্যের এক কেজি চিনি ফ্রি পাবার প্রলোভনে সহজেই আকৃষ্ট হয়ে যায় ! যদি তা-ই না হতো তাহলে এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এরকম আপত্তিকর ফ্রি-র মূলো নাকের আগায় ঝুলিয়ে দেবার দুঃসাহস দেখাতো না। যারা এই কাজটা করছে, এরা তো আমাদেরই ভাই-বেরাদর ! আমাদের আদি স্বভাবের হিরন্ময় অংশীদার তো এরাও !

যে সমাজের উপরের স্তরের মানসিকতার এই হাল, সেখানে গোটা জনগোষ্ঠির ছবি যে আরো মর্মান্তিক হবে তা খুব সহজ সূত্রেই বুঝা যায়। তাহলে কি জাতিগতভাবেই আমরা মানসিকতায় ফকির প্রজন্ম ? অস্বীকার করি কী করে ? আমরা নিজেরাই যদি এই হীনমন্যতাবোধের লালন-পালন ও চর্চা করার আত্মপ্রসাদকে অপমানজনক না ভাবি, অন্যেরা কেন ভাববে ? বরং আমাদের এই মনেবৃত্তিকে পুঁজি করে ফায়দা লুটার ধান্দায় থাকবে। এর প্রমাণ তো এখন হাতেনাতেই পাচ্ছি আমরা। যে অফারটা এখন আমাদের গোটা জনগোষ্ঠিকে শয়নে-স্বপনে-জাগরণে-চিন্তায়-চেতনায় দারুণভাবে মোহগ্রস্ত করে রেখেছে, তা হলো বিভিন্ন ফোন-কোম্পানি বা অপারেটরদের দেয়া এক অদ্ভুত টক-টাইম সুবিধা। যা মনস্তাত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই আপত্তিকর ও অসৌজন্যমূলক বলেই মনে হয়। কথায় বলে, গরীবের বউ নাকি সবার ভাবী। কথাটা কেন বলা হয় সেটাও বুঝি না। সম্পর্কে ভাবী হলেই কি তাঁর সাথে যা ইচ্ছে তা-ই করা সম্ভব ! জানি না। তবে ফোন-কোম্পানিগুলো যে আমাদের জাতিগত ফকিরি মানসিকতাকে পুঁজি করে আমাদেরকে যেমন খুশি নাচিয়ে বেড়াচ্ছে এবং তা যে গুঢ়ার্থে জাতিগত ধারাটিকে বিদ্রূপ করার নামান্তর, এটা বোধ করি বলার অপেক্ষা রাখে না।

আমি ঠিক জানি না, বিশ্বের আর কোনো দেশে বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে মোবাইল ফোনে টক-টাইমের নামে এমন আপত্তিকর ও বিচিত্র কীর্ত্তণ আদৌ আছে কি না। এই সময় থেকে ওই সময় পর্যন্ত এতো পয়সা প্রতি মিনিট, ওই সময় থেকে এই সময়তক এতো টাকা এতো পয়সায় যতক্ষণ খুশি আলাপের সুবিধা, কিংবা এতোটি ফ্যামেলি নম্বরে এতো পয়সা প্রতি মিনিটে চব্বিশ ঘণ্টা কথা বলার সুবিধা বা পুরনো বন্ধ সিমটি চালু করলে এতো ঘণ্টা টক-টাইম ফ্রি ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব নর্তকীপনা করানোর উদ্দেশ্য তো একটাই, আরো বেশি ব্যবসা, আরো অধিক মুনাফা। খুবই সত্য কথা যে, ব্যবসার সাথে মুনাফার বিষয় জড়িত থাকবেই। কিন্তু দুঃখ হয়, সেবার মানোন্নয়ন নয়, বরং আমাদের জাতিগত ভিক্ষাবৃত্তিক মানসিকতার ট্রেন্ডটাকে পুঁজি বিনিয়োগকারী বিদেশীরা জায়গামতো ধরে ফেলেছে ঠিকই, এবং তা নিয়ে ব্যবসার নামে রুচিহীন কটাক্ষ করতেও তাদের বাধছে না। অথচ আমাদের কাছে তা কিছুতেই মানহানিকর বা আপত্তিকর বলে মনে হচ্ছে না বা হয় না। আমাদের সরকারগুলোর পুরু চামড়ায়ও এরকম বিষয় যে কোন সংবেদন তৈরি করে না বা করছে না, এতে আর আশ্চর্য়ের কী ! সরকার মানে তো হাওয়াই কিছু নয়, আমাদেরই কিছু সংখ্যক প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিবর্গ, যাঁরা জাতিগতভাবে আমাদের সেই জেনেটিক ধারাই তো বহন করবে। নইলে ফোন-কোম্পনিগুলোর কানে ধরে বাধ্য করা উচিৎ ছিলো- দিনের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এমন সাত-রকমের টকিং-রেট না রেখে একটাই রেট রাখা, কম বা বেশি যাই হোক, অবশ্যই যৌক্তিক মাত্রায়। তা-ই সম্মানজনক হতো।

তা আর হচ্ছে কই ! এ বিষয়গুলোকে যারা সর্বোত্তম প্রচারের মাধ্যমে জনসচেতন করে তোলার কথা ছিলো, আমাদের সেই সব ফুটানিধারী প্রিন্টিং ও ইলেকট্রনিক প্রচার মাধ্যমগুলোর কথা কী আর বলবো ! মাপে ও মানে ওই সব সর্বোচ্চ বিজ্ঞাপনদাতা কোম্পানিগুলোর কাছে সবার আগেই এরা এমনভাবে নিজেদেরকে বিকিয়ে বসে আছে যে, আত্মসার্থ ক্ষুণ্ন করে এমন কোন জনসচেতনমূলক উদ্যোগ তারা নেবে এটা ভাবাই তো নির্বুদ্ধিতা !

অতএব পথচারী-দৃষ্টিতে শেষ পর্যন্ত আর কোন সিদ্ধান্ত টানা হয় না, আমাদের এই ভিক্ষাবৃত্তিক মানসিকতার পরিণতি কোথায় এবং গরীবের বউ আসলে কার বউ...!



[sachalayatan]

Sunday, August 2, 2009

# বন্ধুহীন একটি বিকেল...


বন্ধুহীন একটি বিকেল...
রণদীপম বসু

জীবন কি গড়িয়েই চলে ! গড়িয়ে গড়িয়ে কোথায় যে যায় ! এর কূলকিনারা আমরা যে পাই না, তা কি চিরায়ত জীবনটার আবহমান দূরত্ব পাড়ি দেয়ার বিপরীতে আমাদের নিজেদের জীবন-দৈর্ঘ্যরে অকল্পনীয় হ্রস্বতা ?

অনন্ত জীবনের কাছে প্রতিটা মানুষের এতো কৌতুকময় উপস্থিতি একদিন ঠিকই অনুপস্থিতির শূন্যতায় ঢেকে যায়, আমরা থেমে যাই। কিন্তু জীবন গড়িয়েই চলে, বিরামহীন।

যতক্ষণ আমরা আমাদের বহমান অস্তিত্ব আঁকড়ে থাকি, জীবনের সাথে কেউ বা দৌঁড়ে ছুটি, কেউ হেঁটে, আবার কেউ বা সত্যিকার অর্থে গড়িয়েই। জীবন যে থামবেই না, এটা জেনে যাই, যখন বুঝে যাই আমাদের অস্তিত্ব থেমে যাবে একদিন অকস্মাৎ কোন এক অদৃশ্য বিকেলে। যতই দৌঁড়াই না কেন, অথবা হেঁটে হেঁটে যতই পেছনে পড়ি কিংবা গড়িয়ে যাই, সবাই থেমে যাবো একদিন, এমন অপয়া ভাবনাগুলো একটু একটু করে স্মৃতিহীন হতে হতে ছুঁয়ে যায় জাতিশ্বর রেখাটিও। তবু কী জৌলুস নিয়ে হা হা করে হেসে ওঠি আমরা ! হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি দৃশ্যমান কোনো গড়ানো-জীবন দেখেই ! করুণাও করে ফেলি হয়তো ! হয়তো ভুলে যাই তাও, করুণা আর সহানুভূতি কখনোই এক হয না।

জীবনের চিরময়তাকে বন্ধু বানায় যাঁরা, চিরকালের বন্ধুহীন তাঁরা। জীবনের হ্রস্বতাই বুঝতে পায় বন্ধুতার কষ্ট। কোন এক বন্ধুহীন অদৃশ্য বিকেলে তাই না পাওয়ার কষ্টতারা আড়মোড়া ভাঙে, অর্থহীন প্রলাপের রণন তোলে, বুকের গহীন থেকে কা’কে যেনো ডেকে ওঠে সায়াহ্ণের ভাষায়- ও বন্ধু আমার...!

চারদিকে একটাই স্পন্দন তখন, অদৃশ্য ঘুণপোকার মতো একটানা ডেকেই চলে- বন্ধু আমার, ও বন্ধু আমার...

[sachalayatan]