Monday, June 29, 2009

# জন্মদিনের শুভেচ্ছা পোস্ট বনাম প্রফেসর ইউনূসকে নিয়ে উত্থিত প্রশ্নগুলো|


জন্মদিনের শুভেচ্ছা পোস্ট বনাম প্রফেসর ইউনূসকে নিয়ে উত্থিত প্রশ্নগুলো
রণদীপম বসু

প্রফেসর ইউনূসকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে ‘সত্তরতম জন্মদিনে প্রফেসর ইউনূস’, এই অভিন্ন শিরোনামে একটি লেখা গতকাল (২৭-০৬-২০০৬) অন্তর্জালের জনপ্রিয় দুটো ব্লগে (সচলায়তনসামহোয়ারইন) পর পর পোস্ট করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই কৌতুহলী ব্লগারদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় এতে। নিজ নিজ মতামত তুলে ধরে অনেকেই বিচিত্র সব মন্তব্যও করেন যার যার রুচি, বিশ্বাস ও ব্যক্তিত্বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে। আমার পারিপার্শ্বিক ও ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণেই সারাক্ষণ এবং ইচ্ছেমতো অন্তর্জালে সংযুক্ত থাকা আমার দ্বারা সম্ভব হয় না। ফলে বেশ দেরিতেই মন্তব্যগুলো দেখা ও পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। কিন্তু মন্তব্যের ক্যাটেগরি অনুযায়ী উত্তর দিতে গিয়েই বেশ বিপাকে পড়ে গেলাম। বিতর্ক যাকে পিছু ছাড়ে না, সেই প্রফেসর ইউনূসকে নিয়ে দেয়া পোস্টে অন্য কোনো পোস্টের মন্তব্যের মতো ইয়েস নট ভেরীগুড ধন্যবাদ জাতীয় মন্তব্য জবার দিয়ে শেষ রক্ষা হবে না এটা আন্দাজ করলেও আমি নিজেও যে ব্যক্তি-আক্রমণের লক্ষ্য হতে পারি সেটা কখনোই ভাবিনি। আর এর জবাব দিতে গিয়ে মন্তব্যের যে আকার দাঁড়াবে তাতে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি যদি দশগুণ বড় হয়ে যায় তাহলে তা সমন্বিতভাবে আলাদা পোস্ট আকারে দেয়াটাই সমীচিন মনে হযেছে।

শুধু যে এই একটাই কারণ তাও নয়। আসলে ওই সব মন্তব্যের উত্তর দেয়ার আগে প্রফেসর ইউনূস প্রসঙ্গে উত্থিত কিছু প্রশ্নের উত্তর জানাটাও আবশ্যক আমার। যেভাবে এটাও জানা দরকার যে, আমরা কি সব সময় কেবল মুখ দিয়েই উত্তর দেই, না কি মাথাও ব্যবহার করি সাথে ? তবে সবার কাছে আগে এই অনুরোধ রাখি, আমার কোন বক্তব্যে কেউ যেন নিজেকে আক্রান্ত না ভাবেন। আসলে মন্তব্য-সূত্র ব্যবহার করে আমার একান্তই নিজস্ব চিন্তা-চেতনা নির্ভর কিছু যুক্তি উত্থাপনের প্রয়াস নিয়েছি কেবল। আমরা বাঙালিরা বোধ করি অস্থি-মজ্জায় বিতর্কপ্রিয়। তবু আশা করি আমাদের পারস্পরিক সৌহার্দ্যময় সম্পর্কে কোন নেতিবাচক আঁচড় আমরা কেউ পড়তে দেবো না।

‘সত্তরতম জন্মদিনে প্রফেসর ইউনূস’ পোস্টটিতে জনৈক ব্লগার (ইচ্ছে করেই এখানে নাম নিলাম না যদিও, তিনি যেন কোনভাবেই ভুল না বুঝেন আমাকে) আমার দীর্ঘ উদ্ধৃতি ব্যবহার করেই অত্যন্ত শালিন ও নম্রভাবেই মন্তব্য করেছেন এভাবে-
অসাধারণ মেধা আর অনন্য সৃজনক্ষমতার চৌকস উপস্থাপন, অর্থনীতির ক্ল্যাসিক তত্ত্বকে উল্টে দিয়ে সৃষ্ট তত্ত্বের সাথে প্রয়োগযোগ্যতার বিস্ময়কর সাফল্য প্রদর্শন এবং সাদাসিধে ব্যক্তি-জীবনের গ্লামারাস কারিশমা ও ঈর্ষণীয় যোগ্যতা তাঁকে হতভাগ্য গরীব একটি দেশের সাধারণ শিক্ষক প্রতিনিধি থেকে এক প্রভাবশালী বিশ্ব-ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। তাঁকে নিয়ে আমরা যত বিতর্কই করি না কেন, বিশ্ব-মানচিত্রের এক কোণে পড়ে থাকা অসংখ্য সমস্যা-জর্জরিত বাংলাদেশ নামের ছোট্ট এই দেশটির বিশ্বপরিচিতি তুলে ধরতে তাঁর অবদান কোন অংশে কম নেই। এবং তাঁর মতো দ্বিতীয় আরেকটা বিশ্ব-ব্যক্তিত্ব তৈরি হতে এই হতভাগ্য জাতিকে আরো কতোকাল যে অপেক্ষা করতে হবে কে জানে। করে খাওয়ার বদলে কেড়ে খাওয়ার সংস্কৃতিতে পর্যুদস্ত এই দেশে তাঁকে নিয়ে অহঙ্কার আমরা করতেই পারি।...
ছিঃ বসু ছি!
এই সুবিধাবাদি-ধান্দাবাজ-সুদখোর-নীতিহীন জঘণ্য একটা লোককে এইরকম তেল চুপচুপে লেখা দিয়ে নিজের রেপুটেশন নষ্ট না করলেও পারতেন।”

প্রথমেই তাঁকে ধন্যবাদ এবং মন্তব্যের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখি। কেননা তাঁর ধারালো ও ভারী মন্তব্যের তীব্রতা যখন ঘুরে আমার দিকেই ধেয়ে এলো, তখন আর জবাব না দিয়ে আমার কোন উপায় থাকে নি। এই মন্তব্যের জবাব দেয়ার প্রয়োজন মনে করেছি কয়েকটি কারণে-

ড. ইউনূস এই রণদীপম বসু নামের নগন্য একজন ব্লগারকে চিনেন কি না তা জানা নেই। চেনার মতো নগন্যতম কোন সম্ভাবনাও চোখে পড়ে না। কিংবা ওই লেখাটাও আদৌ তাঁর চোখে পড়ার কোন কারণ আছে কিনা সে ব্যাপারেও একশতভাগ সন্দিহান আমি। আমাদের প্রচলিত সিস্টেমে যেখানে কোন না কোন স্বার্থ জড়িত থেকে যায়, বৈধ বা অবৈধ কোন সুযোগ-সুবিধা পাওয়া-নেয়ার বিষয় জড়িত থাকে সেখানেই তেল দেয়ার বিষয়টা প্রযোজ্য হয়ে থাকে জানি। সেক্ষেত্রে চুপচুপে দূরে থাক, সামান্যতম তেলও খরচ করা এই সংগতিহীন আমার জন্য মহার্ঘ অপচয় হয়ে যায় না কি ?

এই লেখকের ‘হরপ্পা’ নামের ব্লগে ঢুকতেই ব্লগ ব্যানারে প্রাচীন গ্রীক কবি ইউরিপিডিসের একটা বাণী নিশ্চয়ই চোখে পড়েছে- ‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই। তা প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়, তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধ হয় ভালো।’ ভুল বা শুদ্ধ হোক, আমার চিন্তা আমারই। এর সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। তা স্বীকার করেই আমার বক্তব্য হচ্ছে, নিজস্ব চিন্তা বা ভাবনাকে প্রকাশের সৎসাহসই যদি না থাকলো তাহলে অর্থহীন রেপুটেশন দিয়ে কী হবে ! আর রেপুটেশন মানেই কি কান-কথা নির্ভর যুক্তিবোধহীন হুজুগে জনস্রোতে ভেসে চলা ?

আপনার অপছন্দের কিছুকে ‘ছিঃ’ বলতে পারার মৌলিক অধিকারকে সংরক্ষণ করেই আমারও কি জানতে ইচ্ছে হয় না, ড. ইউনূসকে আখ্যায়িত করে যে ‘সুবিধাবাদি-ধান্দাবাজ-সুদখোর-নীতিহীন-জঘণ্য’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করলেন তা কি ভালোভাবে জেনেবুঝে নিশ্চিত হয়ে করলেন ? কিংবা আমার চিন্তাপ্রসূত বক্তব্যের যে উদ্ধৃতিটাকে ‘ছিঃ’ শব্দ ব্যবহার করে এক কথায় প্রত্যাখ্যান করে দিলেন তার পেছনে আপনার কোন্ তথ্য-উপাত্ত-যুক্তিবোধ কাজ করেছে তা জানার অধিকার নিশ্চয় আমিও সংরক্ষণ করি !

আমি আশা করবো, পারস্পরিক সৌহার্দ্যময় সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রেখেই আমরা আমাদের আলোচনা-পর্যালোচনাটাকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। আর আলোচনায় যাবার আগে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সম্ভবত জরুরি এখন।

০১) ১৯৯২ সালে সোনালী ব্যাংকে ৫০০ টাকা মাসিক জমাদান শর্তে একটা ডিপোজিট পেনশন স্কীম বা ডিপিএস হিসাব খুলেছিলাম ১০ বছর মেয়াদে। কিন্তু ১৯৯৯ সালে পারিবারিক সমস্যার কারণে ওটার বিপরীতে তৎকালীন ১৮% ত্রৈমাসিক চক্রবৃদ্ধি সুদ হারে জমাকৃত আমানতের ৬০% সমপরিমাণ টাকা ঋণ নেই। সুদের হিসাব তো অনেকেই খুব ভালো জানেন দেখছি, একটু হিসাব করে বলবেন কি, এই সুদের হার বাৎসরিক হিসাবে কত পার্সেণ্টে গিয়ে দাঁড়ায় ? যেহেতু ঋণের বড় অংকের কিস্তির কারণে জাতীয় স্কেলের উল্লেখযোগ্যহীন বেতন নির্ভর ছাপোষা চাকুরে আমার দ্বারা খুব সঙ্গত কারণেই নিয়মিত ঋণের কিস্তি দেয়া সম্ভব ছিলো না, তাই অচিরেই তা সুদসহ বাড়তে বাড়তে আমার আমানতের মূল টাকাটাই গিলে খাবার জোগাড়। শেষপর্যন্ত ডিপিএস হিসাবটাকেই ক্লোজ করতে হলো। তাও ডিপিএস-এর প্রাপ্য ইন্টারেস্ট রেটে নয়, নরমাল সেভিংস এ্যাকাউন্ট হিসেবে।

এখন প্রশ্ন, একটা রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের সে সময়কার এমডি যিনি ছিলেন, তাঁকে কি সুদখোর মহাজন বলে অকথ্য ভাষায় গালি দেবো আমরা ? আর যদি সেই নিয়ম এখনও চালু থাকে, তবে কি বর্তমান এমডিও সুদখোর কাবুলিওয়ালা ?

০২) গ্রামীণ ব্যাংক হচ্ছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অক্টোবর ১৯৮৩ সালের রাষ্ট্রীয় অধ্যাদেশ বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতাধীন একটি বিশেষায়িত ব্যাংক। যে কোন একটি নতুন শাখা খুলতে গেলেই আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের সরেজমিন তদন্ত সাপেক্ষে পূর্বানুমতির প্রয়োজন হয়। তাহলে আমাদের বিদ্যার জাহাজ বড় বড় সরকারি কর্মকর্তারা এটাকে এনজিও বলেন কেন এবং কোন্ যুক্তিতে ?

০৩) ড. ইউনূস হচ্ছেন গ্রামীণ ব্যাংকের বেতনভোগী এমডি। যেহেতু তিনি এর স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা, এবং সময়ে সময়ে পূর্ব-দৃষ্টান্তহীন এই আনকোরা নতুন দর্শনে চালিত প্রতিষ্ঠানটির নিয়ম নীতি কৌশলের সংস্কার ও সম্প্রসারণে তাঁর মেধা ও দক্ষতার প্রয়োজন ছিলো, তাই তাঁকে সম্মানিত করে দীর্ঘকালীন এমডি হিসেবে রাখার বিধান যতটুকু জানি উক্ত অধ্যাদেশেই করা হয়েছিলো। প্রতিষ্ঠানটির আয়-ব্যয় বা লাভ-লোকসানের যাবতীয় দায়ভার প্রতিষ্ঠানই বহন করে। ড. ইউনুসের ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতি বা কোন ধরনের মুনাফার বিষয় এখানে কোনভাবেই জড়িত নয়। এছাড়া ব্যাংকটির পরিচালক মণ্ডলির নয়জন তিন বছর অন্তর ঋণগ্রহীতা সদস্যদের থেকে সদস্যদের দ্বারাই নির্বাচিত হন। চেয়ারম্যানসহ বাকী তিনজন পরিচালক নিয়োগ দেন সরকার। নীতি-নির্ধারণী থেকে আয় ব্যয় এবং পরিচালন কৌশল সবকিছুই এই পরিচালক মণ্ডলিই অনুমোদন করে থাকে। তাহলে ড. ইউনূসকে কেন সুদখোর এবং আনুষঙ্গিক গালাগালগুলো শুনতে হয় ?

০৪) ক্ষুদ্র ঋণ তত্ত্বের বেসিক নীতিটাই হলো জামানত বিহীন ঋণ। প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যাদের জামানত দেয়ার ক্ষমতা আছে তারাই যে কোন ব্যাংক থেকে ঋণ পাবার যোগ্যতা রাখেন এবং তাঁরা ঋণের জন্য ব্যাংকে আসেন। অন্যদিকে ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থায় জামানত দেয়ার মতো ন্যুনতম সম্পদও যাদের নেই, তাঁদেরকে তাঁদের পেশা বা ঋণ ব্যবহারের সক্ষমতার উপর ভিত্তি করে জামানত বিহীন ঋণের সুযোগ তুলে দিতে ব্যাংকই মানুষের দরজায় যাবে।

এই নীতির উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী বহু প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে যারা নিজ নিজ পরিচালন ব্যয় ও আনুষঙ্গিক খরচাদি বিবেচনায় রেখে আয়ের নিমিত্তে ঋণের সুদের হার নিজেরাই নির্ধারণ করে থাকে। সুদের হারের সাথে ক্ষুদ্রঋণ তত্ত্বের কোন সম্পর্কই নেই। এমন যুগান্তকারী তত্ত্বকে সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে ড. ইউনূস দেখিয়েছেন জাতীয় বেতন কাঠামোর মধ্যে থেকেও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এরকম প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা সম্ভব, শুধু সদিচ্ছা থাকলে। এজন্যই এই তত্ত্বের আলোকে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই অসংখ্য স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে এবং দেশে দেশে তা পাঠ্যসূচিতেও অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, এই সিস্টেমের যাঁরা বিরোধিতা বা সমালোচনা করছেন বা এর অসারতা প্রমাণ করতে লেগেপড়ে আছেন, তাঁরা কেন আরো উন্নত কোন সহজ সিস্টেম দাঁড় করিয়ে ড. ইউনূসকে অবসরে পাঠাচ্ছেন না ? প্রকৃত ধাপ্পাবাজ আসলে কারা ?

০৫) প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের সংজ্ঞা তো দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রেই জানেন। এই কাল্পনিক নগর রাষ্ট্রের বাস্তবতা কতটুকু ? আদৌ কি তা বাস্তবায়নযোগ্য ? তাই বলে কেউ কি প্লেটোকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন ? সময়ের ধারাবাহিকতায় পৃথিবীর সমস্ত তত্ত্বই আপ-ডেট হতে হতে পুরনো তত্ত্ব বাতিল হয়ে নতুন তত্ত্ব এসে জায়গা করে নেয়। কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে গিয়ে পুরনো তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা ও ভুলগুলো চিহ্ণিত হয়ে সংশোধিত হতে থাকে। তা না করে ‘ভাত দেয়ার মুরোদ নেই কিল মারার গোসাই’ হয়ে আমরা যারা মাইক্রো-ক্রেডিট নিয়ে গালাগাল করে নিজেদেরকে রহস্যময়ভাবে জাহির করছি, তারা কি আসলে কে কত তীব্র ও আখাট্টা ভাষায় গাল দিতে পারি এই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে নিজেদের ব্যক্তি ও সামাজিক রুচিবোধের নিম্নগামীতা প্রকাশ করতেই গৌরববোধ করছি ?
০৬) গ্রামীণ ব্যাংক হচ্ছে একটা সোশ্যাল বিজনেস বা সামাজিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। এর লাভালাভের দাবীদার প্রতিষ্ঠানটির ৭০ লক্ষ ভূমিহীন ঋণগ্রহীতা শেয়ার হোল্ডার মালিক সদস্য ও অন্যতম শেয়ার হোল্ডার বাংলাদেশ সরকার (৮৫ ঃ ১৫)। ভূমিহীন ঋণগ্রহীতা সদস্য ও সরকারের মালিকানা শেয়ারের অনুপাতের সর্বশেষ তথ্যে কিছুটা পরিবর্তন থাকতে পারে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় যাঁর ন্যুনতম কোন শেয়ারও নেই, সেই ড. ইউনূসকে যখন আমাদের বিজ্ঞ ও জ্ঞানী(!) রাজনীতিকরা বিদ্বেষ ছড়ানো ‘সুদখোর কাবুলিওয়ালা’ বলে লোকদেখানো ঘৃণ্য ভাষায় সম্বোধন করে থাকেন, এবং এই সম্বোধন শুনে আমরা যখন প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ঋণ পাবার যোগ্যতাহীন ৭০ লক্ষ বা আরো অনেক বেশি পরিবারের সম্ভাব্য অসহায়ত্বের কথা ভুলে গিয়ে কুম্ভিরাশ্রু ছাড়তে ছাড়তে উদ্বাহু নৃত্যে নাচতে থাকি, তখন সেই আপ্ত-উক্তিটা মনে পড়ে যায়- ‘মূর্খের দেশে পণ্ডিত না হয়ে আমি জ্ঞানীর দেশে মূর্খ হয়ে জন্মাতে চাই।’ কে যেন করেছিলেন উক্তিটা।
তবে হাঁ, প্রফেসর ইউনূসের ব্যক্তিগত প্রাপ্তি তো কিছু আছেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রায় সব সেরা ও মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারের সাথে যতটুকু জানি বেশ ভালো অর্থমূল্যও রয়েছে। আশিরও অধিক এরকম পুরস্কার যাঁর থলেতে এবং যতটুকু বুঝি ভালো সম্মানীর বিনিময়ে আন্তর্জাতিক সেমিনার সিম্পোজিয়ামে আমন্ত্রিত হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ানো প্রফেসর ইউনূসের আর্থিক সচ্ছলতা যদি তাঁর মেধা, সৃজনশীলতা ও যোগ্যতার বিনিময়ে অর্জিত হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে তার এই বৈধ আয় নিয়ে আমাদের গাত্রদাহ হবার রহস্য বা কারণ কী হতে পারে ?

০৭) ‘চিলে কান নিলো রে’ শুনেই আমরা কি হুজুগে দৌঁড়াতেই থাকবো, না কি নিজেদের সেন্স ও যুক্তিবোধ প্রয়োগ করে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রকৃত রহস্যটা খোঁজার চেষ্টা করবো ?

ব্যক্তির ব্যবহৃত ভাষাই তাঁর ব্যক্তিত্বের আয়না। নিজের সন্তানকে পাশে রেখে কুৎসীৎতম যে শব্দটা পর্যন্ত আমরা উচ্চারণ করতে পারি, সেটাই আমাদের প্রকাশিত ব্যক্তিরুচির লোয়ার লেভেল হওয়ার কথা ছিলো। তাই যাঁরা কেবল যুক্তিহীন গালাগালি করে এক ধরনের বিকৃত আনন্দ পেতে চান তাঁদের শালিনতা ও রুচিবোধ নিয়ে আমার কোন কথা নেই। তবে যাঁরা যুক্তিবোধ সম্পন্ন এবং প্রকৃত তথ্য ও রহস্য খুঁজে পেতে আগ্রহী, তাঁদের জন্য উপরোক্ত প্রশ্নগুলো আপাতত উত্থাপন করা হলো। এগুলোর জুৎসই উত্তর পাওয়া গেলেই সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ক আরো কিছু অনিবার্য প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করি।

ব্যক্তিগত কৌতুহল ও নিরন্তর প্রশ্নমুখীনতাই আমাকে এ পোস্ট তৈরি করতে সহায়তা করেছে। আমি বিশ্বাস করি, প্রশ্নের সারি যত দীর্ঘ হয়, উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়ে রহস্য উন্মোচনের সম্ভাবনাও তত নিকটবর্তী হতে থাকে। আসুন না, অহেতুক হুজুগে মেতে না উঠে আমরা আমাদের প্রশ্নের সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করতে থাকি। কেউ না কেউ এর উত্তর দিতে এগিয়ে আসবেই।

[sachalayatan]

Saturday, June 27, 2009

# সত্তরতম জন্মদিনে প্রফেসর ইউনূস |


সত্তরতম জন্মদিনে প্রফেসর ইউনূস
রণদীপম বসু

তিনি আমাদের একমাত্র নোবেল লরিয়েট। অনেক বিতর্ক তাঁকে নিয়ে। তিনিই কি এসব বিতর্কের জন্ম দেন, না কি নিজেদের কাটতি বাড়াতে মিডিয়াই এসব বিতর্কে ইস্যু তৈরির ঘৃতাহুতি দিয়ে যায়, তাও এক রহস্য বৈ কি। তবে কোন রাষ্ট্রনায়ক বা ওয়ার্ল্ড ক্লাস পারফর্মার না হয়েও অসাধারণ মেধা আর অনন্য সৃজনক্ষমতার চৌকস উপস্থাপন, অর্থনীতির ক্ল্যাসিক তত্ত্বকে উল্টে দিয়ে সৃষ্ট তত্ত্বের সাথে প্রয়োগযোগ্যতার বিস্ময়কর সাফল্য প্রদর্শন এবং সাদাসিধে ব্যক্তি-জীবনের গ্লামারাস কারিশমা ও ঈর্ষণীয় যোগ্যতা তাঁকে হতভাগ্য গরীব একটি দেশের সাধারণ শিক্ষক প্রতিনিধি থেকে এক প্রভাবশালী বিশ্ব-ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। তাঁকে নিয়ে আমরা যত বিতর্কই করি না কেন, বিশ্ব-মানচিত্রের এক কোণে পড়ে থাকা অসংখ্য সমস্যা-জর্জরিত বাংলাদেশ নামের ছোট্ট এই দেশটির বিশ্বপরিচিতি তুলে ধরতে তাঁর অবদান কোন অংশে কম নেই। এবং তাঁর মতো দ্বিতীয় আরেকটা বিশ্ব-ব্যক্তিত্ব তৈরি হতে এই হতভাগ্য জাতিকে আরো কতোকাল যে অপেক্ষা করতে হবে কে জানে। করে খাওয়ার বদলে কেড়ে খাওয়ার সংস্কৃতিতে পর্যুদস্ত এই দেশে তাঁকে নিয়ে অহঙ্কার আমরা করতেই পারি।

জ্ঞান চর্চা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে সব তত্ত্বই আমাদেরকে বাইরে থেকে ধার করে আনতে হয়। কিন্তু যে তত্ত্ব ও তার প্রায়োগিক কৌশলটি গোটা বিশ্ব আমাদের থেকে ধার নিয়ে যায় তা হচ্ছে ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ তত্ত্ব। বিশ্ব অর্থনীতিতে যার প্রায়োগিক সাফল্যের কার্যকর প্রভাবের কারণেই নরওয়েস্থ নোবেল শান্তি কমিটি ২০০৬ সালে ক্ষুদ্রঋণের স্রষ্টা ড. ইউনূস ও তাঁরই সৃষ্ট এই তত্ত্ব প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংককে যৌথভাবে বিশ্বের সবচাইতে মর্যাদাপূর্ণ নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে।

বিশ্বের প্রায় সবগুলো মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারসহ আশিটিরও বেশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও অসংখ্য খেতাবে ভূষিত একক ব্যক্তি হিসেবে ড. ইউনূসের জুড়ি তিনি নিজেই। তাঁর ধারেকাছেও দুনিয়ায় আর কেউ আছে বলে জানা নেই। তিনি এই বাংলাদেশেরই সন্তান।

১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্ট্রগ্রামে জন্ম নেয়া বিরুদ্ধ স্রোতের যাত্রী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের এই ৭০তম জন্মদিনে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন ড. ইউনূস।

[ ড. ইউনূসের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে আরো জানতে গত জন্মদিনে দেয়া এই পোস্টটি পড়ুন]

[sachalayatan]
[somewherein]

Tuesday, June 23, 2009

# আহা জীবন ভ্রাম্য জীবন। ০৬।


টোকানি...
রণদীপম বসু

সিগারেটের খালি প্যাকেট, ছেঁড়া কাগজ, ফেলে দেয়া জুসের ক্যান, প্লাস্টিকের বোতল, পরিত্যক্ত জুতা, ভাঙা টিন কিংবা জং ধরা লোহার খণ্ড, সামনে যা কিছু পড়েছে ইত্যাদি সবই হয়তো খুটে খুটে তুলে নিয়ে কাঁধে ঝুলানো প্লাস্টিকের বস্তাটায় ঢুকিয়ে নিয়েছে। দিনমান ঘুরে ঘুরে ভরে ওঠা বস্তাটা নিয়ে চলে এসেছে সিটি কর্পোরেশানের ময়লা জমানোর ডাস্টবিনটার পাশে। এসেই ঢেলে দিলো রাস্তাতেই। আর কোথাও ঢালার তো উপায় নেই। তেড়ে আসবে ভদ্রলোকেরা। তাই ডাস্টবিনের পাশটাই নিরাপদ হয়তো। পরপরই চলে এলো মহিলাটিও, আরেকটি বস্তা কাঁধে করে, হতে পারে লোকটির জীবনসঙ্গিনীই হবে। হয়তো বা নির্ধারিত স্পটই এটা তাদের। ছেলেটিও চলে এলো একইভাবে। বোঝা যাচ্ছে এক পরিবারই হবে এরা।

যা কিছু মুখে গুঁজে বস্তি থেকে একসাথে বেরিয়েছিলো টোকানির কাজে। যার যা সঞ্চয় সব এনে একত্রে ঢেলে এবার বাছাইয়ের পালা। একদিকে কাগজের ভাগ, প্লাস্টিক অন্যদিকে, আরেকদিকে ভাঙারিগুলো এভাবে। পৃথিবীতে কিছুই ফেলনা নয়। কারো কাছে যা বজ্য, অন্যের কাছে তাই দরকারি খুব। জীবনটাই বুঝি এই রিসাইক্লিং-এ চলছে। সবকিছু ক্যাটেগরি অনুযায়ী পৃথক ভাগে এবার হয়তো চলে যাবে সংশ্লিষ্ট আরতে বিক্রির জন্যে। কিছু হয়তো নিজেদেরই ব্যবহারে। অতঃপর যেক'টা মলিন টাকা উঠে আসবে হাতে, কড়কড়ে গন্ধ ছড়াবে কিনা জানিনা। তবে দিনশেষে দু'মুঠো চাল, এক চিমটি ডাল আর এক ভাগা গলে যাওয়া মাছের গুড়ো বা দু'টুকরো আলু হলে একটা দিনের সমাপ্তি ওদের জন্য বালা-মুসিবত ছাড়া ভালোয় ভালোয়ই কেটে গেলো।

কোন এক পূর্বজন্মের অজান্তে দেখে ফেলা দুর্ভাগা স্বপ্নের মতোই এর চেয়ে বেশি কিছু চাওয়াটাই হয়তো ভুলে গেছে ওরা !

আহা, মানুষের স্বপ্ন দেখার ক্ষমতাও কত বেশি সীমিত এখন...!

[somewherein]

Friday, June 19, 2009

# আহা জীবন ভ্রাম্য জীবন। ০৫।


চর্মকার...
রণদীপম বসু

অফিসে আসতে যেতে রোজই দেখি। প্রয়োজন হলে কাছে যাই, বসে পড়ি নির্দ্বিধায় পাশের বাক্সটির উপর। পায়ের জুতো জোড়া খুলে কালি করতে দেই কিংবা কোথাও ফেটে গেলে ছিঁড়ে গেলে নতুন করে সেলাই করিয়ে নিয়ে চকচকে জুতো পায়ে ফের ফিরে যাই নিজ নিজ গন্তব্যে।

নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আর প্রকৃতি দিয়ে কেউ ডাকি মুচি, কেউ বলি চামার বা আরেকটু শালীনভাবে চর্মকার। এতেও আমাদের জিহ্বায় যাদের জড়তা একটু বেশি তারা বলি বিদেশি উচ্চারণে সু-মেকার। সবসময় হাসি-খুশি বিনয়ী এতো চমৎকার আচার-ব্যবহার লোকটির, সমান্তলার অবস্থানে আশেপাশের অনেকের চেয়ে কোনোভাবেই খাটো নয় তবু কেউ কি আমরা নিজেদের পাশাপাশি কল্পনাও করি ! সামাজিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো তো দূরের কথা ! সামাজিক অবস্থানে অন্ত্যজ এই গোষ্ঠীকেই কি কেউ কেউ ঋষি সম্প্রদায় বলে থাকে ?

এতো সুন্দর সুন্দর জুতো সংস্কার করে তৈরি করে, কিন্তু কখনোই তাকে এসব ব্যবহার করতে দেখি নি। এটাই কি তার সামাজিক সীমাবদ্ধতা ? কী সেই সীমাবদ্ধতা ?

[somewherein]

# আহা জীবন ভ্রাম্য জীবন। ০৪।


ভিক্ষা পায় বলেই এরা ভিক্ষুক।
রণদীপম বসু

যদি ভিক্ষা না পেতো, আমি আপনি আমরা পুণ্যি নামক অলৌকিক বায়বীয় এবং অপ্রমাণিত না জানি কি পাওয়ার উছিলায় চূড়ান্ত বিচারে ক্ষতিকর এই ভিক্ষা দেয়ার কাজটি করে নিজেদের দায়বদ্ধতা ও অপরাধবোধকে জানতে-অজানতে ঢেকে রাখা কিংবা এড়িয়ে যাবার চেষ্টাটি না করতাম, তাহলে হয়তো ভিক্ষা না পেয়ে এরা শ্রমবিমুখ এই ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে শ্রমসাধ্য কোনো উপার্জনক্ষমতায় নিজেদের জড়িয়ে নিতে বাধ্য হতো।


মানবতার জন্য চরম অপমানকর এই পেশাহীন পেশা-প্রবৃত্তিটিকে আর কতোকাল টিকিয়ে রেখে মানবিক বৃত্তিগুলোকে ধ্বংস করবো আমরা ! অশুভ ক্যান্সারের মতো ভিক্ষাবৃত্তির পেছনেও যে অবিশ্বাস্য কিছু প্রভাবশালী সিন্ডিকেট খুব প্রবল ও জঘন্যভাবে সক্রিয় থাকতে পারে তা কি কখনো ভেবেছি আমরা ?

আচমকা আপনার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়া ভিক্ষুকটির চোখের দিকে তাকিয়ে কখনো কি ভেবেছি আমরা, নিজের কারণে সে ভিক্ষুক হয় নি ! তার পেছনে আমি আপনি আমরাই জড়িত, প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে !

[somewherein]

Sunday, June 14, 2009

# [রম্য] সচলাড্ডা, না কি বোম ভোলানাথ...!


সচলাড্ডা, না কি বোম ভোলানাথ...!
রণদীপম বসু

সময় সমাসন্ন, অথচ মেলার আয়োজক ভোলাবাবার বিশিষ্ট ভক্ত প্রখ্যাত আহমেদুর রশিদ টুটুলের কোনো পাত্তা নেই। এদিকে ভোলানাথের শিষ্যরা একে একে আসতে শুরু করেছেন। আয়োজন ভেনু শুদ্ধস্বরের সত্ত্বাধিকারী হিসেবে নিজের আসনটিসহ ওখানে আসন সংখ্যা সাকুল্যে চারটি, যা ইতোমধ্যেই দখল হয়ে আগত শিষ্যরা যার যার কারিশমা দেখাতে শুরু করে দিয়েছেন। হঠাৎ ফোনে আয়োজক টুটুল নিজে উপস্থিত থাকতে পারছেন না এরকম ব্যাখ্যা শুনে মেলার কো-অরডিনেটর বিপ্লব রহমানের চান্দি এন্টিক্লকওয়াইজ চক্কর শুরু করে দিয়েছে। এখন উপায় ! পরীক্ষিত শিষ্য নজরুল ইসলাম বাবার প্রসাদ পেতে দেরি দেখে খেকখেক শুরু করে দিয়েছে। প্রসাদ নয়, বাবাকে পছন্দের প্রায়োরিটি দিয়ে অতি ভদ্র কবিশিষ্য তারেক রহিম নিজেকে শান্ত রাখার রিহার্সেল দিচ্ছে। তাঁকে আবার উত্তমভাবে চর্চার প্রক্রিয়া শিখিয়ে দিচ্ছে গাল্পিকশিষ্য পান্থ রহমান রেজা। যার একারই একত্রে চার-চারটি আসন দরকার হয়, নিরীহ পর্বতাকার শিষ্য শাহেনশাহ সিমন তো ঢুকেই তেড়ে গেলো নজু ভাইয়ের দিকে। ভোলাবাবার প্রসাদের প্রতি এমন বেলায়েক মন্তব্য ! আর টেকনিক্যাল শিষ্য গৌতম রায় বেশ লিনাক্স মুডে তা পর্যবেক্ষণ করছে। অবস্থা বেগতিক দেখে অর্ধমাত্রার বায়বীয় প্রসাদের সাপ্লাই দিয়ে কো-অরডিনেটর বিপ্লব দা’ তখন পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আর একই সাথে আয়োজকের গোষ্ঠী উদ্ধার করে যাচ্ছেন। কী আশ্চর্য, বাবার স্বঘোষিত চেলা গোঁসাই লীলেনেরও খোঁজ নাই !


যাদের জন্য এই বিশেষ আয়োজন, বহুদিন বাবার প্রসাদ বঞ্চিত প্রবাসী শিষ্যদ্বয় ইংল্যান্ড থেকে সুবিনয় মুস্তফি আর সিংগাপুর থেকে ফারুক হাসান এসে পৌঁছামাত্রই বিপ্লব দা’কে হঠাৎ করে ঝাপসা দেখা যেতে লাগলো। ব্যাপার কী ? অতি ঘূর্ণনগতির কারণে বস্তুর অবয়ব নাকি ঝাপসা হয়ে যায়। রীতিমতো হাঁকতে লাগলেন- বাইরে আসো সবাই, বাইরে আসো ! কী ব্যাপার ? তিনি আবার কোন্ ঘটনা ঘটিয়ে ফেললেন ? হুড়মুড় করে সবাই বেরিয়ে দেখি ৯১ আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেটের তৃতীয় তলার দ্বিতীয় গলিটির শুদ্ধস্বর নামের যে ঘরটিতে এতোক্ষণ আমরা অবস্থান করছি তার সামনের প্যাসেজ দখল করে কোত্থেকে গুটি কয়েক ছেঁড়া মাদুর যোগার করে করিৎকর্মা বিপ্লব দা’ আসরের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। মার্কেটের বাদবাকী দোকান-মালিকরা কষে মার না দিলেই হয়।


শুরু হলো হুড়োহুড়ি। কে আগে জাকিয়ে বসবে সেই কম্পিটিশানে শিষ্যদের ব্যক্তিগত দক্ষতার যে প্রদর্শনী চলতে লাগলো তার মাঝখানেই সদ্য আগত বাবার আরেক একনিষ্ঠ ভক্ত এনকিদুর ছ্যাৎছুৎ ! তাঁকে পছন্দসই জায়গা ছেড়ে দেয়া না হলে সে যে টেকি-কার্টুন এঁকে এইসব হতচ্ছাড়া শিষ্যদের বর্তমান হালচালের বেড়াছেড়া অন্তর্জালে ফাস করে দেবে, সেই নমূনা হুমকী দেখাতেও কসুর করলো না।

শুরু হলো বিপ্লব দা’ কর্তৃক বাবা ভোলানাথের প্রসাদ বিতরণ। প্রসাদ সেবনের সে যে কী মাজেজা ! এরপর যা ঘটতে লাগলো তা বর্ণনা করবো কী ! ভাষাতেই লেগে গেলো ছেড়াবেড়া ! অতএব সে চেষ্টা আর না করে বরং আসুন সবাই চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করে নেই !

ছবি ০১। কো-অরডিনেটর বিপ্লব রহমান আইন-শৃঙ্খলা তদারকিতে ব্যস্ত। সাথে সহযোগী প্রধান পাণ্ডা হিসেবে বাছাই করেছেন ধলাপাহাড় শাহেনশাহ সিমন’কে।

ছবি ০২। আহা ! ভোলাবাবার প্রসাদের কী মহিমা !

ছবি ০৩। প্রসাদের মহিমায় পাহাড়ও উল্টে গেলো !

ছবি ০৪। বড় বেশি লেট করে ফেললেও এসেই বাবার চেলা হিসেবে নিজের মারাত্মক গুরুত্বটুকু বোঝানোর চেষ্টা করছেন গোঁসাই লীলেন।

ছবি ০৫। 'অই, পিছন থাইকা উঁকি দেয় কেডায় রে !'

ছবি ০৬। 'আমারে চিনছ্ !'

ছবি ০৭। বোম বাবা ভোলানাথ !

ছবি ০৮। কিচ্ছু নাই ! সব মায়া !


[sachalayatan]

Friday, June 12, 2009

# আহা জীবন ভ্রাম্য জীবন। ০৩।


আহা জীবন ভ্রাম্য জীবন। ০৩।
রণদীপম বসু

ভিক্ষার নতুন স্টাইল ?

গলায় বেশ মোটাতাজা একটা গোখরো সাপ। দেখলেই গা রি রি করে ওঠে ! বিষদাঁত নেই বুঝাই যায়। নইলে এমন নির্বিবাদে ঝুলে থাকার কথা নয়। মিনিটে আটবার করে দুফালি লিকলিকে জিহ্বার ছলকানি দেখলে ছমছম করে ওঠে গা। যে মহিলার গলায় ওটা, বেদে যে সে নয় তাও চেহারায় স্পষ্ট। ইশারায় সাপটাকে দেখিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিলো সামনে। ভিক্ষা। তাহলে কি সাপের খাবার যোগাড়ে নেমেছে ! আহা, আজকাল নিজের পেট দেখিয়ে আর পাবলিকের মন ভেজানো যায় না ?

একটা কথাও বলানো যায় নি তার মুখ দিয়ে। ফ্যালফ্যাল চাউনি, আর ইশারায় সাপটাকে দেখিয়ে ভিক্ষা নেয়ার আকুতি। দেখে বড় কষ্ট হলো। সাধারণত ভিক্ষা আমি দেই না। কেন দেই না তা ভিন্ন প্রসঙ্গ।

দুটো টাকা বাড়িয়ে দিলাম। সাপের জন্য নয়। চেহারায় ভেসে ওঠা ক্ষুধাক্রান্ত মহিলাটির জন্য।

[somewherein]

# আহা জীবন ভ্রাম্য জীবন। ০২।


আহা জীবন ভ্রাম্য জীবন। ০২।
রণদীপম বসু

নগরীর ফুটপাথ ধরে আপনি হাঁটছেন। হঠাৎ থমকে গেলেন ! সামনেই একটা উন্মুক্ত নারী ! হয়তো উচ্ছিষ্টও। কেউ বলে পাগল, কেউ বলে বুড়ি, কেউ বা আরো কত কিছুই বলে। কিন্তু কেউ কি একবারও বলে, হোক সে মানসিক ভারসাম্যহীন, তবু গরু-ছাগল তো নয়, একটা বয়স্কা নারীই তো ! যেহেতু একজন নারী, মানুষ তো অবশ্যই। আর মানুষ যদি একমাত্র সভ্য প্রাণী হিসেবে নিজেদের নিয়ে এতোই ফুটানি করে, এটা কেমন সভ্যতা যেখানে জনাকীর্ণ রাস্তা ধরে একটা নারীকে তার শেষ অবলম্বন হারিয়ে এমন অপার নগ্নতা ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে খাবারের খুঁজে এদোকান ওদোকানে হাত পাততে পাততে অবাধ্য ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণের চেষ্টায় অনিবার্য বেরিয়ে আসতে হয় লোকালয়ে !
হয়তো এই নারীটি তার লজ্জাবোধ এখনো হারায়নি। এজন্যই পরিত্যক্ত একটা শার্টকেই গামছার মতো মুড়ে এক হাতে তার তীব্রতম লজ্জাস্থানটাকে ঢেকে রাখার দুঃসাধ্য চেষ্টাটুকু করেই যাচ্ছিল। যার লজ্জাবোধ এখনো জলাজঞ্জলি ঘটেনি, সে কি পাগল ?
না, সে পাগল নয়। পাগল আমরাই। কারণ লজ্জার একফোঁটাও আমাদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই আর ! নইলে ঐ নারীটিকে অন্তত তার লজ্জা বিক্রি করতে এভাবে বেরিয়ে আসতে হতো না। অথচ কোন না কোন নারীকে অবলম্বন করেই আমরা বেড়ে ওঠি পরিবার নামক একটা নিজস্ব ঠিকানায়। ঐ নারী কি সত্যিই ঠিকানা হারা ???

[somewherein]

[Budget] | দিন বদলের বিশাল বাজেট |


[অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা পিডিএফ]

| দিন বদলের বিশাল বাজেট |

আয় ও ব্যয়ের চরম উচ্চাভিলাষ দেখিয়ে অর্থমন্ত্রী ড. আবুল মাল আবদুল মুহিত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে আগামী ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছেন। মহাজোট সরকারের প্রথম বাজেটে সমাজের কমবেশি সবাইকে তুষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু রাজস্ব আয়ের যে প্রস্তাবগুলো করা হয়েছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এমনকি উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে কিনা এ নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। বাজেট প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী অর্থবানদের কিছুটা হলেও ছাড় দিয়েছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশকিছু পণ্যের করভার কমিয়ে সাধারণ মানুষকেও খানিকটা স্বস্তি দেয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। চেষ্টা করেছেন নাগরিক জীবন ও গ্রামীণ জীবনের সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার সৃষ্টি করতে। দিন বদলের চেষ্টায় আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়নে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, চলতি অর্থবছরের বাজেটের সঙ্গে আগামী অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটের অনেক ক্ষেত্রেই মিল রয়েছে। তবে রাজস্ব আয়ের যে বিরাট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তা কিভাবে সম্ভব তা এখন দেখার বিষয়। একই সঙ্গে তিনি উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন বাজেটের বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। অবশ্য অর্থমন্ত্রী ড. মুহিত তার বাজেট বক্তৃতায় নিজেও স্বীকার করেছেন, আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন হার আশাব্যঞ্জক নয়। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান। অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান প্রস্তাবিত বাজেটকে সামগ্রিকভাবে ভালো বাজেট উল্লেখ করে এর বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, বাজেটের আকার বড় কথা নয়, এর বাস্তবায়নই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে তিনি কালো টাকা সাদা করার নিয়মের ইতি টানতে বলেন। অন্যদিকে শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি আনিসুল হক ঘাটতি বাজেট পূরণে সরকারের ব্যাংকনির্ভরতা যেন না বেড়ে যায় সেদিকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তৈরি করেছেন একটি বড় ধরনের বড় ঘাটতির বাজেট। আয়ের সঙ্গে ব্যয় করার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। তিনি দিয়েছেন ১ লাখ ১৩ হাজার ৮১৯ কোটি টাকার বড় বাজেট। এ নতুন বাজেটে আয়ের তুলনায় ব্যয়ের পরিকল্পনা বেশি। অবশ্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়নের জন্য এ পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। যে কারণে ব্যয়ের অনেক পথ বেরিয়েছে। আর এ কারণে বাজেট বাস্তবায়নে ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
অর্থমন্ত্রী বাজেট ঘাটতি পূরণে ও ঝুঁকি এড়াতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে থাকছে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান। পরিকল্পনা অনুসারে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১৬ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। আর আয়ের যে পরিকল্পনা করেছেন, সেটি ঠিক না থাকলেও ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণের পরিমাণ বাড়তে পারে।
নতুন বাজেটে আমদানি শুল্কস্তরের পরিবর্তন হয়েছে। বেড়েছে সম্পূরক শুল্ক। তবে এর যুক্তিও রয়েছে। দেশীয় শিল্পকে সংরক্ষণ ও সুরক্ষা করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি বাজেটের প্রধান উদ্দেশ্য। একই সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল পণ্যের আমদানিতে বেশকিছুটা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আয়কর ও ভ্যাটের নেটওয়ার্ক বাড়ানো হয়েছে।
বাজেটে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে সংরক্ষণ, শিল্পায়ন, গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখা, খাদ্য নিরাপত্তা, পল্লী উন্নয়ন, দেশীয় প্রোটিনের চাহিদা পূরণ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন করা, নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করা, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা, শ্রমবাজার সম্প্রসারণ করা, পুঁজিবাজার বাড়ানো, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি, দুর্নীতি প্রতিরোধ, শিক্ষা ব্যবস্থাকে কর্মমুখী করাসহ আরও বিভিন্ন বিষয়কে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়েছে। যে কারণে প্রতিটি ক্ষেত্রেই বরাদ্দের পরিমাণ আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাজেট উপস্থাপনা
বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৩টায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সঙ্গে নিয়ে সংসদে প্রবেশ করেন। এ সময় তার পরনে ছিল কালো স্যুট ও লাল রঙের টাই। তার চেহারায় ছিল এক ধরনের আলোর আভা। কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে বাজেট বক্তৃতা শুরু হয়। তবে তিনি বাজেট উপস্থাপনের আগে স্পিকারের অনুমতি নেন। নতুন সরকারের ৫ মাসের মাথায় অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম বাজেট বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি এক সময় পরনের স্যুট খুলে ফেলেন। অর্থমন্ত্রী ৩টা ৩৪ মিনিটে বাজেট বক্তৃতা শুরু করেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এ সময় সংসদে অনুপস্থিত ছিল। অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে সরকারদলীয় সাংসদরা টেবিল চাপড়ে অর্থমন্ত্রীকে উৎসাহ দেন। অর্থমন্ত্রীর জন্য টেবিলের সামনে রাখা হয়েছিল টিসু বক্স। অর্থমন্ত্রী বক্তৃতা দিতে গিয়ে বেশ কয়েকবার পানি পান করেন।
রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান সংসদের নির্দিষ্ট আসনে বসে বাজেট উপস্থাপনা দেখেন ও শোনেন। তবে তিনি ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই জাতীয় সংসদ ত্যাগ করেন। সরকারের উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা, বিশিষ্ট নাগরিক, বিদেশী মিশনের কূটনীতিকরা সংসদে ভিআইপি গ্যালারিতে বসে বাজেট বক্তৃতা শোনেন। এর আগে সংসদ ভবনে মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠকে সংসদে উপস্থাপনার জন্য নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব ও ২০০৮-০৯ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট অনুমোদন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এ বৈঠক হয়। পরে রাষ্ট্রপতি বাজেট প্রস্তাবে সম্মতি দেন।
বাজেট পরিসংখ্যান
প্রস্তাবিত ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে উন্নয়ন ব্যয় ৩৩ হাজার ৫৯ কোটি টাকা ও অনুন্নয়ন ব্যয় ৭৭ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা। এ ব্যয়ের বিপরীতে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮৪ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন রাজস্বের পরিমাণ ৬১ হাজার কোটি টাকা। এতে করে সার্বিক ঘাটতি দাঁড়াবে ৩৪ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা। ফলে বাজেটে ঘাটতি হবে জিডিপির ৫ শতাংশ। এ ঘাটতি মেটানোর জন্য সরকারের অর্থায়ন উৎস হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত কর মোট বাজেটের ৫৩.৬ শতাংশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডবহির্ভূত কর ২.৬ শতাংশ। কর ব্যতীত প্রাপ্তি ১৩.৬ শতাংশ, অভ্যন্তরীণ অর্থায়ন ১৮.১ শতাংশ, বৈদেশিক ঋণ ৭.৬ শতাংশ ও বৈদেশিক অনুদান ৪.৫ শতাংশ।
সংশোধিত বাজেট
নতুন বাজেট প্রস্তাবের পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী চলতি ২০০৮-০৯ সংশোধিত বাজেটও উপস্থাপন করেন। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেট ধরা হয়েছিল ৯৯ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭৫ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে হয়েছে ৭৪ হাজার ১০৯ কোটি টাকা।
বাজেট বক্তৃতায় নতুন বিন্যাস
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত টানা কয়েক ঘণ্টা বাজেট বক্তৃতা দিলেও প্রথম অংশ ছিল কথামালার বাজেট। তিনি বক্তৃতার শুরুতেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করেছেন। স্মরণ করেছেন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। স্মরণ করেছেন শহীদ জাতীয় চার নেতা ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনসহ জনগণের অধিকার আদায়ের বিভিন্ন আন্দোলনে শাহাদতবরণকারীদের। এছাড়াও পিলখানায় নৃশংস ঘটনায় শাহাদতবরণকারী সেনা অফিসারদের সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করেন। অর্থমন্ত্রী বাজেট উপস্থাপন করতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে দাবি করেন। একই সঙ্গে গভীর কৃতজ্ঞতা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বাংলাদেশ গড়ার রূপকল্পের কথা বলেন। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর কথা বলেন। ২০২০ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জš§শতবার্ষিকীর কথা বলেন। এভাবেই তিনি বাজেট বক্তৃতায় প্রবেশ করেন। তিনি এমন বাংলাদেশ দেখতে চান, যেখানে স্থিতিশীল থাকবে দ্রব্যমূল্য। আয় দারিদ্র্য ও মানব দারিদ্র্য নেমে আসবে ন্যূনতম পর্যায়। সবার জন্য হবে শিক্ষা-স্বাস্থ্য। কমে আসবে সামাজিক বৈষম্য। প্রতিষ্ঠা পাবে অংশীদারিত্বমূলক গণতন্ত্র। এক সময় সেই বাংলাদেশ বিকশিত হবে ডিজিটাল বাংলাদেশে।
অর্থমন্ত্রী ১৯৭১, ১৯৭৫ সালের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে। সূচিত হয় সাফল্যের এক গৌরবগাথা। কিন্তু ২০০১ সালে দেশ ও জাতির অগ্রযাত্রা থেমে যায় বলে তিনি উল্লেখ করেন। অর্থমন্ত্রী অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে বলেন, কিছুটা অপরিণামদর্শিতার জন্য অনেকটা অকারণে ২টি বছর ক্ষমতায় বহাল থাকে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে প্রশংসাই করেন তিনি। নতুন দিগন্ত উšে§াচনের জন্য অর্থমন্ত্রী সরকারের পরিকল্পনা, ভাবনা ও কৌশলের কথা জানান অবলীলায়।
সরকারি বেসরকারি খাতে অংশীদারিত্বের বাজেট
সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে ২০১৩ সালে জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশে নিতে হলে প্রবৃদ্ধির বাহন হিসেবে অবকাঠামো উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি। সে কথা বিবেচনা করে বিনিয়োগ বাড়ানোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। তবে বিনিয়োগের জন্য বিপুল পুঁজি সরকারের একার পক্ষে জোগান দেয়া সম্ভব নয়। তাই সরকারি ও বেসরকারি খাতে অংশীদারিত্বের বাজেট তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর জন্য অবকাঠামো বিনিয়োগ তহবিল নামে তহবিল গঠন করা হবে। যেখানে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
কারা কি পেল
সামাজিক নিরাপত্তা হিসেবে বাজেটে দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য অর্থমন্ত্রী অনেকগুলো কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। একই সঙ্গে তিনি ঘোষণা করেছেন উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা বেকার তরুণ-তরুণীদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা রাখা। এছাড়াও প্রতি বছরের মতো নতুন বাজেটে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাদের ভাতা, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি ভাতা, এসিডদগ্ধ নারী ও প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসন তহবিল বাড়ানো হয়েছে। এর পাশাপাশি উপকারভোগীর সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। বয়স্ক ভাতা মাথাপিছু ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, উপকারভোগীর সংখ্যা ২০ লাখ থেকে সাড়ে ২২ লাখ। অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ৯০০ থেকে ১৫০০ টাকা করা হয়েছে। একই সঙ্গে উপকারভোগীর সংখ্যা ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার করা হয়েছে। অসচ্ছল প্রতিবন্ধীদের ভাতা জনপ্রতি ৩শ’ টাকা করা হয়েছে। উপকারভোগীর সংখ্যা ২ লাখ থেকে ২ লাখ ৬০ হাজার বাড়ানো হয়েছে। দরিদ্র মাতৃত্বকালীন ভাতা ৫০ থেকে ৩৫০ টাকা করা হয়েছে। এছাড়াও এতিমখানায় এতিম শিশুর খোরাকি বাড়ানো হয়েছে।
মহিলা ও মুক্তিযোদ্ধাদের আÍকর্মসংস্থানের জন্য ২০ কোটি টাকা, এসিডদগ্ধ মহিলা ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসনের জন্য ২ কোটি ও পোলট্রি খামারিদের সহায়তার জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
ঘরে ফেরা কর্মসূচির জন্য একটি বাড়ি একটি খামার কর্মসূচি শুরু করা হচ্ছে। এতে খাসজমি বিতরণ, গৃহায়ন, কর্মসংস্থানের সুবিধা হবে। অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থানের জন্য একটি বড় ধরনের কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। যেখানে বরাদ্দ করা হয়েছে ১ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। ভিক্ষাবৃত্তি অবসানের জন্য প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে।
কৃষি খাতে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা দেয়া হয়েছে ১৮৫ কোটি ২১ লাখ টাকা। ১২ হাজার পশুসম্পদ খামারিকে প্রণোদনা সহায়তা দেয়া হবে। যার পরিমাণ ৭১৬ কোটি টাকা। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের জন্য ৫ লাখ ৭৮ হাজার ৪শ’ পরিবারকে উপকারভোগী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য টেস্ট রিলিফ খাতে ৪ লাখ মেট্রিক টন, ভিজিএফ ৫ লাখ ৫ হাজার টন, কাজের বিনিময়ে খাদ্য খাতে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ও ভিজিডি খাতে ২ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। স্বল্প ও মধ্যম আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য আগামী ৩ বছরে ২২ হাজার ৮০০টি প্লট ও ২৬ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হবে।
বরাদ্দে অগ্রাধিকার
নতুন বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ চলে যাচ্ছে সুদে। যার পরিমাণ মোট বাজেটের ১৩.৯ শতাংশ। এর পরে রয়েছে জনপ্রশাসন, যা মোট বাজেটের ১৬.২ শতাংশ। শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ ১২.৬ শতাংশ। এভাবেই সামাজিক নিরাপত্তা কল্যাণ খাতে ৭.৮ শতাংশ, জনশৃংখলা ও নিরাপত্তা খাতে ৫.৫ শতাংশ, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন খাতে ৭.৭ শতাংশ, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ৬.৫ শতাংশ, কৃষি খাতে ৭.৯ শতাংশ, স্বাস্থ্য খাতে ৬.১ শতাংশ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ৩.৮ শতাংশ, প্রতিরক্ষা ৬.২ শতাংশ। সবচেয়ে কম বরাদ্দ রয়েছে বিনোদন, সংস্কৃতি, ধর্ম, শিল্প ও অর্থনৈতিক সার্ভিস। যার পরিমাণ মোট বাজেটের ০.৮ শতাংশ।
রাজস্ব কার্যক্রম
নতুন বাজেটে রাজস্ব কার্যক্রমের ওপর বেশকিছু লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সামাজিক সুবিচার, ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করা, দেশীয় শিল্পকে ন্যায্য প্রতিরক্ষণ প্রদান, কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ সাধন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করা, অধিকতর বিনিয়োগ আকর্ষণ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন সাধন করা, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্বয়ংক্রিয় কর রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থা প্রবর্তন ও কর ভিত্তি সম্প্রসারণ করে কর প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধি করা।
আয়কর ক্ষেত্রে সিনিয়র বাংলাদেশী করদাতাদের ব্যক্তিগত করের বোঝা লাঘব করার জন্য তাদের বিদ্যমান বয়সসীমা ৭০ থেকে কমিয়ে ৬৫ বছর করাসহ ৭টি প্রস্তাব করা হয়েছে। আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি করার জন্য ন্যাশনাল অ্যাক্ট ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। আয়করের আওতা বাড়ানোর জন্য নতুন করদাতা শনাক্ত করার কর্মসূচি হিসেবে বিভিন্ন জেলায় একদিকে জরিপ ও পর্যায়ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা কেন্দ্রে ও স্থানে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
আমদানি শুল্কের ক্ষেত্রে কৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য বীজ ও আমদানিকৃত প্রধান প্রধান খাদ্যশস্যের ওপর শূন্য শতাংশ আমদানি শুল্ক হার অব্যাহত থাকবে। একই সঙ্গে প্রধান প্রধান খাদ্যদ্রব্য, সার, বীজ, ওষুধ ও কাঁচা তুলার ক্ষেত্রে বর্তমানে যে শুল্কহার রয়েছে তা অপরিবর্তিত থাকবে। বিলাসবহুল পণ্য ও জনস্বাস্থ্যহানিকর পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করার জন্য ২৫ শতাংশ শুল্কস্তরের পণ্যসামগ্রীর ওপর ৫ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি আরোপ করা হচ্ছে। বিলাসবহুল যানবাহন আমদানি নিরুৎসাহিত করার জন্য সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধিসহ শুল্ক কাঠামো পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে। মোবাইল ফোনের ওপর গুণগত মান নির্বিশেষে সেট প্রতি ৩০০ টাকা হারে মূল্যভিত্তিক ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য ব্যাপক কমে যাওয়ায় দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানকে সুরক্ষার জন্য বেশকিছু পণ্যের ওপর শুল্ক হার বাড়ানো হয়েছে।
বাজেটে অর্থমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন, বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। তবে সরকারকে যৌক্তিক সময়টুকু দেয়া সমীচীন হবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বাজেট তৈরিতে বিদ্যমান বাস্তবতা ও সময়ের দাবি অনুসরণ করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। কোন আবেগ বা উচ্চাভিলাষী বাজেট তৈরি করেননি বলে তিনি বাজেট বক্তৃতায় বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।
[যুগান্তর রিপোর্ট]

# বিনিয়োগ করলে তিন বছরে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ
নজিরবিহীন এক উদ্যোগে ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে কোন প্রশ্ন ছাড়া তিন বছরের জন্য অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আগামী ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে তৈরি পোশাক, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, টেক্সটাইল, স্পিনিং, ওষুধ ও চামড়াজাত পণ্যসহ ৪২টি খাতে বিনিয়োগ করলে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার প্রস্তাব করেছেন। এর আগে বছরওয়ারি ভিত্তিতে এ ধরনের সুযোগ দেয়া হতো। এর মাধ্যমে সরকার দৃশ্যত সম্ভাব্য সর্বোচ্চ পরিমাণ অপ্রদর্শিত অর্থ অর্থনীতির মূল খাতে নিয়ে আসার চেষ্টা করবে। নদী বা সমুদ্রবন্দর, কনটেইনার টার্মিনাল, অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো অথবা কনটেইনার ফ্রেইট স্টেশন, মনোরেল, এলিভেটেড রোড, পাতাল রেল নির্মাণসহ ভৌত অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও একই হারে কর দিয়ে অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ দেয়া হয়েছে নতুন বাজেটে।
যেসব শিল্পে অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করা যাবে : এগ্রো প্রসেসিং শিল্প (ফল প্রক্রিয়াকরণ, বেবি কর্ন প্যাকেটজাতকরণ শিল্প, ফলের জুস প্রস্তুতকারী, রাবার শিল্প), টেক্সটাইল, স্পিনিং, টেক্সটাইল মেশিনারিজ, গার্মেন্টস, চামড়াজাত পণ্য, খেলনা, আসবাবপত্র, তথ্য-প্রযুক্তি, ফার্মাসিউটিক্যাল, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প, মেলামাইন, প্লাস্টিক দ্রব্যাদি, সিরামিক, স্যানিটারি ওয়্যার, আয়রন আকরিক থেকে স্টিল, এমএস রড, সিআই শিট, সার, কীটনাশক, কম্পিউটার হার্ডওয়্যার, পেট্রো কেমিক্যালস, কৃষি যন্ত্রপাতি, বয়লার, ওষুধ শিল্প, রাসায়নিক দ্রব্য ও ফার্মাসিউটিক্যালসের মৌলিক উপাদান, কম্প্রেসার উৎপাদনে নিয়োজিত শিল্প, জাহাজ নির্মাণ শিল্প, ডায়মন্ড কাটিং শিল্প, চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ, দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, অ্যাকুমুলেটর ও ব্যাটারি প্রস্তুত শিল্প, ট্যুর অপারেটরস, এনার্জি, সেভিংস বাল্ব প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, পরিত্যক্ত বর্জ্য থেকে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনে নিয়োজিত শিল্প, পাটজাত পণ্য, পরিবেশবান্ধব হিসেবে রি-সাইক্লিং শিল্প, ভেষজ ওষুধ শিল্প, মৌলিক কেমিক্যাল ও রং, কসমেটিক্স ও টয়লেট্রিজ শিল্প, পর্যটন শিল্প, ফুটওয়্যার, এমএস বিলেট উৎপাদন শিল্প অথবা অফিসিয়াল গেজেট দ্বারা প্রকাশিত সরকার কর্তৃক নির্ধারিত অন্য যে কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান।
ভৌত অবকাঠামো-নদী বা সমুদ্রবন্দর, কনটেইনার টার্মিনাল, অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো অথবা কনটেইনার ফ্রেইট স্টেশন, তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল ও ট্রান্সমিশন লাইন, সিএনজি টার্মিনাল ও ট্রান্সমিশন লাইন, গ্যাস পাইপলাইন, ফ্লাইওভার, এলিভেটেড রোড, মনোরেল, পাতাল রেল, মোবাইল ফোন ছাড়া টেলিফোন অবকাঠামো, বৃহৎ পানি শোধনাগার প্লান্ট ও পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ, বর্জ্য পরিশোধনাগার প্লান্ট, সৌরশক্তি প্লান্ট অথবা অফিসিয়াল গেজেট দ্বারা প্রকাশিত সরকার কর্তৃক নির্ধারিত অন্য যে কোন ভৌত অবকাঠামো।

# দাম বাড়বে:
প্রস্তাবিত বাজেটে আমদানি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক এবং ভ্যাটের হার বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন অনেক পণ্যে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। মূলত স্থানীয় শিল্পের সংরক্ষণ, অপ্রয়োজনীয় এবং বিলাস পণ্য হিসেবে চিহ্নিত জনসাধারণের বহুল ব্যবহার্য প্রায় ১৫২টি পণ্যের দাম বাড়বে। এসব পণ্যের উল্লেখযোগ্য হচ্ছেÑ মোবাইল সিম, কোমল পানীয়, বিড়ি, সিগারেট, জর্দা, গুল, বাথরুম ফিটিংস, নতুন আসবাবপত্র, সব ধরনের ভেষজ ওষুধ, নিউজপ্রিন্ট, এয়ারকন্ডিশনার, রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজ, সেলুলার ফোন সেট, সব ধরনের মোটরকার, মোটরসাইকেল, চশমার ফ্রেম ও খাপ, মশার কয়েল, ব্রেড, পেস্ট্রি, কেকস, বিস্কুট, ইমিটেশন জুয়েলারি, স্যুটকেস, ভ্যানিটি ব্যাগ, ব্রিফকেস, ড্রাইসেল ব্যাটারি, ট্রাংক, স্কুলব্যাগ, বাইনোকুলার ব্যাগ, ক্যামেরা ব্যাগ, মিউজিক্যাল ইন্সট্র-মেন্টস বক্স, অস্ত্র ও হোলস্টার খাপ, ট্রাভেলিং ব্যাগ, টয়লেট ব্যাগস, খাদ্য ও বেভারেজ ব্যাগ, র‌্যাকসেক, হ্যান্ডব্যাগ, শপিং ব্যাগ, ওয়ালেট, পার্স, সিগারেট কেইস, টোব্যাকো পাউস, টুল ব্যাগস, স্পোর্টস ব্যাগস, বোটল কেসেস, জুয়েলারি বক্স, পাউডার বক্স, কাটলারি কেসেস এবং সমজাতীয় কনটেইনার, পার্টিকেল বোর্ড, ওরিয়েনটেন্ট স্ট্রেন্ট বোর্ড, ফাইবার বোর্ড, প্লাইউড, ভেনিয়ার্ড প্যানেল, করোগেটেড পেপার এবং পেপার বোর্ডের কার্টন ও বক্স, ফুটওয়্যার, চামড়ার পট্টি, তরল গ্লুুকোজ, গ্লুকোজ এবং গ্লুুকোজ সিরাপ, বেকারি পণ্য, কোকোয়া বিস্কুট, ওয়েফার বিস্কুট, ডেন্টাল পেট বাসসহ সব ধরনের টুথব্রাশ, পার্সেলিনের তৈরি টেবল ওয়্যার, অন্যান্য গৃহস্থালি ও টয়লেট পণ্য, সিরামিক টেবল ওয়্যার, কিচেন ওয়্যার, গৃহস্থালি ও টয়লেট পণ্য, অমসৃণ সিরামিকস ওয়াল টাইলস, মোজাইক কিউব এবং সমজাতীয় মসৃণ সিরামিকস ওয়াল টাইলস, মোজাইক কিউব এবং সমজাতীয় সিরামিক সিংকস, ওয়াশ বেসিন পেডেস্ট্রাল, বাথ, ওয়াটার ক্লোজেট প্যানস, এয়ারকন্ডিশনিং মেশিন (সিবিইউ এবং সিকেডি), ইলেকট্রিক ট্যাবল, ডেস্ক, বেডসাইড অথবা ফ্লোর স্ট্যান্ডিং ল্যাম্পস, ক্রিসমাস ট্রিতে ব্যবহƒত লাইটিং সেট, অন্যান্য ল্যাম্প ও লাইটিং ফিটিং, সব ধরনের ল্যাম্প, গ্লাসের তৈরি ল্যাম্প পার্টস, প্লাস্টিকের তৈরি ল্যাম্প পার্টস, কুকুর-বিড়ালের সব ধরনের খাদ্য।

# দাম কমবে:
প্রস্তাবিত বাজেটে আমদানি শুল্ক হ্রাস ও ভ্যাট অব্যাহতির কারণে বেশকিছু পণ্য ও সেবার দাম কমবে। এর মধ্যে রয়েছেÑ ঢেউটিন, দেশে উৎপাদিত গুঁড়োদুধ, হাতে তৈরি কেক, ক্যান্সার নিরোধক ওষুধ, দেশে তৈরি ফ্রিজ, মোটর কার, টিভি, জেনারেটর, বিভিন্ন ধরনের খাদ্য তৈরির উপকরণ, সোলার প্যানেল, ভুট্টাবীজ, শিল্পের কাঁচামাল, রাবার ও প্লাস্টিক, শিক্ষা বিষয়ক বই, ফ্লোরোসেন্ট এনার্জি সেভিং বাল্ব ও যন্ত্রাংশ, ফটোভোল্টিক সেল, ৩০০০ ডিডব্লিউটি ক্ষমতার সাগরে চলাচলের জাহাজ, অর্থোপেডিক চিকিৎসার ওষুধ, পাল্প, ফসফরিক এসিড, হাইব্রিড মোটরকার, বিভিন্ন ধরনের ওষুধের কাঁচামাল সালফার, সাবলাইম বা গুঁড়ো সালফার, টাইটানিয়াম ডাই অক্সাইডের ওপর পিগমেন্ট ও অংশবিশেষ, রাবার ও প্লাস্টিক, ফটোভোল্টিক সেল এসেম্বল ইন মডিউলস অর মেইড আপ ইন্টু প্যানেল, মেনগেনেজ ওরস এন্ড কনসেনট্রেটস।

# পে-কমিশনের সুপারিশ জুলাই থেকে বাস্তবায়ন
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, বেতন কমিশনের সুপারিশ আগামী জুলাই থেকে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে। ২০০৮ সালের জুলাই থেকে যেসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে গেছেন, তারাও এ বেতন কমিশনের সুপারিশের আলোকে নির্ধারিত বেতন-ভাতাদির সুবিধা পাবেন। বৃহস্পতিবার বিকালে জাতীয় সংসদে আসন্ন ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনকালে তিনি একথা বলেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, উন্নত কর্মপরিবেশ এবং সৎ ও সম্মানজনক জীবনধারণের লক্ষ্যে বেতন বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে গঠন করা বেতন কমিশনের সুপারিশের আলোকে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
পেনশন পুনঃসহজীকরণ
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা পেনশন পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রায়শই নানা হয়রানির শিকার হন। এ বিড়ম্বনা লাঘবের জন্য পেনশন মঞ্জুরি ও পরিশোধ সংক্রান্ত বিধি সহজ করার লক্ষ্যে নির্দেশমালা জারি করা হয়েছে। এ নির্দেশ অনুসরণ করা হলে পেনশন কেস প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও নিষ্পত্তিকরণ আগের থেকে অনেক দ্রুত হবে।

# আগামী অর্থবছরে কোন বেসরকারিকরণ হবে না
সরকার আগামী অর্থবছরে কোন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারিকরণ করবে না। একই সঙ্গে সম্ভাব্য কর্মচ্যুত শ্রমিকদের জন্য বিকল্প কোন ব্যবস্থা না করে কোন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ ঘোষণা করা হবে না। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তব্যে সরকারের ওই অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী জানান, বেসরকারি খাতের উন্নয়ন ও প্রসার তারা চান। তবে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং কর্মসংস্থান সৃজনে বর্তমান সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে এবং আগামী অর্থবছরের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তর আবহ বিবেচনায় রেখে আগামী অর্থবছর কোন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানকে বিরাষ্ট্রীয়করণ সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তিনি বলেন, সচেতন সরকারি হস্তক্ষেপবিহীন মুক্তবাজার অর্থনীতি টেকসই নয়। তাই শিল্প-বাণিজ্যে সরকার নিবিড় পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করবে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান যাতে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে সেই লক্ষ্যে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কেইস-টু-কেইস ভিত্তিতে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে।

# আর কোন ইপিজেড ও বিসিক শিল্প এস্টেট হবে না
আর কোন ইপিজেড বা বিসিক শিল্প এস্টেট খোলা হবে না। এর পরিবর্তে বেশ কিছু এলাকা নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলা হবে। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তব্যে ওই ঘোষণা দিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, অর্থনৈতিক জোন একদিকে পশ্চাৎপদ এলাকা অন্যদিকে শিল্প-সম্ভাবনাময় এলাকাকে শিল্পে বা কৃষিতে বিকশিত করবে। সেজন্য অর্থনৈতিক জোনে ভৌত অবকাঠামো উন্নীত করা হবে। বিশেষ করে যোগাযোগ এবং জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করবে সরকার।
তিনি বলেন, বর্তমান ইপিজেড বা বিসিক শিল্প এস্টেট বহাল থাকবে। তবে প্রচলিত সুযোগ-সুবিধা পেতে হলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেখানে সব প্রতিষ্ঠানকে উৎপাদনে যেতে হবে। অর্থনৈতিক জোনের রূপরেখা এখন চূড়ান্তকরণ হচ্ছে এবং এর সঙ্গে ইপিজেড সম্পর্কেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।

# মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত ভাতার আওতায় আনার প্রস্তাব
জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত ভাতার আওতায় আনার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানীভাতা ৪০ শতাংশ বৃদ্ধিরও প্রস্তাব করা হয়েছে নতুন বাজেটে। মুক্তিযোদ্ধাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সমুন্নত রাখা বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার। মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও স্মৃতি সংরক্ষণের বিষয়টি সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচন করবে। ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত নাগরিক হিসেবে রেল, বাস ও লঞ্চে বিনামূল্যে চলাচলের সুযোগ দেয়া হবে।
অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেন, সরকার ইতিমধ্যে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হালনাগাদ করে গেজেট আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে শ্রেণীভুক্ত রাষ্ট্রীয় খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানীভাতা ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এজন্য ৫৯ কোটি ১ লাখ টাকা রবাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় সম্মানীভাতাপ্রাপ্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা বাবদ আরও ২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। তাদের রেশনের জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়নেরও তাগিদ দেয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী জানান, ২০০৯-১০ সালে ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২৫ হাজারে উন্নীত হবে।
বাজেট ভাষণে বলা হয়, বর্তমান সরকার বিদ্যমান আইনের অধীনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা চালু করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দেখানো এবং তাদের ক্ষোভ নিরসনে এটা উত্তম উদ্যোগ। সেই সঙ্গে দেশের হাজার হাজার গণকবর চিহ্নিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

# মন্দার কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমবে
বিশ্ব মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে আগামী অর্থবছরে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি কম হবে। বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যে বলা হয়েছে, মন্দার প্রেক্ষাপটে আগামী অর্থবছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার হবে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে পরবর্তী দুই অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধি আবার ঊর্ধ্বমুখিতা লাভ করবে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গত অর্থবছরে (২০০৮-০৯) যে বাজেট পেশ করেছিল তাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ অনুমান করা হয়েছিল। অর্থবছর শেষ হওয়ার আগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) চূড়ান্ত প্রাক্কলনে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। এর আগে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বিশ্ব মন্দার অভিঘাত আগামী অর্থবছরে রফতানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে ২০০৯ সালে সার্বিকভাবে মোট বিশ্ব উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি এবং উন্নত দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি যেখানে ঋণাÍক হবে মর্মে পূর্বাভাস করা হয়েছে, সেখানে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের ৫ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্থনীতির অন্তর্নির্হিত শক্তির পরিচায়ক। তবে মন্দার গভীরতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং মন্দা ২০১০ সালের শেষার্ধ পর্যন্ত প্রলম্বিত হওয়ার পূর্বাভাস থাকায় আগামী অর্থবছর বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এক চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে আগামী অর্থবছরের প্রথম ৬ মাস অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত সংকটপূর্ণ।

# বাজেট প্রতিক্রিয়া:

রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে
আকবর আলি খান

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, বাজেট অনেক উচ্চাভিলাষী হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা তা অর্জিত হবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তার পুরোটাই বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়েও তিনি সন্দিহান।
তিনি বলেন, বাজেটের কয়েকটি ভালো দিক রয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা গরিব লোকের কাজে লাগবে। কৃষি খাতকেও বাজেটে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।
ড. আকবর আলি খান আরও জানান, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় যাতে না বাড়ে এবং প্রয়োজনীয় ব্যয় যাতে গুণগতভাবে কার্যকর হয় সেদিকে সরকারকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। সরকারকে বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে খুবই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) কোন নতুন বিষয় নয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পিপিপি প্রকল্প ছিল। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নপুষ্ট পিপিপি প্রকল্পে দুই-তৃতীয়াংশ অর্থ ব্যয় হয়নি। বিদ্যুৎ খাতে পিপিপি’র মাধ্যমে বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা সহজ হবে না। কারণ বিদ্যুতের জন্য গ্যাস দরকার। কয়লা উত্তোলন নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য অপেক্ষা না করে সরকারের উচিত বিদ্যুৎ খাতে নিজস্ব বিনিয়োগ বাড়ানো।

ইতিবাচক বাজেট তবে একটু উচ্চাভিলাষী
ড. ফরাসউদ্দিন

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, আগামী অর্থবছরের বাজেট সার্বিকভাবে ইতিবাচক। তবে একটু উচ্চাভিলাষীও বটে। রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তা অর্জন হবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। এছাড়া আগামী ৪ থেকে ৫ বছরে ৪ হাজার ১শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন আরও বলেন, আগামী অর্থবছরে বড় আকারের এডিপি বাস্তবায়ন নিয়ে তিনি চিন্তিত নন। কারণ গত দুই/ তিন বছর দেশে এত বেশি অনিশ্চয়তা ছিল যে, এর মাঝে এডিপি বাস্তবায়ন হওয়ার সুযোগ কম ছিল। এখন অনুপ্রেরণার সময়। উৎসাহ-উদ্দীপনার সময়। সরকার সচেতনতার সঙ্গে কর্মসূচি হাতে নিলে এডিপি বাস্তবায়ন সম্ভব। সরকারকে এডিপি থেকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে। তিনি বলেন, বাজেটে কৃষি খাতের উন্নয়নে খুবই ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ঘরে ফেরা কর্মসূচির মতো নতুন বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। এসব কর্মসূচি সামাজিক নিরাপত্তা জোরদার করবে।

বাজেটের আকার বড় কথা নয়, বাস্তবায়নই গুরুত্বপূর্ণ
ড. কাজী খলীকুজ্জমান

অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ায় নিয়মিত করদাতারা নিরুৎসাহিত হবে। তিনি বলেন, প্রতিবছর এভাবে সুযোগ দেয়া ঠিক হচ্ছে না। এ নিয়ম শেষ হওয়া উচিত। ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ আরও বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের আলোকেই আগামী ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেট ঘোষিত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে এটি ভালো বাজেট হলেও বাস্তবায়নই হচ্ছে এ বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ বাজেট বাস্তবায়নের জন্য অর্থবছরের শুরু থেকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। তা না হলে বাজেট ঘোষণাতেই থেকে যাবে।
বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ায় হতাশা প্রকাশ করে দেশের বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এর ফলে নিয়মিত করদাতারা নিরুৎসাহিত হবেন। কালো টাকার মালিকরা আরও বেশি কালো টাকা বানাতে উৎসাহিত হবেন। তিনি বলেন, নিয়মিত করদাতারা বেশি কর দিয়ে থাকেন। এখন কালো টাকার মালিকরা যদি মাত্র ১০ শতাংশ হারে জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ পান তাহলে তারা এ সুযোগটাই বেশি নিতে চাইবেন। প্রতিবছর এভাবে সুযোগ দেয়া ঠিক হচ্ছে না। এ নিয়ম শেষ হওয়া উচিত। তিনি বলেন, আমি আশা করব এ বছরই সরকার শেষ সুযোগ দেবে। তবে এবার কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ দেয়া হচ্ছে তা যেন উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, বাজেটের আকার বড় কথা নয়। বাজেট বাস্তবায়নই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাজেট বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজেট বাস্তবায়নের জন্য উন্নয়ন প্রশাসনকে আরও বেশি কার্যকর করে গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে বাজেট ঘোষণাতেই থেকে যাবে।
ড. কাজী খলিকুজ্জমান বলেন, বাজেট বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে জুনের প্রথম দিন থেকেই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আর তাহলেই বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। বাজেটের আকার লক্ষ কাটি টাকা ছাড়িয়ে গেলেও জাতীয় আয়ের তুলনায় তা বড় কিছু না। বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা, যা আমাদের জাতীয় আয়ের মাত্র ১৪-১৫ শতাংশ। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় তা অনেক কম। প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, পাকিস্তানের রাজস্ব আদায় তাদের জাতীয় আয়ের ২৪-২৫ শতাংশ। আমরা এখন সাড়ে ১০ শতাংশ আদায় করি। রাজস্ব আদায় বাড়াতেই হবে। তবে রাজস্ব আদায় আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দেশে কর সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। কর আদায় ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। এখানে যে ধরনের দুর্নীতি হচ্ছে তা বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। সবাইকেই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। যেসব খাত বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারবে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তা হলে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। তিনি বলেন, আমি চাই বাজেট ঘোষণার প্রথম ছয় মাসে ৫০ ভাগ বাজেট বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হোক। একই ধারাবাহিকতায় নয় মাসে ৭৫ শতাংশ এবং বছর শেষে শতভাগ বাজেট বাস্তবায়ন হোক।
তিনি বলেন, বাজেটে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কৃষি এবং গ্রামীণ অর্থনীতির, বিদ্যুৎসহ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের উল্লিখিত খাতগুলোতে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাজেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটিও বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।


বাজেট বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে সরকার
ড. জায়েদ বখত

আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ড. জায়েদ বখত বলেছেন, বড় আকারের এ বাজেট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকার বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। সরকারকে যে কোনভাবেই সরকারি ব্যয়কে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। তা না হলে উন্নয়ন ব্যয় বিশেষত সামাজিক নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান প্রকল্পগুলোর সুফল টার্গেট গ্র“পের কাছে পৌঁছাবে না।
জায়েদ বখত বলেন, আগামী অর্থবছরের জন্য একটি সম্প্রসারণমূলক বাজেট মূলত তিনটি কারণে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথমত. নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণ, দ্বিতীয়ত. বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সম্ভাব্য বিরূপ অভিঘাত মোকাবেলা এবং তৃতীয়ত. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করা। সরকারের এসব উদ্দেশ্যের সঙ্গে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়। তবে বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারকে কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। প্রথম চ্যালেঞ্জ হল অর্থায়ন। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, রাজস্ব আদায় প্রতি বছর ১০ থেকে ১২ শতাংশ বাড়ে। আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি আরও অনেক বেশি ধরা হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যাবে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য দুর্নীতিবিরোধী অভিযান আরও বেগবান করতে হবে। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হল, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের সক্ষমতা। এর আগে এডিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কোন বছরই ১৮ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হয় না। আগামী অর্থবছরে ৩০ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা খরচের লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। এত বড় এডিপি বাস্তবায়নের সক্ষমতা সরকারের রয়েছে কিনা তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি হলে সম্পদের অপচয় হবে।
ড. জায়েদ বখত মনে করেন, বাজেট বাস্তবায়নের তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হল সামাজিক নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান প্রকল্পগুলো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা। উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক প্রভাব থাকলে তা উন্নয়নের প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে না।
তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে কালোটাকা সাদা করার পদক্ষেপ সঠিক হয়নি। এর মাধ্যমে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারী কিছু লোকজন লাভবান হবে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে এর কোন সুফল নেই।

রাজস্ব আহরণের প্রস্তাবগুলো অসামঞ্জস্যপূর্ণ
মির্জা আজিজুল ইসলাম

প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, চলতি অর্থবছরের বাজেটের সঙ্গে আগামী অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটের অনেক ক্ষেত্রেই মিল রয়েছে। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ঘোষিত বাজেট আর আগামী অর্থবছরের বাজেটের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। তবে আগামী অর্থবছরের বাজেটের বেশ কয়েকটি বিষয়ে তিনি দ্বিমত পোষণ করেছেন।
তিনি বলেন, রাজস্ব আয়ের যে বিরাট লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তার সঙ্গে রাজস্ব আহরণের প্রস্তাবগুলো খুবই অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই করের আওতা কমানো হয়েছে, অথবা কর হার কমানো হয়েছে। কাজেই রাজস্ব আহরণ আসলে কিভাবে বাড়বে সেটিই একটি বড় প্রশ্ন। তিনি বলেন, কোন প্রশ্ন ছাড়াই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে বাজেটে। এটা খুবই অনৈতিক হয়েছে। আর উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন বাজেটের বাস্তবায়ন নিয়েও তিনি সংশয় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আমাদের বাস্তবায়নের যে দক্ষতা তাতে করে বলা যায় এটি বাস্তবায়ন হবে না।
বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে আগামী ২০০৯-১০ অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রস্তাবনা পেশের পর যুগান্তরকে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম এসব কথা বলেন।
ড. মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কোন বাজেটই সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। এবারের বাজেটেও হয়তো কেউ কেউ অসন্তুষ্ট থেকে যাবে। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের বাজেটÑ তার সঙ্গে এবারের ঘোষিত বাজেটের খুব বেশি তফাৎ নেই। সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকের প্রক্ষেপণ, অর্থায়নের উৎস ও সম্পদের ব্যবহার প্রায় ক্ষেত্রে কাছাকাছিই আছে।
তবে অনেক ক্ষেত্রে তিনি ভিন্নমত পোষণ করেন। যেমনÑ সরকারের যে দক্ষতা তাতে ৩০ হাজার ৫শ’ কোটি টাকার যে বিশাল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ঘোষণা করা হয়েছে, সেটা পুরো বাস্তবায়নের সম্ভাবনা নেই। আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাটের অনেক জায়গায় করের আওতা হয় ছোট করা হয়েছে অথবা কর হার কমেছে। তাই রাজস্ব আয়ের যে টার্গেট দেয়া হয়েছে, সেটা কর আহরণের অন্যান্য প্রস্তাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কাজেই এ নিয়ে ভবিষ্যতে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। বিশ্বমন্দার আলোকে বাজেটে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ সম্পর্কে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছুই বাজেটে বলা নেই।
বিদ্যুৎ খাতের বরাদ্দ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের সময় বিদ্যুতে বরাদ্দ দুই নম্বরে ছিল। এবার সেটা তিন নম্বরে নেমে এসেছে। চলতি এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ১৫ শতাংশের ওপর। এবার সেটা ১৩ শতাংশের কিছু ওপর। সাবেক এই অর্থ উপদেষ্টা বলেন, শিক্ষা ও তথ্য প্রযুক্তিতে বরাদ্দ বেড়েছে। এটা ভালো। আগে ছিল ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। এবার সেটা বেড়ে হয়েছে ১৩ শতাংশে। সামাজিক নিরাপত্তায় ব্যয় আনুপাতিক হারে কমেছে। আমাদের সময় ঘোষিত বাজেটে এটা ছিল ১৬ দশমিক ৯ শতাংশের মতো, এবার সেটা কমে হয়েছে ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। তবে জিনিসপত্রের দাম ইতিমধ্যে অনেকটা কমেছে। জনগণের কষ্টও কিছুটা লাঘব হয়েছে। সে হিসেবে সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ ঠিকই আছে। তিনি বলেন, বাজেটের যেখানে যা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, সরকারকে সেটার পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকারকে অবশ্যই বাস্তবায়নের ওপর বেশি জোর দিতে হবে।
বাজেটে ঘোষিত সামষ্টিক অর্থনীতির প্রক্ষেপণ বা লক্ষ্যগুলো প্রসঙ্গে মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এগুলো তার কাছে বাস্তবসম্মত বলেই মনে হয়। কয়েকদিন আগে তিনি আগামী অর্থবছরের জন্য যেসব প্রক্ষেপণ করেছিলেন, সেগুলোর সঙ্গে বাজেটে ঘোষিত প্রক্ষেপণগুলো প্রায় হুবহু মিলে গেছে। যেমনÑ আগামী অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধি হারের টার্গেট সাড়ে ৫ শতাংশ, বাজেট ঘাটতি জিডিপি’র ৫ শতাংশ এবং বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশÑ এসব প্রক্ষেপণ ঠিকই রয়েছে।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার ঘোর বিরোধিতা করে তিনি বলেন, এটা সম্পূর্ণ অনৈতিক হয়েছে। দুটো কারণে এ সুযোগটি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। প্রথমত, ২০১২ সাল পর্যন্ত এ সুযোগ দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, কোন প্রশ্ন ছাড়াই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বৈধভাবে উপার্জিত অথচ করের আওতায় আসেনি এমন সম্পদকে ওই বছরের নির্দিষ্ট হারে দেয়া কর ও জরিমানা দিয়ে বৈধ করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল।
আগামী বাজেটে চলতি বছরের মতো ঋণের সুদ পরিশোধে আবারও সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা বড় কোন চিন্তার বিষয় নয়। কারণ ঘাটতি অর্থায়নের জন্যই ঋণ নেয়া হয়। আর সুদের বেশিরভাগই পরিশোধ করা হয় অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া ঋণের ক্ষেত্রে। সুদ পরিশোধের প্রায় ৮০ শতাংশই অভ্যন্তরীণ ঋণের। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আগে নেয়া ঋণ কোন উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহারের পরই তা আবার সুদসহ ফেরত দেয়া হচ্ছে। অভ্যন্তরীণভাবেই এটা শুধু ট্রান্সফার হচ্ছে। অর্থনীতির জন্যও এটা খারাপ নয়। তবে ট্রান্সফারের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হলে সেটি দেখতে হবে।

ঢাকা চেম্বার
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। ঢাকা চেম্বার প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, বাজেটে কৃষি ও পল্লী উন্নয়নে গুরুত্ব আরোপ করায় তা জনমনে উৎসাহ ও পরিতৃপ্তি সৃষ্টি করেছে। বাজেটের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য গণমুখী।
ঢাকা চেম্বার বলেছে, বাজেটে খাদ্য নিরাপত্তার বন্দোবস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তবে কার্যকর বিতরণ ব্যবস্থায় পদক্ষেপ গ্রহণ করা না গেলে এর সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হবে। ঘাটতি অর্থায়ন সম্পর্কে ঢাকা চেম্বার বলেছে, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বেসরকারি খাতের প্রসারকে ব্যাহত করবে, অন্যদিকে তা মূল্যস্ফীতি বাড়াতে ভূমিকা রাখবে। মন্দা মোকাবেলায় সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও এর প্রভাব বাজেটে দৃশ্যমান নয় বলে উল্লেখ করেছে ঢাকা চেম্বার।

ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীলতা বিনিয়োগ ব্যাহত করতে পারে
এফবিসিসিআই

প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের শীর্ষ ফোরাম এফবিসিসিআই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় ঘোষিত বাজেটকে ইতিবাচক বলে উল্লেখ করেছে। পাশাপাশি বড় অংকের ঘাটতি বাজেটের অর্থায়ন সম্পর্কে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। ঢাকা চেম্বার বাজেট সম্পর্কে সন্তোষ প্রকাশ করলেও এতে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কার্যকর দিকনির্দেশনা থাকা জরুরি ছিল বলে উল্লেখ করেছে।
এফবিসিসিআই : প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণের জন্য বৃহস্পতিবার বিকালে রাজধানীর একটি হোটেলে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এফবিসিসিআই। এ অনুষ্ঠানে এফবিসিসিআই’র বর্তমান ও সাবেক নেতারা উপস্থিত ছিলেন। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় এফবিসিসিআই সভাপতি আনিসুল হক প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় প্রস্তাবিত বাজেটকে বেশ ইতিবাচক বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, এফবিসিসিআই যেসব প্রস্তাব ও সুপারিশ করেছিল তার বেশিরভাগই বাজেটে প্রতিফলিত হয়েছে। তবে তিনি ঘাটতি বাজেটের অর্থায়ন সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকার ব্যাংকের ওপর বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়লে তা বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ব্যাহত করতে পারে।
কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দেয়া, গ্যাস-বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে বিশেষ মনোযোগ ও বরাদ্দ, অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়া, সাব-কন্ট্রাক্টিংকে উৎসাহিত করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রকৌশল শিল্প বিকাশে সহায়তা ইত্যাদি বিষয় এ বাজেটের ইতিবাচক দিক বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। তবে বিনিয়োগ, শিল্পায়ন ও রফতানি বাণিজ্যে এ বাজেটের প্রভাব কি হবে তা আরও বিশ্লেষণের পর স্পষ্ট হবে বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
এফবিসিসিআই সভাপতি প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘বড় আকারের বাজেট’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, এ বাজেট বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারকে রাজস্ব আয় অনেক বাড়াতে হবে। সরকার করের চাপ না বাড়িয়ে কিভাবে এ রাজস্ব আয় নিশ্চিত করবে তা হচ্ছে দেখার বিষয়।
এফবিসিসিআই রোববার এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ও বিস্তারিত মতামত তুলে ধরবে।
(Image:Prothom-alo]

[sachalayatan]

Wednesday, June 10, 2009

# বাবা আমাকে একটিবার দেখতে চেয়েছিলেন...


বাবা আমাকে একটিবার দেখতে চেয়েছিলেন...
রণদীপম বসু

০১.
শেষবার যখন বাড়ি থেকে আসি, বাবা আমার হাতটি ধরে বলেছিলেন- দেখ্ বাবা, তুই বাড়ির বড়, আমার বয়েস হয়ে গেছে, অসুস্থ, কখন কী হয়ে যায়, তুই সবাইকে দেখে রাখিস। ভারী চশমার পুরু আতশ কাচের মধ্যে দিয়ে পঁচাশি-উর্ধ্ব বাবার ভেসে থাকা ঘোলা চোখ দুটোর আকুতি বুকের ভেতর খুব করে বাজলেও তখনও কি বুঝেছিলাম বাবার সাথে এটাই আমার শেষ দেখা ? ডেবে যাওয়া চোঁয়াল আর ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকা তাঁর শরীর দেখে কে বলবে যে জীবন-বিলাসী এ মানুষটি এই সেদিনও ট্র্যাক-স্যুট আর ক্যাডস পরে টুপি মাথায় শহরময় দিব্যি প্রাতভ্রমন সেরে এসে ঘুম ভাঙাতেন বাড়ির সবার ! আজীবন দাপিয়ে বেড়ানো প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী যে মানুষটি শরীরে ঘাতক ক্যান্সার নিয়ে চুরাশি পেরিয়েও কাজকর্ম ছাড়া এক দণ্ড বসে থাকা কাকে বলে জানতেন না, সেই তিনিই কিনা এতো অসহায়ভাবে সংসারের কোনো কাজে না লাগা অথর্ব সন্তানটিকে সংসারের দায় বুঝিয়ে দেবার দুঃসহ কাজটি করে ফেললেন ! কোনো অব্যাখ্যাত কারণে তিনি কি সত্যিই বুঝে ফেলেছিলেন, এই অভাগা সন্তানটির সাথে আর কখনোই দেখা হবে না তাঁর ?

শেষবার যখন বাড়ি থেকে আসি, অনেকগুলো মাস পেরিয়ে গেছে, তখনো কি বার্ধক্যের ভারসাম্য রাখতে লাঠি ধরেছিলেন ? মনে পড়ে না। সম্ভবত কোন অবলম্বন আঁকড়ে ধরা বড়ই অপছন্দ ছিলো তাঁর। নিজস্ব পা দুটোর উপর আস্থায় এতোটাই অটল ছিলেন যে, দুর্বল শরীরটাকে কেউ ধরে ধরে কোথাও এগিয়ে দিতে চাইলেও নির্দ্বিধায় ফিরিয়ে দিতেন, রূঢ়ভাবে। এমনকি তৃতীয়বারের ভারী অপারেশনপূর্ব প্রচণ্ড স্নায়ুচাপে বাদবাকী সবাই যখন অনিশ্চিত আশঙ্কায়-অস্থিরতায় ন্যুব্জপ্রায়, এমন অদম্য মনোবল নিয়ে সবার অলক্ষ্যে কখন কীভাবে যে ক্যাথেটারটি হাতে ঝুলিয়ে গটগট হেঁটে ওটিতে ঢুকে গিয়েছিলেন, তা ভাবতে গেলে এখনো চেতনা স্থবিঢ় হয়ে আসে ! তিনিই আমার বাবা। অথচ পঁচাশির প্রকৃত বয়েসটাকে ঠিকই বাড়াতে বাড়াতে পঁচানব্বই পার করে দিতে একটুও দ্বিধা হয়নি তাঁর। তা কি বার্ধক্যের বিভ্রান্তি, না কি শতায়ু হবার কল্প-বিলাস কে জানে ! আশার নাম মৃগতৃষ্ণিকা। আমরা যে সত্যিই তা উপভোগ করতাম তিনি হয়তো তা বুঝতেন না। আর আমরাও বুঝিনি, ডাল-পাতা শুকিয়ে গেলেও প্রাচীন বৃক্ষের বাৎসল্যের ছায়া কতোটা আশ্রয় আর অভয় দিয়ে জড়িয়ে রাখে সর্বক্ষণ। আকস্মিক সময়-ঝড়ে উপড়ে যাওয়া বটবৃক্ষের শূন্যতা আজ গভীর প্রলাপ হয়ে বুকের ভেতরে শুধু খুঁড়ে খুঁড়ে যায়। আহ্ জানিনা, অযোগ্য সন্তান হিসেবে কতোকাল এই অদৃশ্য যন্ত্রণা বয়ে যেতে হবে আমাকে !

০২.
হাতঘড়ির গোল ডায়ালের ছোট্ট চৌকোণা ঘরটাতে ক্যালেণ্ডার ডেটটা ধবধবে সাদা। মে মাসের ২৪ সংখ্যাটি সরে গেছে কখন, ২৫ তখনো পৌঁছায়নি এসে। আসি আসি করছে। আচমকা মোবাইলটা বেজে ওঠলো। বাড়ি থেকে ছোট ভাইয়ের ফোন- সেজদা, বাবা কথা বলতে পারছেন না আর, আপনাকে দেখতে চাচ্ছেন ! ফোনটা কানে ধরিয়ে দিচ্ছি, কখন আসছেন বলে দেন জোরে।
দড়াম করে বুকের ভেতরে কী যেন বাড়ি খেলো এসে ! একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। গত তিনমাস ধরে পুরোপুরি শয্যাশায়ী বাবাকে দেখবো দেখবো করতে করতেও বাড়ি না গিয়ে যে অমোচ্য অপরাধে অপরাধী হয়ে আছি, তার ভার যে হঠাৎ সমস্ত অজুহাতের উর্ধ্বে উঠে এমন অবহ হয়ে ঝাপিয়ে পড়বে, এর প্রায়শ্চিত্ত কী দিয়ে করবো আমি ! সবাইকে অবাক করে দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বাবার কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছিলাম- তুই আয় তুই আয়। আকস্মিক আর্তনাদে কেবল বলতে পারলাম- বাবা, আমি আসছি, কালই।

দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে ২৫ মে’র যে সকালটা এলো আমার জীবনে, তখনো তো বুঝতে পারি নি যে ১১ জৈষ্ঠ্যের নজরুল জয়ন্তির এই দিনটিই আমার চিরকালের কালো পর্দায় ঢেকে যাবে এভাবে ! সকালে অফিসে পৌঁছেই পরের দিন থেকে ছুটি মঞ্জুর করিয়ে ব্যাংকে ছুটলাম বেতনের টাকা তুলতে। সব প্রস্তুতি সেরে দুপুরেই আগেভাগে বেরোতে যাবো, সেই সর্বনেশে ফোটটি এলো দুটোয়, কনিষ্ঠ ভাইটির নম্বর থেকে। হ্যালো হ্যালো করছি, কোনো জবাব নেই। পৃথিবী জুড়ে শুধু তীব্র বিলাপের স্বর ! মোবাইল ফোনের অদৃশ্য সুড়ঙ্গ বেয়ে বুকভাঙা আর্তনাদে সবকিছু এলোমেলো তখন... !

০৩.
ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’র সাত নম্বর বিপদ সংকেত মাথায় নিয়ে চেয়ারকোচ ‘শ্যামলী’ হু হু বাতাস কেটে ছুটে চলেছে সিলেটের দিকে। বুকের চরায় হিমবাহী পাথরটা অসম্ভব জড়তায় স্থির হয়ে আছে। আর এদিকে একটার পর একটা ম্যাসেজ আর রিংটোনে অস্থির হয়ে ওঠছে মোবাইলটা আমার। আশ্চর্য ! অনিচ্ছুক ভ্রান্তিগোলে কাউকেই জানানো হয়নি কিছুই। অথচ দেখা না দেখা, সচল অসচল, বন্ধু সহকর্মী সহযোদ্ধা আর পরিচিতজনের একের পর এক শোক, সাহস আর সান্ত্বনার বাণী অদ্ভুত সহমর্মিতায় কীভাবে যেন ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আমাকে ! নুরুজ্জামান মানিক, ইশতিয়াক আহমেদ, প্রভাস দাস, মজিবুর রহমান, নজরুল ইসলাম, ইলতুৎ আলীদ, আহমেদুর রশীদ টুটুল, খালেদুর রহমান জুয়েল, অতন্দ্র প্রহরী, জগলুল হায়দার, গৌতম... আরো কতো কতো মুখ ! ইতোমধ্যেই নাকি নুরুজ্জামান মানিক ভাই সচলায়তনে শোক জানিয়ে অন্তর্জালিক পোস্ট ছেড়ে দিয়েছেন ! ওদিকে আরেকটা পোস্ট ইশতিয়াকের, সামহোয়ারইন-এ ! পৃথিবী জুড়া অসংখ্য ঋণের ভারে আবদ্ধ আমি জানি, বন্ধুত্বের যে অকৃত্রিম উষ্ণতায় পিতৃশোকের দুর্বহ ব্যথা গলিয়ে আমাকে চিরকৃতজ্ঞতায় ভাসিয়ে দিলো এরা, এ ঋণ আর শোধ হবার ! কখনোই শোধ হবার নয় ! অসম্ভব সে চেষ্টা কখনো করবোও না আমি।

প্রবল বৃষ্টি-ঝড়ের মুহুর্মুহু তাণ্ডবে ভেঙে পড়ছে প্রকৃতি। যেন সবকিছু একাকার হয়ে যাবে আজ ! আদৌ কি পৌঁছুতে পারবো ! ছোট ভাইয়ের ফোন আবার- সেজদা, কতোক্ষণ লাগবে আসতে ? আহা ! মানুষের জীবনটা কি সত্যিই এতোটাই ট্র্যাজিক ? নইলে ভাইয়ের এই প্রশ্নটা কেনই বা পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন আর ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দিলো আমার কাছে ? এর উত্তর সত্যিই জানা ছিলো না আমার। কতোক্ষণ লাগবে, কতোক্ষণ লাগবে... মাথার ভেতরে হাতুরির আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছি শুধু... ! আশৈশব কত স্মৃতি কত স্বপ্ন কত কথা কত অভিমান আর অস্তিত্বের অপরিহার্যতায় মাখানো বাবার হাতটি ধরে জীবনের পয়তাল্লিশটি বছর নিমেষেই কেটে গেলো ! অথচ ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ, উপকূল ছেড়ে এসে আছড়ে পড়া ‘আইলা’র তীব্র ছোবলে সময়-ঘড়ির মাত্র আট ঘণ্টার রাস্তা এক জীবনে আর ফুরালো না আমার... ! সবকিছু ছেড়েছুড়ে এভাবেই চলে গেলেন বাবা। আমার জন্যে একটুকু অপেক্ষাও করতে পারলেন না ! পিতা হয়ে অধম এ সন্তানের সাথে এতোটা অভিমান করতে পারলেন তিনি ! আমারো তো অভিমান থাকতে পারে ! এই দুঃসহ অভিমান আমি কাকে দেখাবো আজ !!!

০৪.
বাবা আমাকে একটিবার দেখতে চেয়েছিলেন ! চিতার আগুনে পোড়া দেহভস্মও ধোয়ে গেছে তখন। ছাব্বিশ তারিখের রঙহীন বিমর্ষ এক ভাঙাচূরা সকাল বিষাদ-মর্মর সিঁড়িটার গোড়ায় এসে থেমে গেলো শেষে। আদরের ছোট্ট বোনটি আর্তচিৎকারে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো বুকে- সেজদাগো...বাবা তো আপনাকে না দেখে যেতে চান নি...শুধু এদিক-ওদিন খুঁজেছেন আপনাকে... কেন এতো দেরি করে ফেললেন...কেন... !

বারান্দায় সেই চেয়ারটি আর নেই। জায়গাটা আজ বীভৎস ফাঁকা ! পট্টবস্ত্র গায়ে উস্কুখুস্কু দাঁড়িয়ে থাকা ভাইটির পাথর-চোখে এ কোন্ অবোধ্য আগুন্তুক অক্ষরগুলো ঝুলে আছে এলোমেলো, নির্মম ! বড় বেশি অচেনা এসব ! একে তো আর কখনোই অনুবাদ করা হবে না আমার ! যার কোনো অনুবাদ হয় না... কিছুতেই... কখনোই...।

[sachalayatan]
[somewherein]