Monday, January 19, 2009

# কবি-কবিতা-ছড়া-শিল্প-বিভ্রম...


কবি-কবিতা-ছড়া-শিল্প-বিভ্রম...
রণদীপম বসু

গুরুচণ্ডালিকা
আলোচনার কান ধরে টান দিলে কবিতা এসে যেতেই পারে। তাই প্রথমেই বলে নেয়া ভালো যে এটা কোন কবিতার কাশ বা কাব্য আলোচনা নয়। স্রেফ অভিজ্ঞতা বিনিময়। আপ্তজনদের গপ্পোসপ্পো থেকে শিক্ষার্থী হিসেবে কিছু শিখতে চাওয়াজনিত যে বদহজমের সূত্রপাত, সেটাকে খালাস না করা অব্দি স্বাচ্ছন্দ্যের দেখা পাচ্ছি কই ! তাছাড়া শেখা বা জানার প্রক্রিয়াগত ভিন্নতা ব্যক্তিমাত্রেই স্বতন্ত্র এবং নিজস্ব মেধা, বোধ ও সীমাবদ্ধতার স্কেলে নিয়ন্ত্রিত বলে রহিমকে রাম বানিয়ে ফেলা বা শিল্পের কলা’কে হস্তী-ভক্ষ্য কদলীবৃক্ষ বানিয়ে গিলে ফেলার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেয়ার নয়। এমন দুর্যোগ ঘনীভূত হলে হাত তোলে জানান দেয়ার স্বাধীনতা সবারই রয়েছে, যে, আর্ট আর অষ্টকদলী একই বস্তু নয় !

দুর্দান্ত সব কবিতা উপহার দিয়েও বোহেমিয়ান শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো শক্তিমান কবি যখন নিজেকে পদ্যকার হিসেবে ঘোষণা দেয়ার কৌতুক আমাদের সামনে উপস্থাপন করেন, তখন সত্যিকারের কবিরা নিজ নিজ কৃতকর্মগুলো হাতে নিয়ে একটু নড়েচড়ে বসেন বৈ কি। কবি শব্দের আগে একটা ‘সত্যিকারের’ শব্দ বসানো মানেই যুক্তিবিদ্যার আরোহী পদ্ধতি অনুযায়ী কাল্পনিকভাবে হলেও প্রতিপক্ষ হিসেবে উল্টো স্বভাবের আরেকটা সত্তার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেয়া হয়। তাহলে কি মিথ্যাকারের কবিও রয়েছে ! রয়েছে বৈ কি ! নইলে কবি জীবনানন্দ দাশ কেনই বা সাধ করে ‘কবিতা লিখে অনেকেই, কেউ কেউ কবি’ উক্তি করে এমন ল্যাঙ মারতে গেলেন !

জীবনানন্দের এই উক্তিটাতে যে অবশ্যই জটিল একটা বিভ্রম লুকিয়ে আছে তা অস্বীকার করার জো নেই। তাই উক্তিটাকে খুব সরলভাবে নেয়ারও উপায় নেই। এ কারণেই কৌতুহলটা উচ্চকিত হয়ে ওঠে, বিভ্রমটা কী ? তাঁর উক্তির প্রথম অংশটা আবারো আমরা খেয়াল করি, ‘কবিতা লিখে অনেকেই...’। হাঁ, লিখতেই পারে ! তাতে কী হয়েছে ? হয়েছে বা হচ্ছে অনেক কিছুই, আবার কিছুই না। যে কোনো কাজের অনিবার্য ফলাফলের মতোই কিছু সম্ভাব্যতাকে তিনি ইঙ্গিত করেছেন, এদের ‘কেউ কেউ কবি’ বলে। কিন্তু উক্তির প্রথম অংশে কাজের ডিটেইলসটা কিন্তু স্পষ্ট নয়। এখানেও কতকগুলো সম্ভাব্যতার অনির্দেশ্যতা দেখতে পাই আমরা। যেহেতু অনেকেই কবিতা লিখেন, তাহলে অনেকে আবার অকবিতাও লিখেন। আবার অনেকে কবিতাই লিখেন না। অকবিতা লিখলে কবি হওয়া যায় কিনা, সে বিষয়টা এখানে অপ্রযোজ্য হয়ে আছে। অকবিতা লিখা এবং কবিতা না লিখা আবার দুটো ভিন্ন বিষয়। আমাদের অনেকেই যে প্রশ্নটি করতে দ্বিধা করেন তা হলো, কবিতা না লিখলে কি কবি হওয়া যায় না ? প্রশ্নটাকে অর্থহীন ভেবে উড়িয়ে দেয়ার কোন কারণ নেই। জীবনানন্দের ভাষায় কেবল কবিতা লিখলেই যদি কবি হওয়া না যায়, তাহলে উল্টো যুক্তিতে যদি বলি, কবিতা না লিখেও কেউ কেউ কবি, এটাকে কি ফ্যালাসি বলবো ? মোটেও ফ্যালাসি নয় তা।

যুক্তিবিদ্যার পরিভাষায় ফ্যালাসি হচ্ছে অর্থহীন প্রতিতুলনা দিয়ে কোন উদ্ভট সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। যেমন, আমার দাঁড়ি আছে, ছাগলেরও দাঁড়ি আছে, অতএব আমি ছাগল এইরকম। তাই বিষয়টা ফ্যালাসি না হলেও ফ্যালাসির মতো মনে হতে পারে। কেননা জীবনানন্দের উক্তি থেকে এটা অন্তত স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কবিতা লেখাটা কবি হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কোন ফ্যাক্টর বা শর্ত নয়। তাহলে কী সেই শর্ত ? আলোচনার এই উন্মুক্ততায় এসে এখানেই আমরা থমকে যাই। সেরকম কোন শর্ত এখনো স্বতঃসিদ্ধতা পায় নি বলেই অনুমিত একটা ধারণা থেকে আমরা এটা বুঝে নেই যে, কবি একটি অন্তর্গত সত্তার নাম। একজন পরিপূর্ণ মানুষ হতে গেলে যে সব সৎ-গুণাবলী ও সুকৃতি থাকতে হয়, একজন কবির সত্তায় তা তো থাকবেই, বরং মেধা মনন আর সৃজনশীলতায় মাখানো আরো কিছু উপলব্ধির অনুরণনও সেখানে থাকতে হয়।

সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসবে, আমরা কী করে বুঝবো ‘তিনি’ একজন কবি ? বুঝার কি কোনো কায়দা আছে ? এ ক্ষেত্রে আবারো যুক্তির সিঁড়িকেই মাধ্যম করে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। একবাক্যে যেহেতু জগতের সবাইকে বাছবিচারহীনভাবে কবি বলে স্বীকৃতি দেয়াটা বালখিল্য উদ্ভটতা হিসেবে গণ্য হবে, তাই উল্টোভাবে ‘কেউ কবি নয়’ থেকে পর্যায়ক্রমে সামনে কবি হওয়ার দিকে আগানোটাই যুক্তিসঙ্গত প্রক্রিয়া বলে মনে হয়। অর্থাৎ ধীরে ধীরে একজন কবি তৈরি হয়ে ওঠেন। সুকৃতি আর মানবিক গুণাবলীর সমন্বয়েই এই হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা আগাতে থাকে। যাঁর মধ্যে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার মানবিক গুণাবলীরই ঘাটতি রয়েছে, তিনি যদি মানুষই হয়ে ওঠতে না পারলেন, কবি হবেন কী করে ! এখানে আবার প্রশ্ন, মানবিক গুণাবলী সমৃদ্ধ একজন পরিপূর্ণ মানুষ আর কবির মধ্যে তফাৎটা কোথায় তাহলে ? পরিপূর্ণ একজন মানুষ হওয়ার পরও কবি হয়ে ওঠতে বাকি যে মেধা মনন বোধ উপলব্ধি ও সৃজনশীল সুকৃতিটুকু দরকার, মূলতঃ সেটাই তফাৎ। এবং খুব সঙ্গতভাবেই, যেহেতু প্রসঙ্গ কবি হওয়ার, তাই শেষ পর্যন্ত কবিতা বা কাব্যবোধের বিষয়টা অনিবার্যভাবে চলে আসাটাই তো স্বাভাবিক এবং যুক্তিযুক্ত।

জীবনানন্দের কথাতেই ফিরে যাই আবার- কবিতা লিখে অনেকেই, কেউ কেউ কবি। এখন মনে হয় কথাটার অন্তর্গত ভাবের আরেকটু কাছাকাছি চলে এসেছি আমরা। আমাদের উপলব্ধিবোধটাকে একটু অন্তর্মুখী করে কয়েকটা বিষয় এবার মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি। ধরে নেই প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনায় অগ্রগামী, ব্যক্তিক স্বভাব, রুচি, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সার্বিক জীবনাচারে মানবিক বিবেচনাবোধে উত্তীর্ণ একজন ‘তিনি’ যে চমৎকার একজন মানুষ হিসেবে স্বীকৃত হতেই পারেন তাতে আমাদের দ্বিমত নেই। কিন্তু স্রষ্টা হিসেবে তাঁর রচনায় যদি সৃজনশীল কাব্যবোধের প্রকাশ না ঘটে, তাহলে কবি পরিচয়ের প্রাসঙ্গিকতা এখানে কতোটা প্রযোজ্য হবে ?

আবার অন্যদিকে একটি রচনা কবিতা হয়ে ওঠতে যে সব শর্তাবলী প্রয়োগ আবশ্যক, সেই সব কিছু ঠিক রেখেই ‘তিনি’ উৎকর্ষ কাব্যসাধনায় মগ্ন রয়েছেন ঠিকই। কিন্তু ব্যক্তি জীবনে তিনি অসৎ, সামাজিক জীবনে অসদাচারী এবং সামষ্টিকভাবে তিনি মানবতার বিরুদ্ধ অবস্থানে নিজেকে জড়িত রেখেছেন বা পশ্চাৎপদ মানসিকতায় তিনি প্রগতির বিপক্ষ-কাতারে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখেন, তাঁকে কি আমরা কবি বলতে পারি ?

‘কবিতা লিখে অনেকেই, কেউ কেউ কবি ’, জীবনানন্দের কথাটিকে এসব শ্রেয়বোধ দিয়ে যদি বিশ্লেষণ করি আমরা, তাহলেই হয়তো অনেকগুলো বিভ্রমের পর্দা আমাদের চোখের সামনে থেকে নির্দ্বিধায় অপসৃত হয়ে যাবে। আমরা কি আদৌ করবো তা ? গুটিকয় পঙক্তি বা বাক্য রচনা করেই আমরা বুঝে না বুঝে নিজের বা অন্যের নামের আগে ‘কবি’ উপাধীর সুদৃশ্য যে তকমাটি অনায়াসে বসিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করছি না, এটা কি আমাদের বাছবিচারহীন উদারতার মূর্খামী, না কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বুদ্ধিবৃত্তিক বালখিল্যতা, এই আত্মবিশ্লেষণটা কি এখন জরুরি নয় ?

অতঃপর ছড়াকার-ছড়াশিল্পী সমাচার
ছড়াসাহিত্যেও ইদানিং মনে হয় একটা পরিচিতি সংকট ক্রমেই দৃষ্ট হয়ে ওঠছে। রচনার মূল যে অভিক্ষেপ ছড়া, সেটা কি হচ্ছে নাকি হচ্ছে না সে বিষয়টা খুব সচেতনভাবে আমরা এড়িয়ে তো যাচ্ছিই, বরং কেউ কেউ আবার এতদিনকার ‘ছড়াকার’ পরিচয়টাকে নিজের জন্য অতি অপ্রতুল বিবেচনায় আকর্ষণীয় নতুন তকমা ধারণ করতে চাচ্ছি ‘ছড়াশিল্পী’ নামে ! ছড়াকে যেনতেন একটা আকার হয়তো দিয়ে দিচ্ছি আমরা, কিন্তু এই ছড়াকে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করতে নিজস্ব মন ও মননে কতটুকু সৃজনশীল শিল্পসত্তা ধারণ করতে হয়, তা কি আদৌ ভাবি আমরা ?

যারা এই অল্পতে তুষ্ট নন, তাঁদেরকে বিনীতভাবে বলি, একজন ব্যক্তি ক্রমে ক্রমে শিল্পী হয়ে ওঠলে এটা সমাজের জন্য সংস্কৃতির জন্য অবশ্যই গৌরবের ব্যাপার। এতে সমাজ সংস্কৃতি ঋদ্ধ হয়ে ওঠে। আমরাও তো এই উত্তরণই চাই। কিন্তু চিন্তাভাবনায় ঘাটতি রেখে এমন স্বেচ্ছামুকুট ধারণ করার আগে অন্ততঃ এক হাজারবার ভাবা জরুরি নয় কি যে, অন্যের কথা বাদ দিলেও নিজের কাছেই নিজেকে যেন জবাবদিহিতায় পড়তে না হয় ? কারণ তিনিই শিল্পী যিনি নিজের মধ্যে শিল্পের কলাকৈবল্যসমেত এক মহৎ কবিসত্তা ধারণ করেন।

আমাদের লোকছড়া নিয়ে ব্যাপক সন্ধান ও গবেষণা থাকলেও আধুনিক ছড়া সাহিত্যের গবেষণাকর্ম খুঁজতে এখনো আমাদেরকে দূরবীণ আর অনুবীক্ষণযন্ত্র হতে নিয়েই বেরোতে হয়। ঘাড় ফেরালেই যেদিন এই চর্মচক্ষে আধুনিক ছড়াসাহিত্যের প্রয়োজনীয় গবেষণাকর্ম অনায়াসলব্ধ হয়ে ওঠবে, সেদিনই হয়তো ছড়াসাহিত্যের এরকম বহু অনর্থক সংকটও অনেকাংশে কেটে যাবে। আমাদেরকে সেদিনের প্রতীক্ষায়ই থাকতে হবে বৈ কি...।
(১৭/০১/২০০৯)
(Image:Sculpture 'the thinker' by Rodin)

# ছেঁড়া ঘুড্ডি। ০২। দাগ


দাগ
রণদীপম বসু

রুমে ঢোকার মুখেই প্রথম বাধা, ব্যাগ আর জুতা রেখে যান। নির্দেশসুলভ কণ্ঠে ভদ্রতার ছোঁয়াটুকুও নেই। পোর্টফোলিও ব্যাগটা দরজার পাশেই নামিয়ে রাখলাম। জুতা-মোজা খুলে রেখে ভেতরে ঢুকতেই সামরিক পোশাক পরা দ্বিতীয় লোকটার ইঙ্গিত আমার মাথার দিকে। পূর্ণমুণ্ডিত বিরলকেশ মাথাটা উন্মুক্ত করে চারধার উঁচু করা গোলাকার সাদা ক্রিকেটিয় ক্যাপটা নামিয়ে পাশের টেবিলে রাখতে যাচ্ছি, আরেকজন সামরিক কায়দার লোক এসে ক্যাপটা নিয়ে গেলো। ভেতরের আরেকটি রুমে ঢোকার দরজার পাশে মেঝেতে ফেলে রাখলো।
ওটা কী ? দ্বিতীয় ব্যক্তিটির প্রশ্নে ফের মনোযোগ ফিরে এলো এদিকে। সন্দেহজনক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমার ব্রম্মতালুর দিকে। কম করেও প্রায় ছ’ফিট উঁচু অবস্থান থেকে পাঁচ ফিট সাত ইঞ্চি আমার তালুতে সদ্য জোড়া-তালি সেলাইয়ের আড়াআড়ি দাগটা তাঁর চোখে পড়তে কোনো সমস্যা হয় নি। আমি মৃদু স্বরে উত্তর করলাম- দাগ।
কিসের দাগ ?
সেলাই।
এবার বুঝি তাঁর কমান্ডিং স্বরটা গাঢ় হয়ে উঠলো- কি হয়েছিল ?
ভরা কলসির কানা ডেবে গিয়েছিল।
আমার উত্তরে সন্তুষ্ট হলো কি হলো না বুঝা গেল না। উজ্জ্বল চোখ দুটো আমার চোখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাক করে রেখে প্রায় থ্রি কোয়ার্টার হাত দৈর্ঘ্যরে অদ্ভুত লাঠি জাতীয় জিনিসটার অগ্রভাগ দিয়ে দেয়ালের দিকে ইঙ্গিত করলো। নির্দেশমতো উল্লম্ব স্কেলটা ঘেষে দাঁড়ালাম। একজন হাঁক দিলো, সিক্সটি সিক্স।
এবার বিপরীত দিকের দেয়ালে ঝুলানো একটা বড় পর্দার দিকে তাকানোর নির্দেশ। ওখানে একজন দাঁড়ানো। পর্দায় অংকিত সারি সারি বিভিন্ন আকৃতির ইংরেজি আলফাবেটস। একটা স্টিকের মাথা এলোপাথারি বিভিন্ন বর্ণের উপর রাখছে আর প্রশ্ন ভেসে আসছে, এটা কী ? এটা ? ওটা ? আমিও দ্রুত উত্তর দিয়ে যাচ্ছি। এরই মধ্যে আমার পাশে দাঁড়ানো লোকটা প্রথমে আমার বাঁ চোখ, তারপর ডান চোখ চেপে ধরছে আর একইভাবে ওদিক থেকে প্রশ্ন।
এবার দ্বিতীয় লোকটি আমার কাছে এসে ছোট্ট লাঠিটা থুতনির নীচের দিকে ছুঁইয়ে উপরের দিকে চাপ দিতে দিতে বললো- হা করুন।
আমি আলতো হা করলাম।
আরো বড় করে...।
আমি তাই করলাম। বাঁ হাতে ধরা ছোট্ট টর্চটা আমার মুখের ভেতর আলো ফেললো। তৃতীয় সামরিক ব্যক্তিটির হাতে অদ্ভুত লাঠিটা ধরিয়ে দিয়ে তার বাড়িয়ে দেয়া চামচের মতো যন্ত্রটা নিয়ে সোজা আমার মুখের ভিতর হলকম অবধি ঢুকিয়ে দিলো। এবং জিহ্বার উপর নীচ ডানে বামে কতক্ষণ নাড়াচাড়া করে চামচটা বের করে নিয়ে পেছনের চেয়ারটাতে বসার ইঙ্গিত করেই বললো- শার্ট খুলুন।
আমি শার্ট খুললাম, ভেতরের গেঞ্জিও খোলতে হলো। উদোম গায়ে চেয়ারটাতে বসতেই আবার কমান্ড- এভাবে থাকুন।
ঘাড়টা একপাশে কাত করে রাখলাম আমি। প্রথমে ডান কান, পরে বাম কানেও কী সব পরীক্ষা নিরীক্ষা চললো। এদিকে আরেকজন আবার ডান হাতে প্রেসার মাপার যন্ত্র জাতীয় কিছু ফিট করে নিয়েছে। চোখ দুটোকে নিয়ে হামলে পড়লো আরেকজন। তারপরে নাকটাকে। মাথাটা প্রায় চিৎ করে নিয়ে নাকের ছিদ্র দিয়ে কী একটা ঢুকিয়ে দিলো। টর্চ ফেলে দেখলোও আরো কী কী যেনো। সবকিছুই খুব দ্রুত ঘটতে লাগলো।

অল্পক্ষণ পরেই ভেতরের দরজার দিকে ইঙ্গিত, অর্থাৎ পরের রুমে। নিরবে কমান্ড পালন করছি। দরজার পাশে আমার টুপিটাকে আড়াল করে শার্ট আর গেঞ্জিটা পড়ে আছে মেঝেতেই। পাশের রুমে ঢুকার আগেই কমান্ড, প্যান্ট খুলে যান।
জী..? কমান্ডটা সঠিক শুনলাম কিনা নিশ্চিৎ হতে পারলাম না। পাশের সামরিক লোকটির দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালাম। একই কথার পুনরাবৃত্তি হলো- পরনের প্যান্ট এখানে খুলে রেখে যান।
বলে কী ! বেল্ট খুলতে খুলতে খানিকটা ইতস্ততঃ করছি। পাশ থেকে ধমক এলো, কুইক !
ধা করে খশে পড়লো প্যান্টটা। এবার শুধু ছোট্ট একটা বস্ত্রই শরীরে সেঁটে আছে, আন্ডার-অয়্যার !
ভেতরে ঢুকে সামরিক ইউনিফর্ম পরা লোকটির চোখের দিকে তাকাতেই রক্ত হিম হয়ে গেলো ! স্পষ্ট ইঙ্গিত আমার সবেধন নীলমণি ছোট্ট আন্ডার-অয়্যারটার দিকেই, রিমোভ !!

১৯৮১ সাল। সবে এইচ এস সি পাশ করেছি। ব্যায়ামপুষ্ট শরীরে মনে সব কিছুতে একটা ফুরফুরে ডোন্ট কেয়ার ভাব। নিজের সাধারণ ক্ষমতাটুকুকেও বাড়ন্ত তরুণীদের সামনে অতি-বীরত্বে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রকাশ করার মোহে উঠতি বয়সের উদ্দামতা তখন হার না মানায় উচ্ছল। নতুন পত্তনি করা বাসার সামনে বৃষ্টি-ভেজা শেষ বিকেলের পিচ্ছিল কর্দমাক্ত রাস্তায় সে রকমই এক অতি বীরত্ব দেখাতে গিয়ে মাথার তালু বরাবর দু’ফাঁক হয়ে যাওয়াটা তখনও টের পাইনি। টের পেলাম, যখন বৃষ্টিতে চুপসে যাওয়া গায়ের লাল গেঞ্জিটা দেখে বোঝার আর উপায় রইলো না যে অরিজিনালি ওটা সাদাই ছিল !

ঘটনার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় কে কীভাবে কখন মূর্চ্ছা গেল তা খেয়াল করার হয়তো সুযোগই ছিলো না। হাতের তালু দিয়ে ব্রম্মতালু চেপে ধরে রক্তক্ষরণ থামানোর চেষ্টা চালাতে চালাতে রিক্সা চেপে সোজা সদর হাসপাতালে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব কোণাঞ্চলের নিরিবিলি সুনামগঞ্জ শহরটিতে প্রাইভেট কিনিক বলে এরকম কিছু ছিল না তখন। সরকারি হাসপাতালটাও জেলখানার সহাবস্থান ছেড়ে সরকারি কলেজের পাশ্ববর্তী এলাকায় ঠাঁই গাড়েনি তখনো।

মাথার দশাসই ব্যান্ডেজ ছেড়ে সেলাইটা তখনো শুকিয়েছে কি শুকায়নি। এডভেঞ্চারপ্রিয় মনে ভূত চাপলো বিমান বাহিনীতেই যোগ দেবো। পত্রিকায় কমিশন র‌্যাঙ্কে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি দেখে পুরনো ইচ্ছাটা চাগিয়ে উঠায় অন্য কোথাও ভর্তির চেষ্টাও করা হলো না আর। পরিবার থেকে আমার এমন হঠকারি সিদ্ধান্তে পূনর্বিবেচনা করার উপদেশ এলেও আমার গভীর বিশ্বাস ওখানে চান্স তো পাবোই। আমি না পেলে আর পাবেটা কে শুনি ! এদিকে খাসিলত কি আর পাল্টায় ! ইটিশপিটিশ করার সেনসেটিভ জায়গাগুলোতে মাথা ফাটার প্রাক ও পরবর্তী বিক্রম ফলানোর বীরত্বগাথা বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে মেয়েলী কণ্ঠের কলকলে হাসির মাদকতায় সেই বোধটাই কাজ করেনি যে, এগুলো কি প্রশ্রয়ের হাসি ছিল ? না কি ঝাঁকড়া ঘন বাবরি চুলের উত্তুঙ্গ গ্যালারির মাঝখানে জোড়াতালি চিকিৎসায় ছেটে ফেলাজনিত কেশোচ্ছেদি মধ্যতালুর বিস্তৃত খোলা মাঠ নিয়ে গোপালভাঁড় মার্কা যে অদ্ভুত চেহারাটা ধরেছিলাম, তার প্রভাব ? অতঃপর হেয়ার ড্রেসিং সেলুনের স্বচ্ছ আয়নায় ক্ষুরের নির্দয় পোচে পোচে নিজেকে দেখছি ! অর্ধমুণ্ডিত চেহারার ভাবগতি দেখে পূর্ণমুণ্ডিত রূপ কী হবে ভাবতেই স্বজন হারানোর মতো দুর্বহ শূন্যতায় কাঁদবো না কি থম ধরে বসে থাকবো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। ক্ষৌরকার লোকটি ছোট্ট তোয়ালেটা এগিয়ে দিয়ে ইঙ্গিত করলো চোখ দুটো মুছে নিতে। আহা, এক জীবনে মানুষকে কত কিছুই না হারাতে হয় !

বিমান বাহিনীর ভ্রাম্যমান ক্যাম্প বসলো সিলেট শহরেরই প্রখ্যাত একটা স্কুলে। ভর্তি পরীক্ষার সবগুলো প্রক্রিয়া এখানেই সম্পাদিত হবে, মায় চূড়ান্ত ফলাফল দেয়া সহ। নির্ধারিত দিনে বহু প্রার্থীর সমাগমে গিজগিজ করছে। প্রথম ইভেন্টেই আইকিউ এবং সাধারণ পর পর দুটো লিখিত পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ভীড়টা পাতলা হয়ে গেলো। দুপুরের পর পর দুপর্যায়ের মেডিক্যাল টেস্ট। এগুলো উত্তির্ণ হলে কনফিডেন্সিয়াল ভাইভা। মেডিক্যাল টেস্টের লাইন ধরেছি। রিটেনে ভালো করায় সিরিয়াল শুরুতেই পড়লো। কিন্তু আগে কি জানতাম কী বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছি ! তাহলে হয়তো এই জীবনেও এমুখো হতাম না। নবীন তারুণ্যের তরল আবেগে সেই মেয়েটির কাছে আগপাছ না ভেবে যে অনড় প্রতিজ্ঞা করে এসেছি, তাই এখন গলায় ফাঁস হয়ে গেছে। দেখো, পাইলট হয়ে তোমাকে বিমানে চড়াবোই চড়াবো, নইলে আর কখনোই এ মুখ দেখাতে আসবো না, এই নামটাই পাল্টে দেবো...! স্বেচ্ছাকৃত ছুঁড়ে আসা এই কথাগুলোই কানে বাজতে লাগলো একে একে। অভিজ্ঞতার পাঠে তখন কি আর জানা ছিল, আত্মবিশ্বাস ভালো কিন্তু অতিবিশ্বাস কিছুতেই নয় ?

আমাদের শহরের স্থায়ী কোনো বাসিন্দা নয় সে। মফস্বলের কোন্ দূর গ্রাম থেকে দূরবর্তী আত্মীয়তার সূত্রে এমন মিষ্টি যে মেয়েটি শহরে এসেছিলো ম্যাট্রিক পরীার্থী হয়ে পাশের বাড়িতে, জান্তে বা অজান্তে কখন যে প্রথম স্বপ্নের মধুবীজটি নিজ হাতেই রোয়ে দিয়েছিলাম বুকে..! দেখতে দেখতে তা চারা হয়ে গেলো ! ছায়ার আবেশ নিয়ে বেড়ে উঠছে সে দ্রুত...। শিকড়সহ একে অনাহুত উপড়ানোর অভিশাপ কী করে বইবো আমি..!
এটা কিসের দাগ ! প্রশ্নের ঝণঝণ ধাক্কায় সম্বিৎ পেলাম।
কিন্তু এ কী ! আমার আন্ডার-অয়্যার কোথায় ! এক আদিম অনার্য পুরুষ আমি দিগম্বর দাঁড়িয়ে ঠায়, নির্বিকার ! এক চিলতে সুতোবিহীন এমন মুক্তকচ্ছ মানব হিসেবে এ আমার প্রথম পাঠ, অভূতপূর্ব ! সুরমার জলে সাঁতরে সাঁতরে বেড়ে উঠা কৈশোর তারুণ্যে দুর্গময় তেমন কোনো বাথরুম তো ছিলো না যে আগে এমন বিরল অভিজ্ঞতায় সিঞ্চিত হবো ? ঘটনার অভিঘাতে তখন পুরোটাই যান্ত্রিক আমি। ভব্যতার লেশমাত্রহীন সামরিক লোক দুজন আমাকে উল্টে-পাল্টে হাতের স্টিকটি দিয়ে যথেচ্ছ নেড়েচেড়ে কী যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিলো তারাই জানে। আমি শুধু জানি মেডিক্যাল টেস্ট সেরে যে আমি বেরিয়ে এলাম সে অন্য এক আমি, যে এক লাফে অনেক বেশি সাবালক হয়ে গেছে।

চূড়ান্ত ভাইভার কনফিডেন্সিয়ালিটি আমার সেই জন্মদাগটিকেই চিনিয়ে দিলো আবার। এবং বুঝিয়ে দিলো এ দুর্ভাগা দেশে কখনো কখনো এমন সময়ও আসে যখন ঈশ্বর আর আল্লাহর মাঝখানে বিশাল এক ব্যবধান তৈরি হয়ে যায় ! এরপর জীবনে আরো কতো বিচিত্র পরীক্ষা এলো গেলো। কিন্তু সেদিনের সেই নাওয়া-খাওয়াহীন গোটা দিন শেষে এক ক্লান্ত ক্ষুব্ধ ভঙ্গুর বিকেল আমার ভাগ্যটাকে নির্ধারণ করে দিয়ে গেলো, তাঁর সাথে আর কখনোই যে দেখা হবে না আমার ! এবং কী আশ্চর্য, আমি চাইলেও সেই মেয়েটির সাথে আর কখনোই দেখা হয় নি !

আগে চুল সরিয়ে দেখতে হতো, এখন আর তার প্রয়োজন হয় না। সময়ের ঝড়ে উড়ে যাওয়া বনানীর মতো ফাঁকা তালুয় চিরুণী ঘষটানোর অভ্যস্ত কৌতুক করতে গিয়ে আয়নার গায়ে একটু খেয়াল করলেই খুব সহজেই লম্বা আড়াআড়ি দাগটা চোখে পড়ে। ভরা কলসীর ধারালো কানা বসে গিয়ে হা হয়ে যাওয়া চামড়ার ভাজ ডাক্তারি সেলাই দিয়ে ফের বুজে দেয়া হলেও এই বুজে দেয়ার অমোচ্য দাগই বলে দেয় ওখানটা একদিন হা হয়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের সেই কাদম্বিনীর মতোই, আগে যে মরে নাই সে এটা বুঝি মরিয়া প্রমাণ করিল !

সেই দিনটির পর দীর্ঘ সোয়া দুইটি যুগ পেরিয়ে গেছে। আমাদের বাসার গেটে যে কৃষ্ণচূড়ার চারাটি রুয়েছিলাম একদিন, সেটি আজ পূর্ণ বৃক্ষ। প্রতি বছর ফাগুন এলেই রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায় তার। কিন্তু একই সময়ে রোপিত এই বুকের ভেতরের সেই চারাটি এখনো তেমনই রয়ে গেছে ! সপ্রাণ সতেজ। এবং বিষণ্নও। ছায়ার আবেশ নিয়ে এখনো বেড়ে উঠতে চায়...!
(১৭/০১/২০০৯)
[Published in the sachalayatan e-book "Khathgoray-golpo"]

Saturday, January 17, 2009

# রায়ের বাজার বধ্যভূমি, যেখানে আকাশ থমকে থাকে...


রায়ের বাজার বধ্যভূমি, যেখানে আকাশ থমকে থাকে...
রণদীপম বসু

[রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিসৌধ

এই সে বধ্যভূমি। ১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ের উষালগ্নে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার আলবদর বাহিনীর বাঙালি-বুদ্ধিজীবী নিধনের এ সেই স্থান। এখানেই নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে বাঙালি জাতির বিবেক, চেতনা, মননশীলতা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক- এ মাটির শ্রেষ্ঠ সন্তান- বুদ্ধিজীবীদের। পরিত্যক্ত ইটের ভাটার এ বধ্যভূমি থেকে আজো ভেসে আসে শৃংখলিত হাত পা, উৎপাটিত চোখ, বেয়নেটবিদ্ধ শহীদের আর্তনাদ; শোনা যায় স্বাধিকার প্রত্যাশী প্রতিবাদী কণ্ঠের গোঙানি আর মানুষরূপী রক্তলোলুপ হায়েনার মারণ-উল্লাস। এখানে আকাশ থমকে আছে, বাতাস ভারী, পত্রপল্লব অনড়, শোক ভাষাহীন। এ নির্বাক শোক, আর বেদনারই বিমূর্ত প্রতীক এ স্মৃতিসৌধ।
“সোনার বাংলা আমরা গড়বোই”- এই হোক নাম জানা, অজানা অসংখ্য শহীদের অতৃপ্ত আত্মার প্রতি আমাদের শেষ অঙ্গীকার।
]


রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে স্মৃতিসৌধ এলাকায় বাঁ দিকের প্রধান গেট দিয়ে ঢুকতেই পাশে দেয়ালের গায় উপরের এই হৃদয়-নিংড়ানো লেখাগুলো সহজেই চোখে পড়বে সবার। তবে সোনার বাংলা গড়তে হলে প্রথমেই যে সেই সব কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী ঘাতকদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় তুলতে হবে, সে কথাটি বধ্যভূমির দেয়ালে লেখা না থাকলেও স্বজনহারানো প্রতিটা বাঙালির বুকে উৎকীর্ণ হয়েই আছে। এই অমোচ্য দাগ সহজে মোছার নয়, তা সেই যুদ্ধাপরাধীরা যেমন ভালো করেই জানে, তেমনি আমাদের সরকারগুলো তা হৃদয় দিয়ে কতটুকু বোঝে বা বোঝার চেষ্টা করে, আমরা জানি না।


দেয়ালে উৎকীর্ণ লেখাগুলোর ঠিক নীচে দেয়া তথ্য-ফলক থেকে আমরা জানতে পারি, এই ‘রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি সৌধ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ৩০শে অগ্রহায়ণ ১৪০৩, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৯৬।’ এবং ৩০শে অগ্রহায়ণ ১৪০৬, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৯৯-এ তিনিই এর শুভ উদ্বোধন করেন।


স্থপতি মোঃ জামী আল-সাফী ও স্থপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ-এর প্রণীত স্থাপত্য-নক্সা অনুযায়ী গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রনালয়ের গণপূর্ত অধিদপ্তরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়িত এই রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিসৌধটির বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে ভিন্নমাত্রিক নির্মাণশৈলী এক অন্যরকম মনোবিক্ষেপ তৈরি করে দেয়। এক ভাবগম্ভীর শোক-বিহ্বলতা ছড়িয়ে আছে সবখানে। সৌধ এলাকায় পা রাখলেই বিশাল কালো শোকস্তম্ভটির মতোই এক বিশাল শূন্যতা এসে গ্রাস করে ! স্বজন-হারানো বাঙালির বুকের গভীরে রাখা পাথর-চাপা কষ্টগুলোই উন্মুক্ত হয়ে পড়ে যেন। আকাশে বাতাসে কেবল শূন্যতা আর শূন্যতা...।


গোটা আবহই বলে দেয়, এটা কোন হল্লা করার জায়গা নয়। মৌনতার গুঞ্জনে দোলে কষ্ট-ক্ষরণের জন্যই এখানে আসতে হয়। আর কান পেতে শুনতে হয় সেই কথাটি, প্রজন্ম’৭১-এর কষ্ট-মিছিলে একাত্তরের শহীদদের সন্তানেরা যে প্রশ্ন-ফলকটি গেথে দিয়েছে দেয়ালের গায়- ‘তোমাদের যা বলার ছিল বলছে কি তা, বাংলাদেশ ?’


ডান দিকের অন্য গেট দিয়ে বেরিয়ে এলে দেয়ালে আটকানো আরেকটি ফলক চোখে পড়বে। ওখানে লেখা- ‘রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিসৌধ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, ৩০শে অগ্রহায়ণ ১৪০০ বাংলা, ১৪ই ডিসেম্বর ১৯৯৩ ইং।’


এটুকু পড়ে আমার মতো ইতিহাস-কানা’রা অবশেষে একটা বিভ্রান্তি নিয়েই ফিরবেন ! আর ভাববেন, দুই সময়কালের দুইজন প্রধানমন্ত্রী একই স্মৃতিসৌধের দুইবার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন ! কেন...?







(বধ্যভূমির আরো ছবি..)

[sachalayatan]
[somewherein]

Monday, January 12, 2009

# এই সেই বহুল আলোচিত জল্লাদখানা...!


এই সেই বহুল আলোচিত জল্লাদখানা...!
রণদীপম বসু

এই সেই বহুল আলোচিত জল্লাদখানা ! যাকে এখন সবাই জানে ‘জল্লাদখানা বধ্যভূমি ১৯৭১’ নামে। মিরপুর দশ নম্বর গোলচক্কর থেকে এগার নম্বরের দিকে কিছুটা আগালেই মিরপুর বেনারশি পল্লীর প্রথম গেট ধরে পাকা রাস্তাটা আধা কিলোতক যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, ঠিক সেখানেই একটা বড়সড় সাইনবোর্ডের কালো জমিনে সাদা সাদা বড় হরফে উপরোক্ত কথাটি চোখে পড়বে- ‘এই সেই বহুল আলোচিত জল্লাদখানা।’

পাশের ‘zaf’ চিহ্ণিত দালানটিই একাত্তরের সেই কুখ্যাত ‘পাম্পহাউজ’। যার কূপের সামনে একাত্তরের ঘৃণ্য আলবদর রাজাকাররা বহু নিরপরাধ বাঙালিকে ধরে এনে শিরচ্ছেদ ও হত্যা করে পাম্পহাউজের পানি ভর্তি কূপ-গহ্বরে নিক্ষেপ করতো। এলাকার বিভিন্ন স্থানে শহীদ হয়েছেন এমন আরো অনেকের লাশও টেনে এনে ফেলা হতো এখানে।

১৯৭১ সালে বিহারী অধ্যুষিত মিরপুরের অনেকগুলো জায়গাই হয়ে উঠেছিলো বধ্যভূমি। এমনি দুটি স্থানে পরে ১৯৯৯ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর খননকাজ চালায়। স্থানীয়ভাবে এই জায়গা দুটি পরিচিত ছিল জল্লাদখানা ও নূরী মসজিদ বধ্যভূমি হিসেবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক বিগ্রেডের সহযোগিতায় এই জল্লাদখানা বধ্যভূমি থেকে ৭০টি মাথার খুলি ও ৫৩৭২টি অন্যান্য অস্থি উদ্ধার করা হয়।

আর নূরী মসজিদ বধ্যভূমি থেকে উদ্ধারকৃত খুলি ও হাড়গোড়ের সঙ্গে পাওয়া গিয়েছিল ছিন্ন জামা-কাপড়, ওড়না-শাড়ি-ফ্রক, জুতো স্যান্ডেল, মানিব্যাগ, তসবি ও ব্যক্তিগত ব্যবহারের অনেক জিনিস। তার কতক নমূনা এই জল্লাদখানা বধ্যভূমির মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সর্বসাধারণের প্রদর্শনের জন্য রাখা হয় সেই অভিশপ্ত কূপটির পাশে। এবং কূপটিকে সিমেন্ট বাধাই করে ভারী কাঁচ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে বর্বরতার স্মারক চিহ্ণ হিসেবে। সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত এই স্মৃতিভূমি আজো ফিরে ফিরে স্মরণ করিয়ে দেয় গণহত্যার শিকার প্রত্যেক শহীদের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা।

এই শোকস্মৃতিকে ধরে রাখতে পাম্পহাউজ চত্বরে নির্মিত ‘জীবন অবিনশ্বর’ নামের স্মারক ভাস্কর্যটির দিকে তাকালে থমকে যেতে হয় ! এর পরিকল্পনা ও নির্মাণে শিল্পী রফিকুন নবী ও মুনিরুজ্জামান। গোটা চত্বর জুড়ে শানবাঁধানো ফলকে অঙ্কিত রয়েছে এ যাবৎ খুঁজে পাওয়া দেশের বিভিন্ন বধ্যভূমির তালিকা, বহু শহীদের নাম এবং বিংশ শতাব্দিতে ঘটে যাওয়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উল্লেখযোগ্য বর্বর গণহত্যার তথ্য। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন বধ্যভূমি থেকে সংগৃহিত মাটি এনে কাঁচের আধারে সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়েছে স্মৃতি হিসেবে।

জল্লাদখানা বধ্যভূমির গেট দিয়ে ঢুকেই মনে হবে গা শিন শিন করা কোন এক নিঝুমপুরীতে বুঝি পা রাখলাম ! এখানকার আবহটাই এমন যে, হাতে গোনা দর্শনার্থীরা এসে অজান্তেই কী এক নির্জন নীরবতার মধ্য দিয়ে ঘুরে ঘুরে এই ছোট্ট পরিসরের মধ্যেই এক শোকবিভোর উপলব্ধিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েন। কেউ কেউ মন্তব্য বইয়ে লিখে যান ইচ্ছেখুশি, অনেকেই মনের কথা মনে চেপেই ফিরে যান।

মুক্তিযুদ্ধের ন’মাসের রক্ত আর মৃত্যুর নদী পেরিয়ে স্বজন হারানোর আর্তি আর বিজয়োল্লাস যখন একাকার, তখুনি অকস্মাৎ যে ভয়াল বিষাদের ভারে গোটা জাতি স্তম্ভিত মুহ্যমান হয়ে পড়ে, তা হলো একের পর এক অসংখ্য বধ্যভূমির আবিষ্কার ! বর্বর নিষ্ঠুর কায়দায় পড়ে থাকা স্বজনের বীভৎস বিকৃত গলিত লাশের গন্ধে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠে ! ভারী হয়ে উঠে জাতির হৃদয়, বিশ্ব মানবতার বিবেক হয়ে যায় স্তব্ধ ! সে ভার আর কখনো নামানো যায় নি এ জাতির বুক থেকে। দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত সবখানেই ওঠে আসে বধ্যভূমি আর বধ্যভূমি ! সোনার বাঙলাকে সত্যিই শ্মশান করে দিয়েছে ওরা !

এই সব ভয়াল গণহত্যার হোতা ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীরাই একদিন আবার এ জাতির হর্তাকর্তারূপে আবির্ভূত হতে দেখা গেলো। এক সাগর রক্ত আর লক্ষ লক্ষ মৃত্যু আর মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পাওয়া লাল সবুজের পতাকা শোভিত হয়ে অপমানের পাশাপাশি এই কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের দ্বারা মহান জাতীয় সংসদও কলঙ্কিত হলো। যেসব ভণ্ড প্রতারক শাসকগোষ্ঠী এই স্তম্ভিত জাতির আর্তিকে তোয়াক্কাও না করে সেই বর্বর যুদ্ধাপরাধীদেরকে পূনর্বাসন পৃষ্ঠপোষকতা করে করে আবারো বিকৃত দানবে পরিণত করার ষড়যন্ত্রে ইন্দন জুগিয়েছে, তারাও আজ সমান অপরাধী।

তাই আজ গোটা জাতির একটাই প্রত্যাশা, সব সহযোগীসহ একাত্তরের ওইসব মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদেরকে অবিলম্বে বিচারের কাঠগড়ায় তুলতে হবে। এ জাতির কপাল থেকে লজ্জাকর কলঙ্কের দাগ মুছতে হলে একটাই পথ- একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই-ই চাই ! কেননা যতক্ষণ বিচার না হবে, আগামী প্রজন্মের কাছে বিশ্বমানবতার কাছে আমরাও যে ক্ষমার অযোগ্য পশুই থেকে যাবো..! মানুষ হতে পারবো না..!
(জল্লাদখানার আরো ছবি)

[sachalayatan]
[somewherein]

Friday, January 9, 2009

# আপনি কেন বাণিজ্য মেলায় যাবেন...


আপনি কেন বাণিজ্য মেলায় যাবেন...
রণদীপম বসু

বাণিজ্য মেলায় গিয়ে বোকারা জগৎ সংসার ভুলে কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর আমার মতো বুদ্ধিমান যারা, তার তখন হ্যাবলার মতো চেয়ে থাকে স্টলগুলোর দুর্দান্ত বাহারি সব ডিজাইগুলোর দিকে।

বাণিজ্য মেলাতে গিয়ে কিছু কেনার চাইতেও বুদ্ধিমানদের আকর্ষণ যে ওই বাহারি স্টলগুলোর দিকে, তার কারণ হলো দু’টো। চাইলেও কেনাকাটা করার সংগতিশূন্যতার বোধ ডিস্টার্ব করার সুযোগ তো পায়ই না, বরং একটা নান্দনিক তৃপ্তি সারাক্ষণ ছড়িয়ে থাকে মন ও মনন জুড়ে। অতএব আপনি কেন বুদ্ধিমান হবেন না..!

তাহলে চলুন ঢাকার আগারগাওয়ে চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের পাশেই সদ্য শুরু হওয়া চতুর্দশ ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা ২০০৯ থেকে ঘুরে আসি একবার। মেলায় প্রবেশমূল্য ধরা হয়েছে সাধারণ জনপ্রতি ১২টাকা, শিশুদের জন্য ৭টাকা করে।

রথ দেখাটাই আসল। সাথে যদি কলা থেকেই থাকে, বেঁচতে তো আর কেউ বাঁধা দিচ্ছে না ! তবে একই সাথে এও বলে রাখি, আয়োজকরা কিন্তু ঠিকই জানেন যে, এখানে বুদ্ধিমানরা দেখতেই আসেন। এবং শেষ পর্যন্ত বোকা হয়েই ফিরে যান...! হা হা হা !

তবে আমি কিন্তু বোকা হইনি...!













[মেলার আরো ছবি]

[sachalayatan]
[somewherein]