Monday, November 24, 2008

@ ইহা কাজের কথা নয়














ইহা কাজের কথা নয়
রণদীপম বসু

চল্লিশার প্রভাব কিনা জানি না, সাদাকে কালো বলিয়া ভ্রম হইতেও পারে। তথাপি যাহা দেখিতেছি তাহার জন্য মনটা হু হু করিয়া উঠিল। এইরকমের বিরল হইয়া যাওয়া দৃশ্য কতোকাল যাবৎ দেখিতেছি না ! ছয়-সাতটি বছর তো গত হইয়াই গেল !

সুরমার ব্যঞ্জনা মাখিয়া চক্ষু দুইখানা উজ্জল হইল কিনা কে জানে। ভক্ত আশেকান কর্মী সমর্থক বেষ্টিত হইয়া ধবধবে পোশাক পরিয়া তিনি বয়সকে দমাইয়া রাখিয়া যেইভাবে মহল্লার সদর রাস্তাটিকে এইপার ওইপার করিতে লাগিলেন, ভাবিতে লাগিলাম, আহা, এইরকম স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া কয়জনে ইহা করিতে পারে ! নেতা হইবার যোগ্যই বটে ! এইরূপ ঘটা করিয়া কুশল বিনিময়ের হেতু বুঝিয়া উঠিতে আমার গুটিকয় মুহূর্ত চলিয়া গেলো। হঠাৎ করিয়া মাথার ভিতরে দিব্যজ্ঞান আসিয়া ভর করিতে লাগিল। কোনরূপ শ্লোগান বা স্বরোৎক্ষেপণ না ঘটিলেও নেতাজীর ভক্তকূলের মুখভঙ্গি অবলোকন করিয়া কীভাবে যেনো তাহাদের বক্ষাভ্যন্তরে গুমড়াইয়া উঠা কথাগুলি দিব্যকানে শুনিতে লাগিলাম- আসিতেছে শুভদিন অমুক ভাইয়ের সালাম নিন, তোমার ভাই আমার ভাই অমুক ভাই অমুক ভাই !

এইবার দিব্যচোখ বর্তমান পার হইয়া কয়েক কদম আগাইয়া গেল। মনের মাধুরি মিশাইয়া চারিদিকে কতকিছু উৎকীর্ণ দেখিতেছি। অমুক ভাইয়ের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র, আর কোন চিন্তা নাই আসিয়াছেন তমুক ভাই, মা-বইনেরা সালাম নিন শমুক ভাইরে চিনে নিন, তমুক ভাইকে রায় দিন জনসেবার সুযোগ দিন। দিব্যদৃষ্টি কাঁপিতে লাগিল, কেননা হঠাৎ করিয়া জনসেবকের ভীড় দ্রুত বাড়িয়া যাইতেছে। রীতিমতো ঠেলাঠেলি পড়িয়া গেল। কাহার আগে কে জনসেবায় ঝাঁপাইয়া পড়িবে তাহার ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা লাগিয়া গিয়াছে। এ উহাকে ঠেলিতেছে, সে তাহাকে ধাক্কাইতেছে, তিনি উনাকে গুঁতাইতেছেন। একেবারে হৈহৈ রৈরৈ কাণ্ড বাঁধিয়া গিয়াছে। বহুদিনের অনভ্যস্ত দৃষ্টি তাহা সহ্য করিতে পারিল না। অধিকতর সমস্যার আশঙ্কায় তাড়াতাড়ি দিব্যজ্ঞান গুটাইয়া পুনরায় বর্তমানে আসিয়া খাড়া হইলাম। এ কী ! এইবার আমিই কুশল বিনিময়ের লক্ষ্য হইয়া গেলাম ! তাঁহার বিগলিত বদনের উষ্ণতায় শেষপর্যন্ত আমি অধমও বুঝি গলিয়া গেলাম।

বিগলিত বক্ষে হাঁটিতেছি আর ভাবিতেছি, এই ভূ-ভারতে আর কোন্‌ দেশটি রহিয়াছে যেইখানে নিজের খাইয়া বনের মোষ তাড়াইবার মতো জনসেবা করিবার জন্য চারিদিকে হুড়াহুড়ি লাগিয়া যায় ? হঠাৎ করিয়া প্রশ্ন জাগিল, জগতে কোন্‌ দেশের নাগরিকদের মধ্যে জনসেবার আগ্রহ শীর্ষ অবস্থানে রহিয়াছে ? প্রশ্নটা যথার্থ হইল কিনা জানি না। কিন্তু জ্ঞান-গম্যির সীমা-পরিসীমা আতিপাতি করিয়া খুঁজিয়াও ইহার উত্তর পাইলাম না। সম্ভাব্য গ্রন্থ-পুস্তকাদিও ঘাঁটাঘাটি করিয়া ফেলিলাম প্রচুর। সকলই বৃথা হইল। জ্ঞানের জন্য সুদূর চীন দেশে যাইতেও বাধা নাই জানিয়া অবশেষে যাহাকেই সামনে পাই তাহাকেই প্রশ্ন করিতে লাগিলাম। কেহ নিজের অজ্ঞানতা প্রকাশ করিল, কেহ ভাবিল বিদ্রুপ করিতেছি, আবার কেহ ভাবিল এইবার সারা হইয়াছে ! মস্তিষ্কের আশু সার্ভিসিং প্রয়োজন জ্ঞান করিয়া তাৎক্ষণিক পরামর্শটুকু জানাইয়া দিতেও কেহ কেহ দ্বিধা করিল না। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর না পাইয়া আমি যে কীরূপ মর্মাহত হইলাম, তাহা কেহই বুঝিল না। সবাই কি তাহলে অন্ধ হইয়া গেল !

যেই দেশে জনসেবা করিবার সুযোগ হাতছাড়া হইবার আশঙ্কায় প্রতিযোগী জনসেবককে খুন করিয়া ফেলাটা বিস্ময়ের কিছু নয়, অধিক জনসেবা করিবার আশায় গোষ্ঠী বা দলের বড় পদে অধিষ্ঠিত হইতে মুহূর্তকালের মধ্যেই মারামারি লাগিয়া যায়, অথবা কে কাহাকে ছাড়াইয়া আরো তীব্রতর জনসেবা করিতে পারে সেই প্রচেষ্টায় একে অন্যের চরিত্র লুণ্ঠন করিতে সর্বশক্তি লইয়া ঝাঁপাইয়া পড়ে, কিংবা জনসেবার কিঞ্চিৎ সুযোগ পাইবার নিমিত্তে সকাল-বিকাল দল বদলের গড়াগড়ি করিতেও বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করে না, সেই দেশের নাগরিক হইয়া নিজেদের গর্বকেও ঠাহর করিতে পারিল না কেহ ! ইহা কি মর্মাহত হইবার মতো কথা নয় ! জনসেবার আগ্রহে সর্বাধিক পয়েণ্টে বিজয়ী নাগরিকের গর্বিত দেশটির নাম যাহারা বলিতে পারিল না, তাহাদের জন্য আমার অনুতাপ হইতে লাগিল। তাহারা কি এখনো দেখিতেছে না যে, দেশ ও দশের সেবা করিবার মনোবৃত্তি লইয়া নিজ নিজ দলের মনোনয়ন প্রত্যাশায় চতুর্দিকে কীরূপ ব্যতিব্যস্ত অবস্থার উদ্রেক হইয়াছে ! কেহ কেহ সাঙ্গপাঙ্গ লইয়া দলীয় প্রধানের কার্যালয় বা বাসভবনের সম্মুখে ধনুর্ভঙ্গ পণ লইয়া অবস্থান ধর্মঘটে বসিয়া গিয়াছে, জায়গার সঙ্কুলানে কাড়াকাড়ি পড়িয়া গিয়াছে। জনসেবাই যদি করিতে না পারিল তাহা হইলে এই জীবন আর রাখিয়া কী হইবে ভাবিয়া কেহ কেহ আমরণ অনশনের কর্মসূচি জানাইয়া দিয়াছে। কেহ কেহ জনসেবা করিবার দলীয় টিকিট না পাইয়া তীব্র হতাশায় গাড়ি-ঘোড়া-দোকান-পাট ইত্যাদি ভাঙচুর এবং জ্বালাও পোড়াও শুরু করিয়া দিয়াছে ! আবার কেহ কেহ তো জনসেবার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষায় বিদ্রোহী প্রার্থী হইয়া নিজের যোগ্যতা দেখাইয়া দিতে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া দিয়াছে ! দেশের ও দশের এই অভূতপূর্ব সেবা করিবার তীব্রদাহন কে কবে কোথায় আর দেখিয়াছে এমন !

সেবা গ্রহণের বা হজমের যোগ্যতা মূর্খ জনগণের না থাকিতে পারে। তাই বলিয়া যেই দেশে সেবা করিবার এইরকম মারাত্মক ইচ্ছাধারণকারী জনসেবকের অবিরল বন্যা বহিয়া যায়, সেই দেশের ভবিষ্যৎ লইয়া যাহারা দুশ্চিন্তা করিয়া রাত্রির ঘুম নষ্ট করিয়া ফেলে, তাহাদের জন্য অনুতাপ করিতে করিতে আমিও কি ঘুম নষ্ট করিব ? ইহা কাজের কথা নয়।

হঠাৎ জাগিয়া উঠিলাম! কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। চারিদিকে এইসব যাহাকিছু ঘটিতেছে, সকলকিছুই কি স্বপ্নের মধ্যেই ঘটিতেছে! আমি কি তবে ঘুমাইয়াই আছি? ইহার উত্তর দিবার মতো কেহ কি কোথাও জাগিয়া নাই ?
(২৩/১১/২০০৮)

[sachalayatan]
[mukto-mona blog]
[khabor.com]
[sa7rong]

Wednesday, November 19, 2008

@ ছেঁড়া ঘুড্ডি ...(০১)














ছেঁড়া ঘুড্ডি ...(০১)
রণদীপম বসু

‘যেখানে দেখিবে ছাই/ উড়াইয়া দেখ তাই/ মিলিলে মিলিতে পারে/ অমূল্য রতন...।’ কে লিখেছিলেন ? রামনিধি গুপ্ত ? ঈশ্বর গুপ্ত ? না কি অন্য কেউ ? এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তবে এই চরণগুলো সেই শৈশব-কৈশোরে স্তোত্রের মতো ঠোটস্থ করেই কি ক্ষান্ত হয়েছিলাম ? মোটেই না। স্তোত্র বা শ্লোক কি আর মিথ্যে হতে পারে !

আজ থেকে ত্রিশোধিক বছর পূর্বে মফস্বল শহরগুলোতে এখনকার মতো তো আর প্রাকৃতিক জ্বালানী গ্যাসের কায়কারবার ছিলো না। লাকড়ি, খড়ি, তুষ, শুকনো লতা-পাতা খড় নির্ভর চুলাসমৃদ্ধ বাঙালির রান্নাঘরের বাইপ্রোডাক্ট বর্জ্য হিসেবে ছাইয়ের চেয়ে হীন তুচ্ছ পদার্থ আমাদের ইহলৌকিক জীবনে আর কিছু ছিলো বলে জানা ছিলো না। পরিবারের সবচেয়ে অকর্মণ্য অপদার্থ ছেলেটিকেও যখন বলা হতো ‘তোর পাতে ছাই দেবো’, শতকরা নিরানব্বইভাগ সম্মানবোধহীন ছেলেটিরও বাকি একভাগ সম্মানবোধ ধপ করে জ্বলে উঠতো অপমানে ! দেশ-গাঁয়ের বাক্যবাণ সমৃদ্ধ ঝগড়াটে দুই প্রতিবেশিনীর ঝগড়ার চূড়ান্ত অস্ত্র প্রয়োগ হতো ‘তোর মুখে ছাই পড়ুক’ বলে। অতএব এতো হীনমানের বস্তুটি যে হাটেমাঠেঘাটে পথে গলিতে যত্রতত্র অতি সহজলভ্য হবে তাতে আর বিচিত্র কি !

আজ যারা অগ্নিমূল্যে ক্রয়কৃত মাছের সাথে মহার্ঘ গিফট হিসেবে এক পুটলি ছাই পেয়ে খুশিতে আটখানা হয়ে উঠেন, তাদের কথা ভেবেই সেই যুগের ভবিষ্যৎদ্রষ্টা কবি উপরোক্ত চরণগুলো রচনা করেছিলেন কিনা কে জানে। তবে অতি তুচ্ছ এই ছাইয়ের মধ্যে অমূল্য রতনের এতো সহজলভ্য উৎসের খোঁজ পেয়ে আমাদের সেই বালকবেলার রত্নপ্রাপ্তির প্রেরণা যে কোথায় গিয়ে ছুঁয়েছিলো তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে ! আশে পাশে কাছে দূরের যতো টাই করা ছাই আর ছাইয়ের ডিপো ছিলো প্রতিদিন সেগুলোর দশমদশারও দফারফা ঘটতে লাগলো। ঘাটাঘাটির চূড়ান্ত আর উড়ানো প্রক্রিয়া যথাযথভাবে সম্পন্ন করে ব্যর্থ অনুসন্ধান শেষে প্রতি ত্রিসন্ধ্যায় যে ভস্মমূর্তি ঘরে ফিরে আসতো তার বর্ণনা আর না-ই দিলাম। এই ত্রিকালমূর্তি দশায় ‘ওরে মুখপোড়া, ওই ছাইভস্মের মধ্যে পড়ে না থেকে আমার হাড় জ্বালাতে এখানে এলি কেন ! যা হতভাগা ওই ছাইভস্মে যা!’ মায়ের অনিবার্য বর্ষণে তোয়াক্কা না করলেও ছাই সম্পর্কে তাঁর অজ্ঞানতার করুণ হাল দেখে বিস্মিত হতাম বৈ কি। এতে অবশ্য পরের দিনের উদ্যমে কিছু মাত্র ভাটা পড়তো না। মা না জানতে পারে, তাই বলে ইস্কুলের বইয়ে কি আর মিথ্যে লিখেছে !

আহা, কি দিনগুলো চলে গেছে ! হঠাৎ করে আয়নায় একদিন দেখি আমি বড় হয়ে গেছি ! আসলেই কি বড় হয়েছি ? অমূল্যের সন্ধান না পেয়েই সেই রত্ন-সন্ধানী শৈশব আর কৈশোর কি সত্যিই হারিয়ে গেছে ? এক বিশাল শূণ্যতা বুকে নিয়ে এখনো ছাই খুঁজে ফিরি আমি। অথচ আশেপাশে তাকিয়ে মনে হয়, কী ভীষণ ছাইভস্মের মধ্যে এই জীবনটাকে নিয়ে গড়িয়েই যাচ্ছি কেবল ! কিন্তু কোথাও আর আমার সে-ই ছাই দেখি না...!
(১৯/১১/২০০৮)

[sachalayatan]

@ ‘স্বভাব যায় না মইলে !'












‘স্বভাব যায় না মইলে’
রণদীপম বসু

আমাদের দেশে নিবন্ধিত ভোটার সংখ্যা কতো ? আট কোটি ? সঠিক সংখ্যাটি এ মুহূর্তে হাতে নেই আমার। আট কোটির ধারে কাছে হবে হয়তো। সেক্ষেত্রে কতজন তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন বা করার সুযোগ পান ? এই হিসাবটা হয়তো চলে আসে নির্বাচনের ফলাফল থেকে। আমাদের জাতীয় নির্বাচনগুলোর বিগত ইতিহাস অনুযায়ী মোট ভোটারের ষাট থেকে পঁয়ষট্টি ভাগ ভোটার তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করলেই মোটামুটি সফল নির্বাচন হয়েছে বলে সরকারীভাবে ধরে নেয়া হয়। এখানে যে ভোটগুলো অধিকার প্রয়োগ করা সত্তেও প্রক্রিয়াগত ভুলে নষ্ট হয়ে যায় তা বাদ দিলে মোটা দাগে আমরা ধরে নিতে পারি যে ন্যুনতম শতকরা পঁয়ত্রিশ ভাগ ভোটার তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন নি। এদের কত ভাগ ভোটার তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চেয়েছেন বা চান, কিন্তু তাঁদের অধিকার প্রয়োগের সুযোগ বা সামর্থ না থাকায় তা প্রয়োগ করতে পারেন নি বা পারছেন না, এ বিষয়টা নিয়ে কোন জরিপ হয়েছে কিনা জানা নেই। কিন্তু অধিকার সুরক্ষার প্রসঙ্গ এলে এ বিষয়টি কি বিবেচনায় না এসে পারে ? দেশের বর্তমান রাজনৈতিক জটিলতায় বহুপাক্ষিক ধস্তাধস্তির মধ্যে হঠাৎ করে আনুমানিক চল্লিশ হাজার পবিত্র হজযাত্রীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়টি রাজনৈতিক এজেণ্ডায় চলে আসায় বিষয়টাকে আর খাটো করে দেখার কোন উপায় নেই।

হজযাত্রীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ দেবার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে যারা সোচ্চার হয়ে উঠেছেন তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আপাত দু’টো সম্ভাবনা আমরা ধারণা করতে পারি। আট কোটি ভোটারের স্বাপেক্ষে যে বিপুল অংশ তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পাচ্ছেন না, তাদের কথা বেমালুম চেপে গিয়ে শতকরা হারে অতিনগন্য পরিমাণ হজযাত্রী ভোটারের ইস্যুকে সংবেদনশীল করে তুলে এরা হয় খুব হীন রাজনৈতিক খেলায় বিপজ্জনকভাবে মেতে উঠতে চাচ্ছেন। নয়তো খুব যৌক্তিকভাবে সবার ভোট দেয়ার অধিকার সমুন্নত রেখে অধিকার প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টির দাবীতে সোচ্চার হতে চাচ্ছেন। কোনটা ঠিক ? রাষ্ট্র পরিচালনায় আগ্রহী দল বা ব্যক্তিবর্গ প্রথমোক্ত সম্ভাবনায় সংশ্লিষ্ট থাকতে পারেন এমনটা আমরা বিশ্বাস করতে চাইবো কেন ? তাহলে যে রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের আগ্রহ ও যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন এসে যায়, আদৌ তাঁরা এর যোগ্য কিনা। স্বকল্পিতভাবে আমরা কেন তাঁদেরকে এতোটা অযোগ্য ভাববো ? তার চেয়ে বরং দ্বিতীয় সম্ভাবনাকেই বিবেচনায় নিতে পারি। অর্থাৎ আগ্রহী ভোটারদের অধিকার প্রয়োগের সুযোগ দিতেই তাঁরা সোচ্চার হয়েছেন বলে ধরে নেবো। সত্যি কি তাই ? ‘মাগো মা, তোরে আমি বেঁইচা দিমু। তয় এমন দাম চামু, কেউ কিনতেই পারবো না !’

গোটা দেশের ছড়ানো ছিটানো চল্লিশ হাজার হজযাত্রীরা ইহলৌকিক হিসাব নিকাশগুলো আপাতত স্থগিত রেখে এক পরম আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্যে যখন পবিত্র হজের প্রতি তাদের দেহমন উৎসর্গ করে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেদেরকে সমর্পিত করেন, তখন ভোটের মতো জাগতিক বিষয়ে তাঁদের আদৌ কোন মনোযোগ থাকে কিনা সেদিকে আমরা না-ই গেলাম। বিষয়টা যখন অধিকার প্রয়োগের, আমাদেরকে নৈতিকভাবে মানতে হবে যে চল্লিশ হাজার না হয়ে কেবল চল্লিশ জন হলেও এ অধিকার প্রয়োগের সুযোগ অবশ্যই সবারই প্রাপ্য। আর তখনই আমাদেরকে দেখতে হয় এই সমানাধিকার সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হচ্ছে কিনা। এখন প্রশ্ন, তাঁদেরকে অধিকার প্রয়োগে কেউ বাধাদান করছে কিনা। কেউ কি বাধাদান করছে ? তাঁরা তো তাঁদের স্বেচ্ছাকৃত পথটাই বেছে নিয়েছেন। এখানে পাল্টা কোন প্রশ্ন উত্থাপনের আগে খুব সমান্তরালভাবে আমাদের অন্যুন পঞ্চাশ লাখ প্রবাসী ভোটারদের অধিকার প্রয়োগের বিষয়টাকেও উত্থাপন করতে পারি। এখন কেউ হয়তো বলতে পারেন, তাঁদেরকে কেউ কি তাঁদের অধিকার প্রয়োগে বাধা দিয়েছে ? তাঁরাই তো তাঁদের স্বেচ্ছাকৃত পথটাকে বেছে নিয়েছেন। তাহলেও প্রশ্ন দাঁড়ায় তাঁদের সংখ্যা কিন্তু পঞ্চাশ হাজার নয়, পঞ্চাশ লাখ ! তাঁদের অধিকার প্রয়োগের বিষয়টি নিয়ে কোন দল বা গোষ্ঠী কি কখনো জোরালো আগ্রহ দেখিয়েছেন, যারা বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন ? অথচ এই প্রবাসীদের প্রেরিত বৈদেশিক মূদ্রা আমাদের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে যথারীতি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে আসছে এবং আগামীতেও রাখবে।

এখানেও কেউ কেউ পুনরায় প্রশ্ন উঠাতে পারেন, আমাদের পবিত্র হজযাত্রীরা হজকালীন সময়টাতে চাইলেই ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য ছুটে আসতে পারবেন না। আগামী আঠারো ডিসেম্বর নির্বাচনের আগে হজ শেষ হয়ে গেলেও প্রক্রিয়াগত কারণেই ধরে নিচ্ছি অর্ধেকের মতো হাজী দেশে ফেরার সুযোগ পাবেন না। তাহলে বাকি বিশ হাজার হাজী চাইলেও তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছেন না। এ বিষয়টা নিয়ে যারা সোচ্চার হয়েছেন তাঁদের জন্য ভিন্ন একটি পরিসংখ্যানের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে পারি আমরা। নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যে সরকারী বেসরকারী কর্মচারীরা চাইলেও তাঁদের অমূল্য ভোটটা দিতে পারবেন না, তাঁরা কি এ দেশের নাগরিক নন ? তাঁদের কি ভোটাধিকার নেই ? এদের সংখ্যা তো কম নয়, বেশ কয়েক লাখ ! এবং আমাদের রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় তাঁদেরকেই কেবল তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ থেকে বাধ্যগতভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে। কই, তাঁদের জন্য তো কোন দল বা গোষ্ঠীকে কখনো কোন দাবী নিয়ে সোচ্চার হতে দেখা যায় নি ! অথচ এই বেশ কয়েক লাখ নাগরিকরা তাদের দেহমনের সামর্থ ও তাদের কর্মক্ষমতা দিয়ে রাষ্ট্রের সেবা করে যাচ্ছেন।

রাজনৈতিক কূটচাল যখন ধর্মকে লেবাস হিসেবে জড়িয়ে নেয়, তা যে কতো সংবেদনশীল বিপজ্জনক হয়ে উঠে, এই ভূখণ্ডের নাগরিকরা বহুবার হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। যারা এই বিপজ্জনক খেলায় মেতে উঠেন তারা যে এই পবিত্র হজযাত্রীদের বিষয়টিকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখেছেন তাই বা বলি কী করে ? তাহলে আমাদের দেশে কতগুলো হাসপাতাল কিনিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ইত্যাদি রয়েছে ? গড়ে কী পরিমাণ গুরুতর রোগী এখানে ভর্তি থাকেন যারা কিছুতেই হাসপাতাল থেকে বের হয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে সক্ষম হবেন না ? এবং সাথে থাকা রোগীর আত্মীয় পরিজন যারা রোগীকে সাময়িক সময়ের জন্যও ফেলে যাওয়া সম্ভব নয় বিধায় তাদেরও ভোটাধিকার প্রয়োগ সম্ভব হবে না, তাদের সংখ্যা কতো ? নিশ্চয়ই অনেক ? বেশ কয়েক লাখ তো অবশ্যই। নির্বাচনের তারিখে গোটা দেশে আমাদের কতজন অন্তসত্ত্বা মা-বোন রয়েছেন যারা গর্ভাবস্থার সর্বশেষ পর্যায়ে রয়েছেন এবং ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়ার মতো শারীরিক সক্ষম অবস্থায় থাকবেন না ? তারা তাদের ভোটাধিকার কীভাবে প্রয়োগ করবেন ? এই বিপুল সংখ্যক ভোটাররা কি তাহলে মানবিক বিবেচনায় আসার যোগ্যতা রাখেন না ? জেলখানায় আটক দাগী আসামী ও অভিযুক্ত অপরাধীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়টি যদি আমাদের বিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের যথাযোগ্য মাথায় জায়গা করে নিতে পারে, তাহলে রাষ্ট্রের সুযোগ্য নিরপরাধ অসুস্থ নাগরিকদের কথা এরা ভাববেন না তা কী করে হয় ?

উপরোক্ত বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা যে ধারণায় এসে পৌঁছে যাই, তাতে আমাদের আদর্শহীন রাজনীতির আরেকটি পুরনো চর্চিত অধ্যায়ই উন্মোচিত হয়ে পড়ে। খুব বিসদৃশভাবেই একটি সেনসেটিভ ধর্মীয় ইস্যুকে কেন্দ্র করে নতুনভাবে এই রাজনৈতিক হীনমনষ্কতা আমাদেরকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলে বৈ কি। পবিত্র হাজীদের বিশ হাজার ছড়ানো ছিটানো ভোট নির্বাচনে আদৌ কোন প্রভাব ফেলবে কিনা জানি না। যদি প্রভাব ফেলতোই, তাহলে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চলতি ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে দশ লক্ষ দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির যে প্রক্রিয়া চলমান তাতে কম করে হলেও গড়ে পঁচাত্তর হাজার সুস্থ কর্মক্ষম নাগরিক যে প্রতি মাসে দেশ ত্যাগ করছেন তাদের হিসাবটাও মাথায় থাকতো। কেননা নির্বাচন একমাস পিছিয়ে যাওয়া মানে পঁচাত্তর হাজার করে নিশ্চিত ভোটারের সংখ্যা কমে যাওয়া। কিন্তু কই, এ নিয়ে তো কেউ টু শব্দটি করছেন না !

পরিবর্তনের আওয়াজ তুলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘটনাবহুল নির্বাচনে যখন এবার সে দেশের নীতিনির্ধারকরা বিপুল পরিমাণ নিষ্ক্রিয় ভোটারকে ভোট কেন্দ্রে এনে গোটা দুনিয়াকে চমক উপহার দিলো, তার রেশ অব্যহত থাকলেও আমরা যে আসলে অন্ধতা ছাড়া কিছুই শিখি না, একটা গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডে আবারো তা প্রমাণীত হলো। ছোট্ট এই গরীব রাষ্ট্রের অসহায় নাগরিক হিসেবে তাই আমাদেরকে অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতেই হয়, 'কয়লা যায় না ধুইলে স্বভাব যায় না মইলে !' আমাদের স্বভাব কি কখনোই পরিবর্তনযোগ্য নয় !
(১৮/১১/২০০৮)

[khabor.com]
[muktangon:nirmaan]
[mukto-mona]
[sa7rong]

Saturday, November 15, 2008

@ আমাদের দিগম্বর তত্ত্ব…!














আমাদের দিগম্বর তত্ত্ব…!
রণদীপম বসু

‘অর্থ গোবর সমতূল্য। ইহা স্তুপীকৃত করিয়া রাখিলে দুর্গন্ধ ছড়ায়। ছিটাইয়া দিলে উর্বরতা বৃদ্ধিকারক সার হয় এবং ফলন বৃদ্ধি করে।’ ছাত্রত্বের সেই কৈশোরকালে ভাবসম্প্রসারণ বা রচনা জাতীয় কিছু মুখস্ত করা বাক্যগুলো এখনো যে জ্বলজ্বল করে স্মৃতিতে ভেসে উঠে, তা কি কৈশোরিক স্পর্শকাতর স্মৃতির কৃতিত্ব, না কি অনেককিছুই বদলে যাওয়া সমকালীন দীর্ঘশ্বাসের নষ্টালজিক আবেগ, তার পার্থক্য টানা দুরুহ। তবে যে কর্পোরেট সময়কালে আমরা এখন অবস্থান করছি, এর প্রতিটা মুহূর্তের জন্য, প্রতিটা নিঃশ্বাসের জন্যই আমাদেরকে বিনিময়হারে অর্থমূল্য গুনতে হয়। কথাটাকে মনে হয় হাইপোথিটিক্যাল মন্তব্য হিসেবে উড়িয়ে দেয়ার কোন উপায় নেই। তা যে আক্ষরিক অর্থেই পূর্ণভাবে সত্য, একটু তলিয়ে ভাবলেই খুব স্পষ্ট হয়ে উঠে। অর্থাৎ এই অর্থ বা কড়ি আমাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস থেকে শুরু করে আমাদের প্রতিটা মুহূর্ত, মৃত্যুকাল বা মৃত্যুপরবর্তী সময়েও অতি আবশ্যকীয় অনুষঙ্গ হিসেবে আষ্টেপৃষ্ঠে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে তা থেকে আমাদের মুক্তি নেই। তবে কি এই মূর্ত-জগতের ব্যবহারিক অধিপতি মানুষ প্রজাতিটা আসলে পরাধীন ! আসলেই তাই। রাস্তার ফকির থেকে ক্ষমতার শীর্ষদেশে অবস্থানকারী প্রাসাদবাসী ব্যক্তিটিও প্রকৃত অর্থে পরাধীনই। জ্যাঁ জ্যাক রুশো কি আর এমনি এমনি বলেন, ‘Man born free but chained in everywhere !’

এই শৃঙ্খল, এই পরাধীনতা অস্বীকার করা বা এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই। সভ্যতার অনিবার্য শর্ত হিসেবে তা এড়িয়ে যাবোই বা কীভাবে ! সভ্যতার অপরিমেয় দীর্ঘ চেইনের এই যে অতিক্ষুদ্র অংশ আমরা প্রত্যেকে, সেই চেইন তো বহু বিস্তৃত বহুধাবিভক্ত একটা অভিন্ন প্রবাহমাত্র। এই প্রবাহে রয়েছে ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক, আন্তর্জাতিক, সময়কালিক হাজারো লক্ষ শাসন, অনুশাসন, নিয়ম-নীতি, বিধি-বিধান, স্বপ্ন পরিকল্পনা, অধিকার ও ব্যবহারের আন্ত-প্রসারী পারস্পরিক গ্রন্থিতে আটকানো একটা ধারাবাহিকতা, চেইন রিং-এর মতোই। এখানে বিশ্লিষ্ট হবার সুযোগ কোথায় ? চেইন সে যতো দীর্ঘ আর বিস্তৃতই হোক, অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আংটা বা রিং-এর পারস্পরিক বন্ধনেই তো সে চেইন। একটা রিং ছুটে যাওয়া মানেই এর অবিচ্ছিন্নতা ক্ষুণ্ন হওয়া, শৃঙ্খলা ভেঙে যাওয়া, ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়ে যাওয়া, পূর্ণতা বা নেটওয়ার্কিং এলোমেলো হয়ে যাওয়া। অতএব চেইনের একটা রিংও তার নিজের ও পারস্পরিক স্বার্থেই নিজেকে সার্বভৌম ঘোষণা করার অধিকার পেতে পারে না। আমি স্বাধীন, এই ঘোষণা দিয়ে হঠাৎ নেংটো হয়ে সর্বসমক্ষে রাস্তায় নেমে যেতে পারি না আমরা। আর এখানেই স্বাধীনতা বা পরাধীনতা শব্দগুলোর বহুমাত্রিক অর্থময়তার সাথে স্বেচ্ছাচারিতা জাতীয় শব্দগুলোর মাত্রাগত পার্থক্যও স্পষ্ট হয়ে উঠে আমাদের কাছে। তাহলে আবারো বলতে হয়, আমরা কি শুধুই পরাধীন ?

একইভাবে অর্থের বা টাকা-কড়ি বিষয়ক যে আর্থিক শৃঙ্খলে আমাদের সক্রিয় অবস্থান, এর সাথে একটা রোবটিক অন্তর্জালের কতটুকু তফাৎ ? জীবন মানেই কি একটা বস্তগত যান্ত্রিক প্রণালীতে প্রশংসনীয় অভ্যস্ততার যোগ্যতা প্রদর্শন এবং তাতে প্রশ্নহীন আনুগত্য প্রকাশ করে যাওয়া শুধু ? না কি অন্য কিছু ? মূলত এই প্রশ্নেই নিহিত থেকে যায় যুক্তি ও কল্পনাপ্রবণ সৃজনশীল মানুষের সাথে বাদবাকি সৃষ্টির মৌল ব্যবধানটা। হয়তো প্রশ্নহীন আনুগত্য প্রকাশের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে আমরা যার যার লোকদেখানো অবস্থানের শালীন প্রকাশ ঘটিয়েও ফেলতে পারি। এতেই কিন্তু সবকিছুর মীমাংসা হয়ে যায় না। বরং বিষয়টাকে আমাদের উপলব্ধির দোরগোড়ায় বসিয়ে যদি একটু নেড়েচেড়ে চেখে দেখার চেষ্টা করি, তাহলেই হয়তো নিজস্ব অবস্থানটা অন্তত নিজের কাছেই আরেকটু খোলাশা হয়ে উঠার সম্ভাবনা থাকে। এবং সত্যিই যদি নিজের কাছে আমরা সৎ ও আন্তরিক হয়ে থাকি। আত্মপ্রবঞ্চনা বা আত্মপ্রতারণা নামের কিছু রহস্যময় আভিধানিক শব্দ আমাদের শব্দ-সঞ্চয়ে থাকলেও ওগুলো যে সত্যিই অর্থহীন বা উদ্ভট-অর্থময় কিছু শব্দ, তা আমরা স্বীকার করি আর না করি, এটা তো বিশ্বাস করি যে, জগতে মানুষ কখনো নিজেকে প্রতারিত করতে পারে না ! যিনি মিথ্যে বলছেন, সবাইকে তা সত্য বলে মানাতে আপাত সক্ষম হলেও তিনি নিজে জানেন যে তিনি মিথ্যে বলছেন, অন্যকে প্রতারণা করছেন।

এখানে যে প্রশ্নটা উঠে আসে, যিনি নিজের কাছে সৎ থাকবেন, পাশাপাশি কোন অধীনতা মানবেন না, আবার সামগ্রিক শৃঙ্খলাও অটুট থাকতে হবে, সামাজিক দায়বদ্ধ মানুষ হিসেবে এসব পরস্পর বিরোধী অবস্থানকে একইসাথে ব্যালেন্স করা কি সম্ভব ? একই সাথে মানি এবং মানি না এই বিপরীতমুখী দু’টো ধারাকেই মানুষের মানবিক অস্থিত্ব নিরাপদ রাখার স্বার্থেই ধারণ করা জরুরি বৈ কি। আর এ জন্যই হয়তো একদিন শিল্পকলার জন্ম হয়েছিলো। নিজস্ব সামাজিক দায়বদ্ধতাকে স্বীকার করেও চলমান ব্যবস্থায় বিদ্রোহীপ্রবণ হয়ে উঠার এবং তা সঙ্কোচহীন প্রকাশের হাতিয়ার হয়ে এলো মানুষের এক অভূতপূর্ব সৃষ্টি যাকে আমরা শিল্পকলা বলেই আখ্যায়িত করেছি। প্রচলিত বিধানকে মান্য করেও ব্যক্তি তার মূল্যবোধ শিল্প প্রতীকের আশ্রয়ে ছড়িয়ে দিতে পারছেন। কারো মনে হলো যে মানুষের আদিম নগ্নতা পোশাকি চেহারা হতেও পবিত্র, নিজে নগ্ন না হয়ে বা কাউকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে নগ্ন না করেও এই চিন্তাকে শিল্পের প্রতীকে উপস্থাপিত করার প্রয়াস নিলেন তিনি। তা গৃহিত হলো কি হলো না সেটা ভিন্নতর প্রেক্ষাপট। কিন্তু তিনি তার প্রণোদনাটুকু প্রকাশ করেও প্রচলিত সভ্য-ব্যবস্থার সাম্যতাকে বিঘ্নিত করছেন না। এটাই সেই ব্যালেন্স। এই চলমান প্রক্রিয়া, চিন্তাধারা, ব্যবস্থা বা প্রথার বিপক্ষে বিদ্রোহ এবং পরিবর্তনের তীব্র উন্মাদনাই যে শিল্পের একান্ত প্রণোদনা তাতে নিশ্চয়ই দ্বিমত করবেন না কেউ। কিন্তু আমার প্রসঙ্গ শিল্পকলার সৃষ্টি বা এর সংজ্ঞা নিরূপণ বা এর এখতিয়ার বা বিস্তৃতি পরিমাপ বা এসব কিছু নয়। মানুষের জীবনে অর্থের প্রভাব কতোটা গভীর বা বিস্তৃত, এবং তা কতোটা হওয়া উচিৎ, কেবল এই বিষয়টাই একটু বাজিয়ে দেখা। আর শাস্ত্রিয় রীতিতে বাজাতে গিয়ে শুরুতেই তাল কেটে পদে পদে যে ত্রাহি অবস্থা তৈরির সম্ভাবনা, তারচেয়ে পণ্ডিত বাজিয়েদের জন্য তা সংরক্ষিত রেখে আমরা বরং একটু অশাস্ত্রিয় বেতালেই এগিয়ে যেতে পারি। চেখে দেখতে পারি, আর্থিক শৃঙ্খলের অনিবার্য বন্ধনে থেকেও মানুষের চিরায়ত স্বাধীন সত্ত্বাকে উন্মুক্ত রাখার বিষয়টাকে আমরা কে কীভাবে দেখি ?

এটা তো ঠিক যে মানুষ হিসেবে আমরা তখনই মানুষ, যখন সবরকম দায়বদ্ধতাকে ধারণ করেও চিত্তের স্বাধীনতা বা মানবিক সত্ত্বাকে উন্মুক্ত প্রসারতায় মেলে ধরতে পারি। কিন্তু সমস্যা হলো চিত্তের স্বাধীন চাওয়াটা নিয়েই। চিত্তের এই স্বাধীনতা যদি হয় ব্যাপক ক্ষমতাশালী হয়ে গরীব দেশের ত্রানের টিন মেরে দেয়া বা বিশাল অংকের ঘুষের বিনিময়ে প্রভাবশালী খুনিকে পার পাইয়ে দেয়া বা রাষ্ট্রিয় সম্পদ নির্বিচার লুটপাট করা, তাহলে আর মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে ক্যাচাল না করে জঙ্গলবাসী হওয়াই উত্তম। বোয়াল মাছের মতো এই যে সবকিছু গিলে খাওয়ার প্রবণতা, এটা হয়তো মানুষের আদিম প্রবৃত্তি, যাকে পশুপ্রবৃত্তি বলা হয়। এটা কি সভ্যতার সেই চেইন বিশ্লিষ্ট হওয়া নয় ? সামাজিক বিধানের চেইন প্রত্যক্ষভাবে ভেঙে ফেলা মানে তো আর প্রচলিত সিস্টেমকে ধারণ করে শিল্পের বিদ্রোহ নয়। অর্থাৎ যিনি এটা ভাঙলেন তিনি তো শিল্পসংস্কৃত ননই, সভ্যও নন এমনকি নিজের প্রতি সৎও নন। তাহলে এর অর্থ কী দাঁড়ালো ? আর এরাই যদি প্রচলিত সিস্টেমের দায়িত্বপ্রাপ্ত নিরাপত্তারক্ষী হন তাহলে শিল্প সংস্কৃতি এসব ধানাইপানাই কথাবার্তা থামিয়ে সরাসরি বলে দেয়া যায় যে আমাদের পুনঃপ্রত্যাবর্তন হচ্ছে সেই জঙ্গলের দিকেই। ইচ্ছে হলেই নেংটো হয়ে যে কেউ রাস্তায় নেমে গেলেও বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। যদিও এই বিস্ময়ও আর বাকি থাকে নি। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে আমাদের প্রাক্তন কোন সংসদ সদস্য যখন মুক্ত হওয়ার কূটকৌশল হিসেবে নিজেকে ভারসাম্যহীন প্রমাণ করতে পরিধানের লজ্জা-নিবারণকারী পোশাক নির্বিকার ঝেড়ে ফেলে দিগম্বর বনে যান। সভ্য দর্শক হিসেবে অধোবদন হয়ে থাকলেই কি আমাদের দায় শেষ ? কীভাবে ভুলে যাই আমরা, এই দিগম্বর এরাই আমাদের মনোনীত প্রতিনিধি ! এরাই আমাদের প্রতিনিধিত্ব করেন। তখন আমাদেরও আর দিগম্বর হবার বাকি থাকে কি ?

প্রাকৃতিক প্রাণী হিসেবে আমরা লোভ বা মোহের উর্ধ্বে নই মোটেও। কিন্তু এই লোভকে যৌক্তিক পর্যায়ে এনে শালীন উপস্থাপনেই নিশ্চয় সামাজিক মানুষ হিসেবে অন্য প্রাণী থেকে আমাদের পার্থক্য। কেবলমাত্র আরেকটু চাই আরো চাই এই সর্বগ্রাসী লোভ যে শেষ পর্যন্ত কী করুণ পরিণতি ডেকে আনে, এই বোধকে উপজীব্য করে ‘একজন মানুষের কতটুকু জমি দরকার’ শিরোনামের গল্পটি লিউ তলস্তয় সেই কবে লিখেছিলেন। অথচ এখনো এর সমকালীনতার আবেদনে একটুও চিড় পড়েনি। এটা কি জাতি হিসেবে মানুষের লজ্জার খতিয়ান, না কি ব্যক্তি বিশেষের চিরায়ত লোভের সাহিত্য দলিল তা পার্থক্য করার প্রয়োজন আছে মনে হয় না। অর্থ সম্পদ নিয়ে অনর্থের নানান কাহিনী নানাদেশে নানান সময়ে নানাভাবে সৃষ্টি হয়েছে, হচ্ছে এবং আগামীতেও যে হতে থাকবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সকল অনর্থের মূল এই যে অর্থ, আসলেই কি অর্থই অনর্থের মূল ?

অর্থ ছাড়া অর্থবহ কোন কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব, এটা যারা বিশ্বাস করেন তারা হয়তো নির্দিষ্ট ও নগন্য কোন ব্যতিক্রমকে সিদ্ধ করেন। কিন্তু গড়পড়তা এবং সার্বিকভাবে অর্থ ছাড়া কোন কাজ সুষ্ঠুভাবে বা এমনিতেই সম্পন্ন হতে পারে তা কি পাগলেও বিশ্বাস করবে ? না কি চলমান বাস্তবতা সাক্ষ্য দেবে ? কখনোই তা সম্ভব নয়। জীবনের প্রতিমুহূর্তে অর্থসংশ্লিষ্টতা বা অর্থের প্রতি আমাদের অনিবার্য নির্ভরশীলতাকে সভ্যতার স্বাভাবিক উত্থান হিসেবেই ধরে নিতে পারি আমরা। সামাজিক ও পারস্পরিক অভিন্ন বিনিময় মাধ্যম হিসেবে অর্থের এই নিরঙ্কুশ অবদানকে মতিভ্রম না হলে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই। বিনিময়নির্ভর সামাজিক ব্যবস্থায় এই অর্থনির্ভরতা অত্যন্ত স্বাভাবিক ও কাঙ্ক্ষিতও। কিন্তু অর্থনির্ভরতা আর একমাত্র অর্থনির্ভরতা কি এক হলো ? যখন বলা হয় আমাদের জীবনে অর্থনির্ভরতা প্রধান অনুষঙ্গ, তখন জীবনযাত্রার আরো অনেক অনেক নির্ভরতার মধ্যে অর্থনির্ভরতা অন্যতম এবং প্রধান অনুষঙ্গ। এ অনুষঙ্গ না থাকলে এক মুহূর্তও চলে না আমাদের। সাথে অন্যান্য অনুষঙ্গও থাকতে হবে। যা না হলে জীবনটা অর্থহীন হয়ে যায়। তাই আমাদেরকে প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে অর্থ উপার্জন তো অবশ্য করতে হবেই, তবে অন্য অনুষঙ্গগুলোকে বাদ দিয়ে নয়। কিন্তু যখনই একমাত্র অনুষঙ্গ বলা হয়, তখন অন্য অনুষঙ্গগুলো পুরোপুরি অস্বীকার করে কেবলমাত্র অর্থনির্ভরতাকে সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। অর্থাৎ এখানে অর্থটাই সবকিছু, অন্যকিছু কিছুই না। এখানেই অর্থের কাছে আর সব কিছুই অর্থহীন দিগম্বর হয়ে যায় !

তাহলে আমাদের সমাজ সংস্কৃতি সাহিত্য কৃষ্টি ঐহিত্য ইতিহাস মানবিকতা সমাজ সংসার পরিবার ভাবনা দর্শন রাষ্ট্র সংঘ আদর্শ ইত্যাদি সবকিছুই কি অর্থের কাছে অর্থহীন দিগম্বর হয়ে গেলো ? চারদিকে তাকালে কী দেখি আমরা ? অর্থের জন্য শিশুখাদ্যে বিষ মেশানো হয়, দুধের সংকটে অর্থনির্ভর অবৈধ ফায়দা লুটতে তীব্র ক্ষতিকর উপাদানমিশ্রিত ভেজালদুধ তৈরি ও বাজারজাত করা হয়। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজার অস্থিতিশীল করে দ্রব্যমূল্যে অগ্নিঘোড়ার দাবানল ছুটিয়ে দেয়া হয়। বিভিন্ন উদ্যান থেকে জীবনদায়ী সবুজ বৃক্ষ উৎপাটন করে নেয়া হয়, ভূমিদস্যুদের কালো হাতের থাবায় বেঁচে থাকার অনিবার্য উপাদান মুক্তবাতাসের উৎসস্থল খোলাজায়গাগুলো একে একে হারিয়ে যায়। খুনির সপক্ষে চলে যায় বিচারালয়ের অলৌকিক রায়। রাতারাতি ভোলপাল্টে রাজাকার হয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যায় রাজাকার। কসাইয়ের কড়ির কাছে বিক্রি হয়ে যায় বুদ্ধিজীবীর মাথা, আজীবন ভণ্ডামী গুণ্ডামী করা অকস্মাৎ ধার্মিকের ভেকধারী হয়ে যায় জনপ্রতিনিধি, জীবনদাতাকে চড়ানো হয় ফাঁসিতে আর ফাঁসির আসামী ছুটে দাওয়াতের আমন্ত্রণে। রাজনীতির নামে ব্যবসা, ব্যবসার নামে রাজনীতি। পুরস্কারের নামে ধাপ্পাবাজী, মিডিয়ার মামদোবাজী, ধড়িবাজ অমানুষকে ফেরেশতা বানানোর দড়াবাজি, সাহায্যের নামে লুটপাট, ইত্যাদি ইত্যাদি প্রতিটা জায়গায় প্রতিটা মুহূর্তে এই যে এসব দিগম্বরবাজী চলছে, কেবল অর্থলিপ্সু জঘন্য ভানুমতির খেল ছাড়া আর কিছু কি আছে সেখানে ? এইসব রাতকে দিন করা তোঘলকি কর্মকাণ্ডে যারা জড়িত, এরা কেউ অর্থনৈতিকভাবে অভাবগ্রস্ত নয়। এদের অর্থের অভাব নেই। কিন্তু কেবলমাত্র অর্থনির্ভরতার দেউলিয়াত্ব এদেরকে আর মানুষ থাকতে দেয়নি, মানুষ নামের অর্থপিশাচ বানিয়ে ছেড়েছে। এদের কোন মা-বাপ থাকে না, ভাই-বোন বা সন্তান-সন্ততিও থাকে না। এরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না, করতে পারে না। আসলে এদের কিছুই থাকে না, শুধু অর্থ ছাড়া। এদের বিবেক বুদ্ধি থেকে কোন মানবিক ভাবনা ঝরে না, ঝরে কেবল কাগুজে টাকা। একটা সমাজ বা রাষ্ট্রের সংস্কৃতি যখন এই কেবলমাত্র অর্থনির্ভরতার দিগম্বর সংস্কৃতিতে পাল্টে যেতে থাকে, ওটা আর মানুষের ভূখণ্ড থাকে না, পিশাচরাজ্য হয়ে যায়। এই পিশাচরা মানুষের রক্ত চোষে অর্থের খোঁজে। তাদের যে আরো চাই। এই চাওয়ার শেষ নেই। অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি তবে কি ধীরে ধীরে পিশাচরাজ্যে পরিণত হচ্ছে !

পিশাচ নামের কোন বাস্তব প্রাণীর অস্তিত্ব আদৌ আছে কি ? মানুষের আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতার ভয়াবহ অবস্থার প্রতীকী অভিযোজন হিসেবে এই মিথ নির্ভর পিশাচ উপমাটা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। পশ্চিমা লেখক ব্রাম স্টোকারের বিখ্যাত পিশাচ কাহিনী ‘ড্রাকুলা’ বইটি বেরোবার আগে পিশাচ মিথ কতোটা জনপ্রিয় ছিলো আমার জানা নেই। ইদানিং আমাদের দেশে হলিউডের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন হরর মুভির জনপ্রিয়তা দেখলে মনে হয় আমাদের উঠতি প্রজন্মের বিরাট একটা অংশ এই হরর নেশায় যেভাবে বুঁদ হয়ে আছে, তাতে বুঝি এরা মানুষ হওয়ার চেয়ে পিশাচ হওয়াটাকেই আদর্শ হিসেবে ধরে নিচ্ছে। তবু এই অনুমিত ধারণার উপর কোন মন্তব্য করা সাজে না হয়তো। এই পিশাচ মিথ অনুযায়ী যে মানুষের শিরায় একবার পিশাচের দাঁত বসে যায়, সেও ধীরে ধীরে পিশাচে পরিণত হতে থাকে এবং অন্য কোন মানুষের রক্তের নেশায় সেও ছুটতে থাকে। যে মানুষ একবার পিশাচ হয়ে যায় তার আর মানুষে প্রত্যাবর্তন ঘটে না। অর্থাৎ মানুষ পিশাচ হতে পারে, কিন্তু পিশাচ কখনো আর মানুষ হয় না। এটার প্রতীকী অর্থ খুব উল্লেখযোগ্য। কেননা আমরা চার পাশে এটা বিস্তর ল্ক্ষ্য করি যে, যে মানুষটি একটু একটু করে অর্থপিশাচে পরিণত হয়ে গেছে, সে হয়তো অন্য কোন পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়, কিন্তু মানুষের অবস্থানে তাকে আর ফিরতে দেখি না আমরা।

এখন তাহলে উপায় ? এ থেকে কি আমাদের পরিত্রাণ নেই ? যে উন্মত্ত মাদকতায় আমরা আজ ভেসে চলেছি, আমরা যে আসলে কী চাই সেই ভেদবুদ্ধিও বুঝি লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আর লুপ্ত বিবেকের অর্জনে কোন মানবিক বোধ থাকে না নিশ্চয়ই। আমাদের এই বিবেকবোধ লুপ্তির আগে অন্তত একটিবার কি নিজেদের দিকে ফিরে তাকানোর সময় পাবো না ? আয়নায় আপন চেহারার ভাঁজে ভাঁজে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠা বলিরেখাগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে একবারও কি ভাবতে পারি না, আমাদের এতো সব অর্জন উপার্জন আসলে কার জন্যে ? আমাদের ভোগ বা উপভোগের সামর্থ কতটুকু ? মানুষের ব্যক্তি প্রয়োজনের সীমানা বাড়াতে বাড়াতে কতটুকু বাড়াতে পারি আমরা ? অথবা একমাত্র অর্থনির্ভরতা কাটিয়ে আমাদের প্রয়োজনকে কতোটা সৃজনশীল মানবিকতায় বহুমাত্রিক করে তুলতে পারি ? নির্দয় বণিকবৃত্তি আমাদের জীবনটাকে পুরোপুরি গিলে ফেলার আগেই এ প্রশ্নগুলো নিজের কাছে ছুঁড়ে দেয়া জরুরি নয় কি ?

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটাও যে স্বার্থান্ধ বণিকবৃত্তির কাছে পুরোপুরি সমর্পিত হয়ে গেছে এর পেছনেও যে শুধুই অর্থনির্ভরতার দিগম্বর তত্ত্ব দারুণভাবে কার্যকর তাও কি বলার অপেক্ষা রাখে ? শিক্ষা মানেই যে মানবিকতার চর্চা, উন্নয়ন এবং উৎকর্ষতার লক্ষ্যাভিমুখিনতা, তাও বদলে গেছে আজ। বদলে গেছে মানুষ গড়ার চিরায়ত মানবিক দর্শন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে যাচ্ছে কতকগুলো মানুষরূপী যন্ত্রতৈরির প্রতিযোগিতামূলক ট্র্যাক। কার আগে কে বস্তুগত লক্ষ্যকে ছুঁতে পারবে তার ঘোরদৌঁড়ে সবল ও সামর্থ করে তোলার এ সিস্টেমে মানবিকবৃত্তিগুলোর চর্চা আজ এতো চরমভাবে অবহেলিত হয়ে যাচ্ছে যে, আমাদের আগামীও করে খাওয়া নয়, কেড়ে খাওয়ার সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। শুধুই অর্থনির্ভরতার দিগম্বর তত্ত্বে অভ্যস্ত করে তোলার চলমান এই সংস্কৃতির কাছে একে একে অচল ও বাতিল হয়ে যাচ্ছে মানবিক মূল্যবোধ। এর প্রভাব সমাজের আনায়-কানায় খুব ভালোভাবেই প্রতিফলিত হচ্ছে আজ। পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রনৈতিক বন্ধনে এই প্রভাব আর্সেনিক বিষের মতো যে অনিবার্য বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত করে আমাদেরকে এক অস্থির ট্র্যাজিক পরিণতির দিকে ক্রমশই নিমজ্জিত করে ফেলছে, তা সকলেই বুঝি। অথচ কী আশ্চর্য, কেউ তা নিয়ে তেমন ভাবিত হচ্ছি কিনা তাও বুঝা যাচ্ছে না। এটাও যে দিগম্বর তত্ত্বের অনিবার্য প্রভাব, তা কি বুঝতে পারছি আমরা ?

মানুষ তার কৈশোরকে অতিক্রম করে যেতে পারে না কখনোই। কৈশোরিক স্বপ্নের উপাদানগুলোই আসলে মানুষকে সারাজীবন ধাবিত করে। প্রতিটা মানুষের বুকেই একটি করে কিশোর বাস করে। তাই যার কৈশোর যতো সমৃদ্ধ, তারই ততো সমৃদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠার সম্ভাবনা প্রবল থাকে। যন্ত্রময় শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে আসলে আমরা যারা আগামীর যন্ত্রময় মানুষ বানানোর গোটা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ফেলছি, তারা কি একটিবারও নিজের কৈশোরের দিকে ক্ষণিকের জন্যও মুখ ফেরাতে পারি না ? হয়তো অনেক অনাহুত জটিলতারও অবসান হয়ে যেতে পারে এতে। এই অস্থিরতার ঘোর লাগা চোখে সেই কৈশোরে ডুব দিলে ভেসে উঠে সেই সব প্রবীন শিক্ষকদের কষ্টময় মুখগুলো। তখন তো আর মুখে মাখা কষ্টগুলো বুঝি নি। এখন স্মৃতির ডায়েরীর পাতা উল্টালেই সে সব মুখে যে কষ্টের জলছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠে, সে কি শুধুই তাঁদের নিজেদের যাপিত কষ্টেরই ছাপ ? আর কিছু কি নেই ? পাখির ছানার মতো আমাদের কচি কচি মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে হয়তো কোন ভয়াবহ আগামীর অশনি সংকেতে কেঁপে উঠেছিলেন তাঁরা। আর সেজন্যই হয়তো মানবিক বোধগুলোকে জীইয়ে রাখার সর্বাত্মক প্রয়াসও নিতে কার্পণ্য করেন নি, যা হয়তো একদিন সব অমঙ্গল প্রতিরোধক হয়ে মানুষের মানবিক অর্জনকে রক্ষা করবে সে আশায়। আহা, তাঁদের সীমিত সামর্থ দিয়ে পাঠের পাশাপাশি যে মানবিক বোধগুলোকে উস্কে দিতেন গল্পে গল্পে, সেগুলোই যে আসল পাঠ ছিলো, স্মৃতি আক্রান্ত হয়ে আজ মর্মে মর্মে তা অনুধাবন করি। মানুষের লক্ষ্য কী ? তার অর্জনের উদ্দেশ্যই বা কী ? কিংবা তার চাওয়ার সীমান্ত কতোটা বিস্তৃত ? এইসব জটিল তত্ত্ব না বুঝলেও কেবল গল্পের ছলে যে মানবিক দর্শনগুলোকে ছোট ছোট কিশোরমনে গেথে দেয়া হয়েছিলো একদিন, তাই যেন বিশাল মহীরুহ হয়ে কী নিবিড় ছায়া দিয়ে আগলে রাখতে চাইছে ! সে কি শুধুই গল্প ছিলো ? সেই সব গল্পের হয়তো দেশ কাল নেই, চিরায়ত। বাস্তবতা নেই, তবু গভীর সত্য। সে রকম একটা গল্পই আজও কত বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে চিরায়ত মানবিক বোধকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে !

এক ধনকুবের ব্যক্তি অর্থ উপার্জন করতে করতে অর্থের মোহে এতোটাই ডুবে গিয়েছিলেন যে, অর্থের বাইরে আর কোন চিন্তাই তাকে সামান্যতম নাড়া দিতো না। তার পরিবার পরিজন কেবল নামেই ছিলো। কিন্তু তার প্রতিদিনের রুটিন ছিলো, ঘুম থেকে উঠেই সারাজীবনের অর্জিত অর্থগুলোকে নিয়েই মেতে থাকা, একটু নেড়েচেড়ে দেখা আর এগুলোর নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ করা। প্রাণের চাইতেও প্রিয় তার অর্থসম্পদগুলোকে সবার অগোচরে নিরাপদে রাখার জন্য বাড়িতে ভূগর্ভস্থ যে মশা-মাছিরও অগম্য অত্যাধুনিক কোঠুরিটি বানিয়েছিলেন, তার চাবি একমাত্র তার কাছেই থাকে। এর খবর আর কাউকেও দেন নি তিনি। রোজকার রুটিন অনুযায়ী সেদিনও ঘুম থেকে উঠেই প্রথমেই চললেন তাঁর অর্থের পাহাড়ের দিকে। আগজীবনে প্রচুর অর্থকষ্টে বড় হওয়া এই ধনকুবের ব্যক্তি অর্থের প্রয়োজন ও গুরুত্ব খুব ভালো করেই চিনে গেছেন। আন্ডারগ্রাউন্ড ভোল্টরুমের গোপন দরজা খুলে একটার পর একটা সুরক্ষিত দরজা পেরিয়ে সর্বশেষটা খুলেই ভেতরের সম্পদের পাহাড়ের বিশালতা আর দর্শনজনিত মাদকতায় যথারীতি আবেগমথিত তিনি কী ভীষণ তৃপ্তি আর অতৃপ্তি নিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন, তখন আর কিছুই মনে থাকে না তার। সবকিছু ভুলে বেশ কিছুক্ষণ এখানেই পড়ে থাকেন। হাত বুলিয়ে বুলিয়ে নাকে মুখে বুকে ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে নেশাগ্রস্তের মতো এগুলোর স্পর্শ উপভোগ করেন তিনি। তারপর মনোবিকলন স্তিমিত হয়ে এলে একটা অব্যাখ্যাত তৃপ্তি নিয়ে ফিরে চলেন। কিন্তু বন্ধ দরজায় এসেই হঠাৎ আবিষ্কার করলেন তার সাথে চাবিটা নেই ! আতিপাতি খুঁজেও এতোদিনকার অভ্যস্ত চাবি পেলেন না। পাবেন কী করে ! আবেগের তীব্রতায় ঢুকার প্রাক্কালেই যে চাবিটা দরজার বাইরের কীহোলে যে অজান্তেই আটকে রেখে এসেছেন সেটাই তো তার মনে নেই। তার নিজের গড়া সুরক্ষিত এই দুর্গ থেকে যে চাবি ছাড়া রেরুনোরও কোন উপায় তিনি রাখেন নি। তার প্রাণপ্রিয় অর্থসম্পদের পাহাড়ে অজান্তে এবার তিনি নিজেই তার ভাগ্যের বন্দী হয়ে গেলেন। খাবার নেই, পানি নেই বা অন্য কোন অনুষঙ্গও নেই। আছে কেবল সীমাহীন অর্থ আর অর্থ ! এই অর্থ সবকিছুরই নিশ্চয়তা দেয় ঠিকই। অর্থের ক্ষমতাও অসীম। কিন্তু সেই অর্থের নিজের তো কোন ক্ষমতা নেই। তার ক্ষমতা তো শুধু বিনিময় মাধ্যম হিসেবেই। এটাই যে অর্থের সবচেয়ে বড় অক্ষমতা, তা তো এই মোহগ্রস্ত ধনকুবের ভুলেই গিয়েছিলেন। জীবনের চরম সন্ধিক্ষণে এসে হয়তো বুঝতে পারলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর ফেরার রাস্তা যে বন্ধ সব !

কদিন পর যখন তাকে আবিষ্কার করা হলো, দেখা গেলো নিজের গড়া অর্থের পাহাড়ের মধ্যে তার লাশ অসহায় পড়ে আছে। মৃত্যুর আগে প্রতিটা মানুষই হয়তো একেকজন মানবিক দার্শনিক হয়ে যায়। তিনিও তার সর্বশেষ একটি কাজ দিয়ে অনাগত ভবিষ্যতের জন্য সে প্রমাণই হয়তো রেখে গিয়েছিলেন। দাঁত দিয়ে আঙুল ছিঁড়ে রক্তের অক্ষরে ধবধবে টাকার গায়ে তাঁর শেষ মনোদর্শনটাই হয়তো জীবনের বিনিময়ে লিখে গিয়েছিলেন, যা তিনি এর আগে কখনোই বুঝার সময় করে উঠতে পারেন নি। ‘আহা ! যার কাছে অর্থ নেই, তার অবস্থা শোচনীয়। কিন্তু যার কাছে অর্থ ছাড়া আর কিছুই নেই, তার অবস্থা আরো শোচনীয়...।’

(১৪/১১/২০০৮)