Saturday, February 28, 2009

# এটা কি বিডিআর বিদ্রোহ, না কি কোন জঙ্গি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন...!


এটা কি বিডিআর বিদ্রোহ, না কি কোন জঙ্গি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন...!
রণদীপম বসু

২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ বাংলাদেশ রাইফেলস তথা বাংলাদেশের ইতিহাসের যে ভয়াবহতম নৃশংস ঘটনা ঘটে গেলো তাকে একেবারে প্রাথমিকভাবে বিডিআর জওয়ানদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বিদ্রোহ হিসেবে তাৎক্ষণিকভাবে আখ্যায়িত করা হলেও ধীরে ধীরে ভেতরের লোমহর্ষক ঘটনাগুলো মিডিয়ার মাধ্যমে একে একে উন্মোচিত হতে থাকলে তা যে আদৌ কোনো বিদ্রোহ ছিলো কিনা সে হিসাবটাই এখন গরবর হতে শুরু করেছে। অন্তত এটা বুঝা গেলো যে বিডিআর-এর মধ্যে মিশে থাকা তৃতীয় কোন গোষ্ঠী এই ঘটনাধারাকে জনসাধারণের মধ্যে অত্যন্ত সফলভাবে ভিন্নখাতে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল বলেই মনে হয়। ইতোমধ্যে ঘটনার যেটুকু আমরা জানতে পারছি তাতেই এর ভয়বহতায় আৎকে উঠছি ! এরই মধ্যে জিম্মি অবস্থা থেকে মুক্ত অনেকের ভাষ্যও মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারছি আমরা। যদিও সবটুকু শোনার সুযোগ আমাদের নেই বা এগুলোর সত্যাসত্য যাচাইয়ের কোন উপায় আমাদের নেই। তবু শুরু থেকে সাধারণ নাগরিকদের কাছে প্রকাশিত ঘটনাচিত্র, জওয়ানদের বিভিন্ন সময়ে উৎক্ষিপ্ত উক্তি, দাবী-দাওয়া এমনকি সামগ্রিক বডিল্যাংগুয়েজের সাথে ঘটনাপরবর্তী আংশিক উন্মোচিত বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে সামগ্রিক পরিস্থিতির গভীরে ভয়ঙ্কর একটা পূর্ব-পরিকল্পনার চিহ্ণগুলো ক্রমেই যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সংগত কারণেই মনের মধ্যে এই প্রশ্নটাই গুমড়ে গুমড়ে উঠছে- এটা কি সত্যিই বিডিআর জওয়ানদের তাৎক্ষণিক বিদ্রোহ ছিলো, না কি গভীর কোন জঙ্গি পরিকল্পনার বাস্তবায়িত অংশ ?

ঘটনার সূত্রপাত থেকে যাঁরা বিষয়টির প্রতি গভীর মনোযোগ সহকারে নজর রাখছিলেন তাঁদের কাছে হয়তো এর কোন সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকতে পারে। তবে টিভি মনিটরে ভাসমান ঘটনার উল্লেখযোগ্য ছবিচিত্র দেখে অনেকগুলো হিসাব জট পাকিয়ে যাচ্ছে। যুক্তির প্রশ্নে বেশ কিছু ঘটনা ইতোমধ্যে রহস্যময় ঠেকছে যাতে মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে এটা বিডিআর-এর আভ্যন্তরীণ বিষয়ের বাইরে সুদূরপ্রসারী কোন ষড়যন্ত্রের অংশ। এরকম অংকে না মেলা কিছু প্রশ্ন আমরা হয়তো রিভিউ করে দেখতে পারি।

১.০ ফেব্রুয়ারি ২৪ বিডিআর সপ্তাহ উদ্বোধনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে সম্ভাব্য পূর্ণ বিপজ্জনক একটা পরিস্থিতির মধ্যে অবস্থান করছিলেন তা হয়তো আমরা এখন বুঝতে পারছি। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও কি আমাদের মতোই এখন এসে তা বুঝতে পারছেন ? গোয়েন্দারা কি সত্যিই কোন আলামত আগে থেকে টের পান নি ? এটা কি আমরা বিশ্বাস করবো ?

২.০ পিলখানার বিডিআর সদর দপ্তরের দরবার হলের অনুষ্ঠানে গোটা দেশ থেকে সবগুলো সেক্টর, ব্যাটেলিয়ান ক্যাম্পের উর্দ্ধতন অফিসার এবং অনেক জওয়ান অংশগ্রহণ করে থাকে, এটা হয়তো সবাই জানে। কিন্তু সবাই কি সবাইকে চেনে ? পিলখানার ব্যারাকে প্রবেশ এবং অবস্থানকালীন তাদের পরিচয়গুলো কিভাবে মিমাংশিত হয়ে থাকে ? একজন জঙ্গি বাইরে থেকে বিডিআর পোশাক কিনে (শুনেছি বাইরে নাকি আর্মি ও বিডিআর-এর পোশাক কিনতে পাওয়া যায়) নিকটতম সমমনা কোন হাবিলদার বা এ ধরনের কারো সহায়তায় অবস্থান করা কি সম্ভব নয় ?

৩.০ দরবার হলে কেউ অস্ত্র নিয়ে যেতে পারে না বা যাওয়ার রেওয়াজ নেই বলে শোনা যায়। তাহলে পিলখানার গেটের ভেতর থেকে জওয়ানরা মিডিয়াকে উচ্চস্বরে যে বক্তব্য রেখেছিল- ডিজি প্রথমে গুলি করে জওয়ানদের উপর, তারপরই জওয়ানরা বিদ্রোহ করে; কথাটা মিথ্যা এবং পরিকল্পিত। কেন এই পরিকল্পিত মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিল তারা ? একইভাবে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধেও জনমনে একটা আতঙ্কজনক ধারণা তৈরির চেষ্টা করেছিল। কেন ? এমনকি প্রধানমন্ত্রির সাথে বিডিআর সদস্য প্রতিনিধিরা মিথ্যে তথ্য প্রদান করে সাধারণ ক্ষমার আশ্বাস নিয়েছিল। বিদ্রোহীরা কি এরকম ক্ষেত্রে কখনো মিথ্যে তথ্য বলে, যা নাকি যৌক্তিক সময় পরেই ফাঁস হয়ে যাবে ?

৪.০ একজন ডিজির বিরুদ্ধে কথিত দুর্নীতি বা দুর্ব্যবহারকে উপলক্ষ্য করে বিপুল সংখ্যক চৌকস নিরস্ত্র সেনা কর্মকর্তাকে, যাঁরা জঙ্গি বিরোধী ভূমিকায় প্রশংসনীয় সাহসী অবদান রেখেছিলেন, তাঁদেরকে ব্রাশ ফায়ারে গণহত্যা করা তাৎক্ষণিক বিদ্রোহ হিসেবে কতোটা অনুমোদনযোগ্য ? আসলে কি এটা বিদ্রোহ, না কি কোন ব্যাপক ষড়যন্ত্রের অংশ ?

৫.০ ঘটনা ঘটার পরপরই অনেক জওয়ানদের মুখমণ্ডলে লাল কাপড় বাঁধা থাকতে দেখা গেলো। কোন্ আশ্চর্য প্রদীপের ছোঁয়ায় এগুলো হঠাৎ করে সবার কাছে বেরিয়ে এলো ? আধা সামরিক বাহিনী হিসেবে মুখে কাপড় বাঁধার জঙ্গি স্টাইল না হয় বাদই রাখলাম, কাপড়গুলো কখন সংগৃহিত হলো ?

৬.০ যতটুকু জানা যায়, অস্ত্রাগারের চাবি নাকি কোন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছেই রক্ষিত থাকে এবং এমুনিশান বা গোলাবারুদের মজুতখানাও নাকি অস্ত্রাগার থেকে বেশ দূরে। আগে থেকে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহে না থাকলে দরবার হলে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো এতো দ্রুততার সাথে আদৌ কি ঘটানো সম্ভব ?

৭.০ বেঁচে ফিরে আসা প্রত্যক্ষদর্শী কোন কোন অফিসারের ভাষ্যে জানা গেল যে অনেকগুলো সশস্ত্র ঘাতক জওয়ানদেরকে অপরিচিত মনে হয়েছে। একজন সেনা কর্মকর্তার চোখে অপরিচিত কথা বৈশিষ্ঠ্যমূলক বৈ কি ! তবে কি বাইরের কোন গ্রুপ সংশ্লিষ্ট ছিলো ?

৮.০ যে লোমহর্ষক অবস্থায় বহু সেনাকর্মকর্তার মৃতদেহ ম্যানহোল, স্যুয়ারেজ বা স্বল্প সময়ে খোড়া গণকবর থেকে উদ্ধার হচ্ছে, এই সংস্কৃতিতে বিডিআর জওয়ানরা কি পূর্ব অভিজ্ঞ বা অভ্যস্ত ? যদি না হয়ে থাকে এই অভ্যস্ত সংস্কৃতির ঘাতক গ্রুপের পরিচয় কী ?

৯.০ পিলখানার বিভিন্ন জায়গা থেকে যে পরিমাণ লুকানো গোলাবারুদ, গ্রেনেড বা ধ্বংসাত্মক এমুনিশান উদ্ধার হচ্ছে সেগুলো কি বিডিআর মজুদখানার সরবরাহ ? জওয়ানরা আত্মসমর্পণ যদি করবেই তাহলে এসব আবার লুকিয়ে ফেলার কারণ কী ? নাকি ওগুলো আসলেই লুকানো ভাণ্ডার, যা আগে থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছিলো ?

১০.০ ডিজি’র বাসা এবং অফিসার কলোনি বা মেসগুলো ব্যাপক লুটপাট ও পুড়িয়ে সম্পূর্ণ ভস্ম করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থান থেকে সাধারণ পোশাকে ধৃত জওয়ানদের কাছ থেকে লুটপাটকৃত স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধারও করা হয়েছে কিছু কিছু। সাধারণ জওয়ানের মনস্তত্ত্বে কর্মএলাকায় এসব লুটপাট কতটুকু সাযুজ্যপূর্ণ ? এরা কি সত্যিই বিডিআর জওয়ান ছিল ?

১১.০ শোনা যাচ্ছে প্রথম রাতেই অনেক বিদ্রোহী জওয়ান ব্যারাক ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এজন্যই কি পিলখানার আশেপাশে বা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সেনা অবস্থানের তীব্র বিরোধিতার শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীকে ? এরা কি সত্যি কোন বিদ্রোহী জওয়ান, না কি বাইরের কোন গ্রুপ ? নিরাপদে পালানোর সুযোগ চাচ্ছিল ?

১২.০ শুধু দরবার হলেই নয়, কলোনিগুলোতে তল্লাশি চালিয়ে কর্মকর্তাদের হত্য করা হচ্ছিল। এমনকি যেসব জওয়ান এর বিরোধিতা করেছে তাদেরকেও সাথে সাথে হত্যা করা হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে যে নারকীয় কায়দায় ছারখার করে দেয়া হচ্ছিল, মুহূর্তের মধ্যে সহকর্মী সহযোদ্ধা জওয়ানদের এরকম পাল্টে যাওয়া ঘাতকমূর্তি ধারণ করা কি আদৌ সম্ভব ? এই ঘাতকেরা কি বিডিআর সদস্যই ছিল ?

১৩.০ আগের দিনের সদর দপ্তরের কথিত বিদ্রোহ পরের দিন দেশের অন্যান্য বিডিয়ার সেক্টর ব্যাটেলিয়ন ক্যাম্পগুলোতে নাড়া দেয়া শুরু করলো। এই সময় ফ্যাক্টরে কোন রহস্য লুকিয়ে আছে কি ?

সময়ের সাথে সাথে এরকম আরো বহু প্রশ্ন হয়তো দেখা দেবে। এসবের উত্তর আমাদের সাধারণের জানা নেই। তবে যেসব নৃশংস আলামত একে একে পাওয়া যাচ্ছে, কোন ঘৃণ্য জঙ্গি গ্রুপ ছাড়া একটা সুশৃঙ্খল বাহিনীর সাধারণ জওয়ানদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশকে কোন্ মনস্তত্ত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করা হবে ? এগুলোর মধ্যে যে সুদূরপ্রসারী গভীর ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনার স্পষ্ট লক্ষণ আমাদের সাধারণের নজরে এসে যায় কেবল দেখে বা শুনে, বাস্তবে তা যে আরো অনেক বেশি ভয়ঙ্কর চেহারায় রয়েছে তা কেবল আঁচ করতে পারি আমরা। আর কেঁপে কেঁপে ওঠি। কতদিন থেকে কী পরিমাণ অর্থায়নে কিভাবে এসব জঘন্যতম পরিকল্পনা হচ্ছিল, কে বা কারা এর পেছনে সক্রিয় ছিল বা আছে, সেই কালো হাতগুলোকে চিহ্ণিত করা কি সরকারযন্ত্রের জন্য খুব বেশি কষ্টকর বিষয় ?

থেকে থেকে মা বোন শিশুদের কান্নার রোল আর কতো বেশি গগনবিদারী হলে রাষ্ট্র এই অপশক্তিগুলোকে খুঁজে খুঁজে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে ? এরকম আর কতো ভয়াবহ ট্র্যাজেডি এই দুর্ভাগা জাতিকে এমন অসহায়ভাবে দেখে যেতে হবে ?

অবশেষে যে কথাটা না বললেই নয়, আমাদের সেনাবাহিনী এবার যে সহনশীলতা আর জাতির প্রতি নিরঙ্কুশ বিশ্বস্ততার পরিচয় দিলেন, এতে তাঁদের ক্ষয়ে যাওয়া ভাবমূর্তি অবশ্যই জনমনে ভীষণ ইতিবাচক ভুমিকা রাখবে নিশ্চয়ই। এক বেদনাময় রক্তগাথা বুকে চেপে তাঁদের এ বিশ্বস্ততাকে আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে সাধুবাদ জানাই। তাঁরা যে আমাদেরই ভাই। আর বিদ্রোহের নামে এমন নারকীয় পৈশাচিকতা কোন দেশপ্রেমিক বাহিনীর সদস্যের দ্বারা সংঘটিত হওয়া আদৌ কি সম্ভব ? পেছনের সেই কুৎসিৎ ছায়ামুখগুলোর মুখোশ উন্মোচন করাটা খুবই জরুরি এখন, রাষ্ট্রের নিরাপদ আগামীর জন্যই।
‌(২৭/০২/২০০৯)

[sachalayatan]
[khabor.com]
[mukto-mona]
[sa7rong]

Friday, February 27, 2009

# অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০০৯ এবং ক্ষীণদৃষ্টি পণ্ডিতজনের চশমাগুলো...



অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০০৯ এবং ক্ষীণদৃষ্টি পণ্ডিতজনের চশমাগুলো...
রণদীপম বসু

বাংলাদেশে গোটা বছর যে পরিমাণ গ্রন্থ প্রকাশিত হয় তার সিংহভাগ হয়ে থাকে ফেব্রুয়ারিতে। কেন হয় তা সবাই মোটামুটি অবগত। এরই মধ্যে ফেব্রুয়ারি শেষ হয়ে এলো। বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে চলমান এবারের একুশে বইমেলায় যাঁরা ইতোমধ্যেই এক বা একাধিকবার ঘুরে এসেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই একাডেমীর অন্যতম কৌতুহলী জায়গাটাকেও চিনতে ভুল করেন নি। ‘নজরুল মঞ্চ’।

লেখক প্রকাশক পাঠক ও আগ্রহী মানুষের ভীড়ে এই মঞ্চটা এবার প্রতিদিনই সরগরম থেকেছে শতশত বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের সরবতায়। চেনা-অচেনা খ্যাত-অখ্যাত তারকা-অতারকা কতো রকম মানুষের আনাগোনায় আন্দোলিত হয়েছে এবং হচ্ছে এই মঞ্চটা। বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ এ জন্যেই এ জায়গাটাকে নির্ধারিত করে দিয়েছেন। আর এই নির্ধারণসূত্র অনুযায়ী তাঁরা বিলবোর্ডের মতো বিশাল পর্দাও টাঙ্গিয়ে রেখেছেন মোড়ক উন্মোচনের জায়গা হিসেবে। সবাই হয়তো খেয়াল করেছেন জাতিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আবক্ষ ভাস্কর্য মূর্তিটির দুপাশে দুটো বড় পর্দায় বিরাট অক্ষরে লেখাগুলো- ‘..নতুন বইয়ের মোড়ক উম্মোচন’ ! লেখাটা পড়ে কি কোন সন্দেহ দেখা দিচ্ছে ?

আমি হয়তোবা একজন সাধারণ পাঠক। আমার মতো সাধারণের বাইরে অন্য যেকোন জায়গার তুলনায় আমি নিশ্চিত যে এই বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণেই দেশের জ্ঞানী গুণী বিজ্ঞ অভিজ্ঞ প্রাজ্ঞ পণ্ডিতজনদের আগমন সবচাইতে বেশি মাত্রায় ঘটেছে। কিন্তু যা ঘটেনি তা হয়তো আমাদের অহঙ্কারমুখ ক্ষীণদৃষ্টি পণ্ডিতজনের চশমাগুলো সাথে নেয়া...। নইলে গোটা একটা মাসেও কারো চোখে পড়লো না এমন মারাত্মক একটা ঘটনা, যা নাকি প্রতিদিনই ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে মুহূর্তেই তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েও যাচ্ছে সচিত্র সরবতা নিয়ে !

বাংলা একাডেমীর ইতিহাস আমাদের গর্বের ইতিহাস। এর ঐতিহ্য আমাদের অহঙ্কার। স্বেচ্ছাচারিতা রোধকল্পে বাংলা বানানের ক্ষেত্রে ঐক্য সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের একটি নিয়ম প্রণয়ন করে। পরবর্তীতে বাংলা একাডেমীর অভিধানসমূহ ঐ বানান রীতিই অনুসরণ করে। প্রথম প্রথম এ নিয়ে যথেষ্ট মতপার্থক্য দেখা গেলেও পর্যায়ক্রমে তা মিইয়ে আসে এবং বাংলা ভাষা ব্যবহার ও চর্চা করেন যাঁরা, বাংলা একাডেমীই যেহেতু রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারক হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত প্রতিষ্ঠান, তাই সবাই এই নিয়মকেই যথাযথ মান্য করায় ব্রতী হন। বাংলা ভাষায় একটি আদর্শ অভিধান প্রণয়নই ছিলো জন্মলগ্ন থেকে বাংলা একাডেমীর প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প।

আনুপূর্বিক ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে, বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠার পরপরই “পূর্ব পাকিস্তানী ভাষার আদর্শ অভিধান” নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, যে প্রকল্পের অধীনে আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, ব্যবহারিক বাংলা অভিধান ও বাংলা সাহিত্যকোষ নামে তিন খণ্ড অভিধান প্রণয়নের পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল। ঐ পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ নামক প্রথম খণ্ডের কাজ শুরু হয় ১৯৫৮ সালে এবং ১৯৬৪ সালে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সম্পাদনায় তা প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে ব্যবহারিক অভিধান নামক দ্বিতীয় খণ্ডের কাজ ১৯৬১ সালে শুরু হলেও এর স্বরবর্ণ অংশ ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের সম্পাদনায় ১৯৭৪ সালে এবং অধ্যাপক শিবপ্রসন্ন লাহিড়ীর সম্পাদনায় ব্যঞ্জনবর্ণ অংশ ১৯৮৪ সালে প্রকাশ পায়। প্রথম প্রকাশের সময় এর নাম ছিল ‘বাংলাদেশের ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’। ১৯৯২ সালে ‘দ্বিতীয় সংস্করণ’ নামে পুনর্মুদ্রন করার সময়ে অভিধানটির নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ রাখা হয়। পরবর্তিতে একই নামে এরই পরিমার্জিত সংস্করণটি প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে।

এই পরিমার্জিত সংস্করণের ভূমিকাতে সংক্ষেপে বিধৃত বাংলা একাডেমীর এই অভিধান প্রকল্পের ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে, সৈয়দ আলী আহসান, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, মুনীর চৌধুরী, অজিত কুমার গুহ, আহমদ শরীফ, মুহম্মদ আবদুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ আবদুল কাইউম, তারাপদ ভট্টাচার্য, গোলাম সামদানী কোরায়শী, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত প্রমুখের মতো তখন ও এখনকার বাংলা ভাষার প্রায় সব প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ ও পণ্ডিতজন প্রকল্পটির সাথে শুরু থেকেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং এখনও আছেন। কালে কালে প্রকল্পটি এতোই আকর্ষণীয় ও সর্বজনস্বীকৃত হয়ে উঠে যে, এখনও বাংলা ভাষা-ভাষিদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু থেকে এই অভিধান বিষয়ক কৌতুহল একবিন্দুও কমে নি বলেই ধারণা। আর তাই একুশে বইমেলায় বাংলা একাডেমীর নিজস্ব স্থায়ী বিক্রয়কেন্দ্রটির প্রতি সবশ্রেণীর পাঠক-ক্রেতার একটা বিশেষ আগ্রহ সবসময়ই লক্ষ্য করা যায়। প্রতি মেলাতেই ওখানে হুমড়ি খাওয়া ভীড়ের উপস্থিতিকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি এবং বিষয়ভিত্তিক গবেষণামূলক প্রকল্প হিসেবে বিভিন্ন প্রকাশনাগুলো পাঠকের হাতে সাশ্রয়ী মূল্যে তুলে দেয়ার বিষয়টাকে (৩০% এবং ৫০% মূল্যহ্রাসের আকর্ষণীয় সুবিধা পাওয়া) কেউ কেউ প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্ণিত করতে পারেন হয়তো। তবে প্রতি মেলাতেই দ্রুত অভিধান স্টক ফুরিয়ে যাওয়ার বিষয়টাও উল্লেখযোগ্য নয় কি ?

এবারের মেলাতেও, যাকে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০০৯’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে, পাঠক ক্রেতাদের বিপুল আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে বাংলা একাডেমীর বানান অভিধানটির দিকে। এ অভিধানটিও উল্টেপাল্টে দেখার চেষ্টা করলাম, ‘উম্মোচন’ নামের কোন বাংলা শব্দ আমাদের কোন শব্দ-পরিভাষায় রয়েছে কিনা। অথবা বাংলা একাডেমীর স্বসৃষ্ট শব্দ কিনা। কিন্তু কোথাও তা পেলাম না কেবল ওই নজরুল মঞ্চে টাঙ্গানো বোর্ডটি ছাড়া। একাডেমী কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোন ব্যাখ্যা বা বিবৃতি দিয়েছেন বলেও জানা নেই। মায়ের ভাষা রক্ষায় অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেয়া ভাষা শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ যখন অন্যকে প্রমিত বানান ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার গুরুদায়িত্ব নিয়েছেন, তাঁদেরকে শুদ্ধ বানান ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার দায়িত্ব কারা নেবেন তা জানার অধিকার কি আমাদের আছে ? নিজেদের আঙ্গিনায় নিজেদের দায়িত্বে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এমন সংবেদনশীল একটা স্থানে এরকম দায়িত্বহীন ভুলকে সারাবিশ্বে প্রতিফলিত করে জাতির জন্য যে লজ্জার আরেকটি উপাদান তাঁরা যুক্ত করলেন এর দায়-দায়িত্ব কি কারোরই নেই ? কেউ কি একবারও অবহিত করলো না তাঁদেরকে ! অথবা কোন্ অজ্ঞাত কারণে এটাকে অবজ্ঞা করা হলো এর জবাবদিহি করার কেউ কি এখন আর বর্তমান নেই ?

অন্য কোথাও থাকে কিনা জানা নেই, তবে ভুত যে আসলে সর্ষেতেই থাকে তা বোধ করি অসত্য নয় !
[আরো ছবি এখানে এবং এইখানে]

[sachalayatan]

Wednesday, February 18, 2009

# টান নেই আঁচড় নেই শুধুই বিষাদ - ০২ (কবিতাগুচ্ছ)


টান নেই আঁচড় নেই শুধুই বিষাদ - ০২ (কবিতাগুচ্ছ)
-রণদীপম বসু


প্রতিদিন তোমাকে

যখন নিশ্ছিদ্র আচ্ছন্নে থাকি
অসংখ্য পঙক্তিতে শুধু তোমাকেই আওড়াই
অবিরাম...
কখনো সরব হলে, নিশ্চিন্ত হই-
ওখানে কবিতা নেই, তুমিই কেবল...

তোমার আলিঙ্গন ছাড়া কী করে অক্ষরেরা শব্দ হবে !
তোমার চুম্বন ছাড়া শব্দের সাধ্য কী পঙক্তি হবার !
তোমার বিরহ পেলেই অপাঙক্তেয় পঙক্তিরা সব
একেকটা কবিতা হয়ে
ঝাঁপ দেয় আদিগন্ত শূন্যতার ডানায়...

এবং ঝরতে ঝরতে পড়তে পড়তে
যখন খাবলে ধরি ক্রমশই অপসৃত তোমার অঢেল বুক
কী আশ্চর্য, কারা যেন কবিতা কবিতা বলে হর্ষধ্বনি করে !
ওরা কি জানে কবিতা আর মাংসের তফাৎ ?

কোথাও নিবিষ্ট নই তোমাকে ছাড়া, অথচ
অন্ধি-সন্ধি-মাংসের আড়ালে অশ্রান্ত খুঁজে খুঁজে
প্রতিদিন তোমাকে তোমার তোমাকে হারাই...
(১৭/০২/২০০৯)


শহীদ মিনার

যে আমি দু’কদম হাঁটলেই ভীষণ ক্লান্ত হয়ে যেতাম,
অথচ প্রভাতফেরির উন্মুখ সচল ভীড়ে হাঁটতে হাঁটতে...
এক বিস্ময়কর উত্তেজনায়
একটুও কষ্ট হতো না আমার।
দু’পাশ আগলে রেখে বাবা আর মা,
মনে হতো
মাঠ-ঘাট-নদী-বন বিস্তীর্ণ ধানের ক্ষেত পেরিয়ে
অনায়াসে যেতে পারি হেঁটে- কুয়াশা-সুদূর ওই-
আকাশের নেমে আসা প্রান্ত-সীমায়।

দু’হাতে মুঠোয় ধরা স্মিত-রঙ ফুলের স্তবক-
গুটি-গুটি-পায়ে হেঁটে যাই ছোট্ট আমি,
পাশে বাবা আর মা ;
একরাশ ইচ্ছের মতো পীচ-কালো পথটাও
মিশে গেছে-
শহীদ- মিনারের বিশাল বিস্তৃত আঙিনায়।
আমার প্রভাতী চোখে- রাজ্যের কৌতূহল ;
সম্মিলিত কোলাহল ছাপিয়ে
সবুজ দৃষ্টির পাতা
ফিরে আসে বারে বারে-
মিনারের নোয়ানো চূড়ায় ছুঁয়ে
পুনরায় মায়ের উজ্জ্বল মুখে।
এক অদ্ভুত অচেনা মায়ায় তাঁর দীঘল আনত মুখ
আমাকে বুলিয়ে যেতো বারবার।
মিনারের চূড়া, ফের মায়ের মুখের আকাশ-
দেখতে দেখতে
কখন যে এক মুঠো স্নিগ্ধ ভেজা ঘাস হয়ে যেতাম!

এখন সে মা আমার স্মৃতির উঠোন।
দু’কদম হাঁটলেই আজো ক্লান্ত হই আমি।
এখনো শহীদ মিনারে এলে কখন-অজান্তে যেন
চোখ দুটো ঘুরে-ফিরে ছুটে যায় মিনারের
সেই সে নোয়ানো চূঁড়ায়;
যেখানে মায়ের গভীর মুখ-
আনত উঠোন হয়ে আমাকেই ডাকে,
ডেকে যায়...।
(০৪/১২/২০০৭)
[sachalayatan]



খুনে তিল’টাই জানে

প্রহরায় জেগে রাখা তোমার ওই খুনে তিল’টাকেই জিজ্ঞেস করো
সে কি জানে- এটা যে তুমি নও, তোমার উঠোন শুধু ?
লাল জলে ফোটে থাকা কৃষ্ণ বাতিঘর !

যুদ্ধের মন্ত্র ভুলে নির্বোধ আহুতি দেয়া ইচ্ছের কবন্ধগুলো
নিরস্ত্র দেখে
ভেবো না শিখেনি ওরা সশস্ত্র হতে;
ওরাও খুঁজতে জানে অহিংস সবকে বোনা স্বর্ণচাপা সুখ, নারীর প্রাসাদ
কিংবা নিমেষেই হানা দিতে লুটেপুটে হালাকু চেঙ্গিস

তুমি আর টোল পড়া তিলের সৌরভ ছুঁয়ে
একেবেঁকে যে নদীটা নিশ্চিৎ হারিয়ে যাবে নাভির চরায়
জলল অক্ষর দিয়ে ওখানে একটি নাম লিখে দিতে বহুকাল ভেসেছি আমি।
অতঃপর কখন যে ডুবেই গেলাম !

খুনে ওই তিল’টাই জানে- ওটা কি ঝড়ই ছিলো,
না কি সময়ের ফুটো বেয়ে
আদিগন্ত গিলে ফেলা নহলী সাম্পান ?
(০৫/০৫/২০০৯)
[sachalayatan]



আলতো করে ছুঁয়ে থাকে

আমাকে উন্মুক্ত করে
তোমার অবাধ্য তর্জনীটা আলতো করে ছুঁয়ে থাকে
বুকের নিপুলে আমার ! অথচ কী নির্বিকার তুমি
আমার চোখে রাখো চোখ, আর
আশ্চর্য মগ্নতায় চেয়ে থাকো অন্য কারো স্পর্শাতীত চোখে-
মুখের মানচিত্রে কিংবা ভুল আর শুদ্ধতায় মাখা
এক বুক নির্মাণ জলে !

অবাধ্য তর্জনী তোমার
আমি ঠিক টের পাই শির শির স্পর্শের ঘ্রাণ
এদিক ওদিক সরে আমাকে জাগাতে চায়।
এতোই নির্বোধ তুমি, অথবা তোমার চোখ,
তোমার দৃষ্টিতে বেয়ে কতো বেশি অনায়াসে তোমাকেই পড়ে ফেলি
কখনোই জানবে না তুমি। কখনো বুঝবে না তাও-
আমারই শীৎকারে শীৎকারে মেখে বোধের আগুনে যে
কল্পিত অবয়ব আঁকো, ওটা যে আমি নই সেও নয়-
আর কেউ, বুকের দখলে রাখা অন্য কোনো অতৃপ্ত স্বজন !

নিপুলের চূঁড়া ছুঁয়ে তুখোড় তর্জনী ফেলে কোথায় লুকোবে আর !
চিবুকের তিল গ্রীবা সানুবুক ঠেলে
পিছলে যাওয়া চোখের সড়ক ধরে গড়িয়ে গড়িয়ে যাবে
উঁচু নিচু ঢাল বেয়ে নিচে আরো নিচে আরো নিচে...

আর তোমার পতন দেখে ধীরে ধীরে উষ্ণ আমি
গেঁথে নেবো সব চিহ্ণ সব স্মৃতি তোমার নগ্নতা সবই,
হয়তো জানবে না কেউই অথবা তুমিও, বুকের নিপুল ছুঁয়ে
ফেলে যাওয়া তর্জনীটা যেখানে হৃদয় থাকে টিপ করে চেপে দাও যদি-
জরায়ুর অন্ধকার ছিঁড়ে আশ্চর্য আলোকপাতে ভেসে যাবো আমি !
রতিতৃপ্ত পতঙ্গের মতো তুমি তো উড়েই যাবে
অন্য কোনো অবয়বে খুঁজে নিতে নিত্যসুখ, বোধের সাম্পান। আর
তৃষ্ণা-কাতর আমি অন্য কোনো দৃশ্যপটে আবারো কম্পিত হবো তর্জনীর চাপে !
(২৪/০৫/২০০৯)
[sachalayatan]


কররেখা

মানুষের পদরেখা মানুষ বোঝে না
শুধু কররেখা গুনে গুনে কী আশ্চর্য মিলিয়ে নেয়
খরদাহ জ্যোতিষ্কের কাল, পাথরের অলৌকিক স্বভাব
কিংবা সময়ের গর্ভের আগাম উত্তাপ, সবই।
তবে কি কররেখা রেখা নয়, চুপ করে পড়ে থাকা নদীর স্বভাব ?

মানুষের কররেখা নদীই যেমন।
বুকের বর্ষায় ভেজা নিঃসঙ্গ উঠোন জুড়ে
এপার ওপার করে কতোবার মারিয়েছো তুমি ?
বসে যাওয়া বিবর্ণ পায়ের ছাপ নেড়েচেড়ে অসম্ভব কুটিকুটি আমি
পাইনি খুঁজে কোনো রেখাময় পায়ের প্রপাত-
কূলপ্লাবী স্রোতে-জলে যে নদী হারাতে জানে !
ওখানে ভাসাবো বলে নির্জন রেখাতটে বসে বসে
আয়ুধ সাম্পান গড়ে ঘূণের মোচ্ছবে শুনি আজ-
আহা, মানুষের পদতলে রেখা নেই, নদীর আহ্বানও নেই !

বুকের বর্ষায় ভেজা পিচ্ছিল উঠোন ভেঙে সত্যিই হেঁটে গেলে
একবারও ডাকেনি কি বৃক্ষল শরীরে তোমার
উন্মূল পতনের স্বর ? দেহের উষ্ণতা মেখে লেপ্টানো এ মাটি-বুক
অদৃশ্য উড়ালে না হয় হয়ে যেতো হৈমন্তী আকাশ,
সে সব হয়নি কিছুই।

নাই হলো দেয়া-নেয়া পরস্পর আদিম অভাব,
কখনো কি দেখা হবে তোমার আমার ?
কররেখা গুনে যদি দেখা যেতো নদীর স্বভাব...!
(২১-০৬-২০০৯)
[agunpakhi]
[somewherein]

Tuesday, February 10, 2009

# মেধাবী ছেলে..


মেধাবী ছেলে..
রণদীপম বসু


বাপীর সাথে বইমেলা থেকে কিনে আনা মজার মজার বইগুলো পড়ে প্রান্তু ঠিকই জেনে গেছে লেখাপড়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য খেলাধূলাও করতে হবে নিয়মিত। তাই ইস্কুল ছুটির পরই ইস্কুলভ্যানটা না আসা পর্যন্ত তাড়াহুড়ো করে কটকটে রোদের মধ্যেই অন্য সহপাঠিদের সাথে দৌঁড়ঝাপ করতে শুরু করে। তা করতে গিয়ে মাঠের মধ্যে কখনো চিৎ হয়ে কখনো কাৎ হয়ে কখনো বা উপুড় হয়ে আছড়ে পড়ে। ইউনিফরমটা ধুলোতে মাটিতে একাকার হয়ে ময়লা দাগ বসে যায়। তাতে যে প্রান্তুর কোন দোষই নেই মামণিটা তা কিছুতেই বুঝতে চায় না। মেধাবী ছেলেরা কি আর এমনি এমনি মাটিতে গড়াগড়ি খায় ? বাসায় এলেই মামণির এই গজরগজর এক্কেবারেই অপছন্দ তার।

ইস্কুল-ব্যাগটা এক ঝটকায় বিছনায় ছুঁড়ে দিয়ে দ্রুত ছুটে যায় বেলকনির দিকে। ময়নাটা না জানি কতক্ষণ যাবৎ কিচ্ছু খায় নি কে জানে। বেতের মোড়াটায় লাফ দিয়ে উঠে পড়ে সে। ঝুলানো খাঁচার লোহার শলাগুলোর ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় ভেতরে আটকে রাখা খাবারের পাত্রটার দিকে। একটা ছোলাও নেই। তাকে দেখে ময়নাটাও চঞ্চল হয়ে ওঠে। আহারে, কতক্ষণ ধরে উপোস ! এক ঝটকায় ফিরে আসে পড়ার টেবিলের ধারে। পাশেই প্লাস্টিকের বয়ামে ভিজিয়ে রাখা ছোলাগুলো ফুলেফেঁপে কেমোন টসটস করছে। মুহূর্তেই হাত ঢুকিয়ে দেয় ভেতরে। কিন্তু তার আগেই মামণিটা এসেই জাপটে ধরে তাকে। এই খোল্ খোল্ বলে ইস্কুল ড্রেসটাতে হামলে পড়ে। ইশ্, কী করেছে সাদা শার্টটাকে দেখো। গা থেকে পুরো পোশাকটা না পাল্টে মামণির আর ক্ষান্তি নেই। কিছুতেই বুঝানো যায় না যে ময়নাটা খাবারের জন্য কী করুণ চোখে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে।

ড্রেসটা হাতে নিয়ে গজগজ করতে করতে মামণি বাথরুমের দিকে যাবে। ডিটারজেণ্টে মিশিয়ে বালতিতে ভিজিয়ে রাখতে রাখতে গজরগজর চলতেই থাকবে- 'অসভ্য কোথাকার, তোর মতো আরেকটা খাটাশ ছেলে পাবি নাকি ইস্কুলে ! প্রত্যেকদিন এক সেট করে কাপড় নোঙরা নর্দমায় মাখিয়ে আনবে ! কাহাতক ভালো লাগে এসব... !' যখন মুড ভালো থাকে তখন মামণির সম্বোধনটা হয় তুমি তুমি করে। আর যখনই মুড খারাপ, তখনই তুই তুই ছাড়া আর কথাই নেই। অন্য কেউ কখনো প্রান্তুকে তুই বলে সম্বোধন করলেই খুব অপমান বোধ করে সে। মুখের উপর বলে দেয়, আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন ? কিন্তু মামণির এই রাগ করে তুই তুই বলাটাকে কিছুই মনে করে না সে। বরং ভালোই লাগে তার। যেন এটাই স্বাভাবিক। আর তাই এগুলোকে তোয়াক্কা না করে সোজা চলে যায় ময়নাটার কাছে। শিকগুলোর ফাঁক দিয়ে মুঠো ভরে আনা ছোলাগুলো একটা দু'টা করে পাত্রটাতে ছাড়তে থাকে। কখনো আবার খুব আদর করতে ইচ্ছে হলে খাঁচার ছোট্ট দরজাটা আলতো খুলে হাতটা ঢুকিয়ে দেয় ভেতরে। পাখিটাও এদিক থেকে সেদিকে সরতে গিয়ে হাতের সাথে যে স্পর্শগুলো টের পায় তাতেই বুকটা ভরে ওঠে তার। পাখিটা দুষ্টুও আছে। কখনো কখনো ঠোকর বসিয়ে দেয় হাতে। এত্তো বোকা পাখি, বুঝেই না যে সে তাকে আদর করতেই হাত বাড়িয়েছে। আচ্ছা, শুধু ছোলা খেতে কি ভালো লাগবে ওর ? কিছু ভাতও দেয়া যেতে পারে। যেই ভাবা সেই কাজ। রান্নাঘরের দরজায় পা দিতে না দিতে যেখানেই থাক মামণি কী করে যেনো টের পেয়ে যায়,- 'এই কিছুতে হাত দিবি না খবরদার !'

সত্যি বলতে কী, এই ময়নাটাই প্রান্তুর ধ্যান জ্ঞান। মাত্র ক'দিন হলো এটা কেনা হয়েছে। প্রতিদিনের মতো সেদিনও ইস্কুল থেকে ফিরে দোতলার এই ফ্ল্যাটের বেলকনির গ্রিল ধরে সঙ্গিহীন উদাস দাঁড়িয়ে বাইরের পৃথিবীটা দেখছে। ইস্কুলের সময় ছাড়া আর বাকি সময়টাই তো এই চার দেয়ালের অসহ্য জীবন তার। কখনো ছড়া গল্পের বই পড়া, কখনো টিভির নবটাকে শুধু শুধু মোচড়ানো। কখনো বা এই গ্রিল ধরে নিষ্প্রাণ দাঁড়িয়ে থাকা। হঠাৎ এক অদ্ভুত দৃশ্য। লোকটা কাঁধে একটা লম্বা লাঠিতে অনেকগুলো খাঁচা ঝুলিয়ে ‘এই ময়না টিয়া শালিক’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে চলে যাচ্ছে। প্রতিটা খাঁচার মধ্যে রঙবেরঙের কী সুন্দর সুন্দর পাখিগুলো নাচানাচি করছে। প্রান্তুর হঠাৎ কী হলো যেনো। মামণি মামণি বলে চিৎকার করতে লাগলো। এমন অকস্মাৎ চিৎকারে উৎকণ্ঠিত মামণি 'কিরে কী হয়েছে' বলে দৌঁড়ে এলো। সে অঙ্গুলি নির্দেশে লোকটাকে দেখিয়ে চেঁচাতে লাগলো আমাকে ওটা একটা এনে দাও এনে দাও। এমন চেচামেচিতে পাশের ফ্ল্যাটের বেলকনিতেও কৌতুহলী মুখগুলো ভীড় করতে লাগলো। এবং কী আশ্চর্য, সেই পাখি ফেরি করা লোকটাও এসে নিচে দাঁড়িয়ে রইলো। মামণি কী বুঝলো কে জানে, 'ঠিক আছে ঠিক আছে' বলে লোকটাকে ইশারা করে নিচে নেমে গেলো। পেছন পেছন প্রান্তুও ছুটলো।

‘এই বাচ্চাটা নেন, ময়না, ইচ্ছে মতো বুলি শিখাইতে পারবেন’ বলে খাঁচাটা ধরিয়ে দিলো। বিশাল যুদ্ধজয়ের আনন্দে উদ্বেল সে। বেলকনিতে ঝুলিয়ে রাখা হলো। সেই থেকে প্রান্তুকে আর পায় কে। ভীষণ ব্যস্ত সে। কোন পরিচর্যায় কী রকমভাবে পাখিটা বেশি সন্তুষ্ট হচ্ছে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আর পরপরই এসে মামণির কাছে বিশদ ধারাবর্ণনা। বাসা জুড়ে একেবারে ঝালাপালা অবস্থা। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে ঘরে পা দিতে না দিতে বাপীর হাত ধরে টেনে বেলকনিতে। এই দেখো বাপী, পাখিটা না আমার সব কথা বুঝতে পারে। আমি চুপ বললেই ওটা দুষ্টুমি বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকে। জানো ওটা না কীরকম করে আমার চোখের দিকে একটুও পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকে। দেখবে ?... কিন্তু বাপীর কোন উচ্ছ্বাস না দেখে দমে গেলো সে। 'হুম' বলে বাপী চলে গেলো। কিন্তু পাখি বিষয়ক তার উৎসাহ দিন দিন বাড়তেই লাগলো। ওটাকে যে কথা বলা শেখাতে হবে ! আর এইসব অভিযান কার্যকর করতে গিয়ে প্রান্তুর আদেশ নির্দেশের ঠেলায় ছোট্ট কাজের মেয়েটার অবস্থা আরও কাহিল। বাসার অন্য সব কাজ বাদ দিয়েও তার নাভিশ্বাস ওঠার যোগাড়।

আজকেও যথারীতি স্কুল থেকে ফিরে বেলকনিতে উঁকি দিতেই প্রান্তুর বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠলো। খাঁচাটা খালি কেন ! ময়নাটা কই ? মামণি ! মামণি ! আমার ময়না কোথায় ? হাউমাউ কান্না আর বুকফাটা তীব্র চিৎকারে ঝনঝন করে ওঠলো ঘর দরজা সব। শোন্ বাবা শোন্, আমি আরেকটা কিনে দেবো তোকে, শোন.. মামণির আতঙ্ক মিশ্রিত অভয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। 'এক্ষুনি আমার ময়না এনে দাও, এনে দাও' বলে উন্মত্ত হয়ে ওঠলো সে। এমন আশঙ্কাই করেছিলেন তিনি। সে ইস্কুল থেকে আসার আগ পর্যন্ত সারাটাদিন দুশ্চিন্তায় কেটেছে তাঁর। মেয়েটিকেও আচ্ছা করে যেভাবে বকেছেন, এমনটা তিনি করেন না কখনো। কী দরকার ছিলো তোর এতো আহাদ দেখিয়ে পাখিটাকে আদর করতে যাওয়ার ? আর গেলি তো গেলি, খাঁচার মুখটা ভালো করে আটকে গেলি না কেনো ? মুখে এসব বললেও তিনি ঠিকই বুঝেন প্রান্তুর সাথে ওই মেয়েটির পার্থক্য আর কীইবা ! শিশুই তো। এই বন্দি জীবনে ওরও তো সাধ আহাদগুলো বন্দি হয়ে গেছে। লেখাপড়ার করার এই বয়সে অন্যের বাড়িতে কাজ করে পেটের ভাত যোগাড় করতে হয় ! তাইতো অবসর সময়ে তাকেও তিনি বর্ণপরিচয় শেখাতে লেগে যান। কিন্তু এখন কী হবে ? প্রান্তুর চিৎকার চেচামেচি কান্নায় বাড়িঘর মাথায় তুলে ফেলার অবস্থা। তার উন্মত্ততা যখন সীমা অতিক্রম করে জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে লাগলো, তখনি ঠাশ করে চড় কষলেন তার গালে।

যে মামণি কখনো মারে না তাকে, হঠাৎ এভাবে মামণির চড় খেয়ে তার কী যে হয়ে গেলো, শো-কেসের সামনেই কাচের জগটা হাতের নাগালে পেয়েই ধুরুম করে আছরে ফেললো। একটা টুকরা কিভাবে যেন ছিটকে গিয়ে মামণির কপালে লাগলো। মামণি একটা হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরলো। হতভম্ব হয়ে গেলো প্রান্তু। সোজা পড়ার টেবিলে গিয়ে মুখ গুঁজে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।

বিকেলে অফিস শেষে বাপী বাসায় ফিরেই সব শুনলেন। কিন্তু কী আশ্চর্য, প্রান্তুকে বকলেনও না। শুধু ঘোষণা দিলেন, আগামীকাল প্রান্তু স্কুলে যাবে না। কেন ? মামণির প্রশ্নের উত্তরে শুধু বললেন, কেন, তা সকালেই বলবো।

পরদিন সকাল আটটায় অফিসে যাবার আগে বাপী প্রান্তুকে সামনের রুমে রেখে মামণিকে বললেন, আজ সারাদিন প্রান্তু এ রুমের বাইরে যেতে পারবে না। রুমের এটাচ্ড বাথরুম ব্যবহার করবে এবং তার খাবার তাকে এই রুমেই দেয়া হবে। বলেই বাইরে থেকে দরজাটা লাগিয়ে চাবি মামণির কাছে দিয়ে বললেন, শুধু দুপুরের খাবার দেয়ার সময় এ দরজা একবার খোলা হবে, ব্যস। জানলা দিয়ে প্রান্তু দেখলো শুধু, বাপী একবারও পেছনে না তাকিয়ে হন হন করে চলে গেলেন। গলি পেরিয়ে বাঁক ঘুরে মিলিয়ে যেতেই প্রান্তু দরজায় গিয়ে থাবাতে লাগলো, মামণি মামণি দরজা খোলো দরজা খোলো। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। ধাম ধাম করে কয়েকটা লাথি দিলো এবার। তারপরেই বিছানায় পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।

সে বুঝে ফেলেছে বাপী তাকে একটুও পছন্দ করে না। নইলে কেউ কাউকে এভাবে তালা মেরে যায় ! মামণিটার প্রতি রাগ হলো সবচেয়ে বেশি। সে তো মামণিকে কতো ভালোবাসে। মামণিও বাপীকে কিছু বললো না ! আর কথাই বলবে না সে কারো সাথে। এরপরই আবার কাঁদতে শুরু করলো। কিন্তু এবারের কান্নাটা কেমন যেন ! এ কান্নাতে কী রকম কষ্ট লাগছে তার। অন্য কান্নাতে তো এমন মনে হয় না ! হঠাৎ দরজায় ক্যাচক্যাচ শব্দে মুখ তোলে তাকিয়ে দেখে মামণি প্লেটে করে তার প্রিয় ভাপা পিঠা বানিয়ে এনেছে অনেকগুলো। খুশি হয়ে ওঠলো সে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো সে তো কারো সাথে কথা বলবে না। এমন কি কিছু খাবেও না। মামণির প্রতি অভিমানে বুক ভার হয়ে এলো তার। চোখ দিয়ে পানি আসতে শুরু করেছে। কোন কথা না বলে বিছানায় পাশ ফিরে মামণিকে পেছন দিয়ে শুয়ে পড়লো।

বাবু তোমার জন্য বানিয়েছি, উঠে পিঠা খাও ? কয়েকবার আদর করে ডাকলেও মামণির ডাকে কোনো সাড়া না দিয়ে তীব্র অভিমানে প্রান্তু ওভাবেই পড়ে রইলো। আচ্ছা ঠিক আছে, এই রেখে গেলাম। খিদে পেলে খেও, বলে পিঠার প্লেটটা টেবিলে রেখে দরজাটা আস্তে করে ভেজিয়ে দিয়ে মামণি চলে গেলো।

দুপুরেও অনেক সাধাসাধি করেও প্রান্তুকে খাওয়ানো গেলো না। মামণি শেষ পর্যন্ত কেঁদেই দিলো। কোলে টেনে নিলো তাকে। কী আশ্চর্য, মামণির এই কান্না তার এতো ভালো লাগছে কেন ! কিন্তু সে কিছুতেই খাবে না। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেলো সে মেধাবী ছেলে। তাকে তালা মেরে রাখায় তার অপমান হয়েছে। মেধাবী ছেলেরা অন্য সবার মতো নয়। কোন অনুনয় বিনয়ে কাজ হলো না। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে মামণি উঠে চলে গেলো। ওপাশ থেকে আর কারোরই খাওয়া দাওয়া বা অন্য কোন সাড়াশব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু হালকাভাবে প্রান্তুর কানে এলো মামণি কাকে যেন ফোন করছে, হ্যালো...।

দুপুরের পরপরই বাপী চলে এলো অফিস থেকে। প্রান্তুর কিছুটা ঘুম ঘুম ভাব এসে গিয়েছিলো। বাপীর ডাকে সে সচকিত হয়ে ওঠলো। কইরে বাবু ওঠো, ভাত খাবে না ? অন্যদিন থেকে বাপীর কণ্ঠটা কেমন মোলায়েম লাগছে। এতোটা মোলায়েম করে বাপী সাধারণত কখনো ডাকেন না। কিন্তু প্রান্তু চুপ করে রইলো। সে যে কারো সাথে কোন কথা বলবে না। তাছাড়া বাপীর সাথে তো প্রশ্নই আসে না।

হঠাৎ প্রান্তু শূন্যে ভাসতে লাগলো। অর্থাৎ বাপী তাকে দুহাতে তুলে ধরেছেন। তারপরই বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কী হয়েছে বাবু তোমার ? কেমন একটা অস্বস্তি হতে লাগলো প্রান্তুর। কারণ বাপী তাকে এভাবে খুব একটা কোলে নেন না। কিন্তু ভালোও লাগছে খুব। আবারো বাপীর প্রশ্ন, বলো না বাবু কী হয়েছে তোমার ? তুমি নাকি কিছু খাওনি ?
সে যে কথা বলবে না এটা বাপীকে জানানো দরকার। নইলে বাপীর প্রশ্ন থামবে না সে জানে। তাই বললো, বাপী আমি তো কারো সাথে কথা বলবো না।
কেন বলবে না ?
সেটা তো বলা যাবে না।
কেন বলা যাবে না ?
এবার খুব রাগ হলো তার। বেশ ঝাঁঝ দিয়ে বললো, কেন ? বলতে না চাইলেও বলতে হবে নাকি ?
অবশ্যই না ! বলতে না চাইলে বলবে কেন ? তবে আমাদের ময়নাটা কেন কথা বলবে না, এটা না জানলে যে আমাদেরও কিচ্ছু ভালো লাগবে না !
তুমি কি আমার সাথে ঠাট্টা করছো ?
এই একটু একটু করছি।
তুমি জানো না, আমার কাছে ঠাট্টা ভালো লাগে না ?
আগে তো তাই জানতাম। কিন্তু তুমি যে তোমার ময়নাটার সাথে ঠাট্টা করতে, সেটা কেন করতে ?
তুমি কিভাবে জানো তা ? প্রান্তুর চোখে বিস্ময়। বাপী জানলো কী করে !
আমি যে আমাদের ময়নাটার চোখ দেখেই বলে দিতে পারি !
সত্যি বলছো ?
হাঁ সত্যি। তুমি আমার দিকে তাকাও, দেখো আমি কিভাবে সব বলে দেই।
শিশুর নিষ্পাপ দুটো চোখ আকাশের চে’ও বড় হয়ে মেলে রইলো। তাহলে বলো তো বাপী আমি এখন কী ভাবছি ?
হুঁম.. তুমি তো দেখছি অনেকগুলো কথা একসাথে ভাবছো ! আমি একে একে বলি ?
মাথাটা একপাশে হেলে সম্মতি জানালো সে।
তুমি ভাবছো, বাপীটার মাথা টাথা ঠিক আছে তো ?
যাও, কথা বলবো না। আমি তো এটা ভাবি নি !
উঁহু, তুমি জানোই না যে তুমি তা ভাবছো। কিভাবে ? তা বলছি। তবে তার আগে আমি যে প্রশ্নগুলো করবো তার উত্তর কিন্তু ঠিক ঠিক দিতে হবে। আচ্ছা তুমি কি জানো, কেন আমি সকালে দরজাটা বন্ধ করে গেলাম ?
হঠাৎ যেন পুরনো কষ্টটা আবার মনে হয়ে গেলো তার। মনটা বিষন্ন হয়ে গেলো ফের। শুধু মাথাটা দুপাশে নাড়িয়ে তার না জানার কথাটা প্রকাশ করলো।
তুমি যে পাখির খাঁচাটা বন্ধ করে রাখতে, তাতে পাখিটার কষ্ট হতো কিনা তা কি তুমি জানো ?
আবারো সে দ্রুত মাথা নাড়িয়ে এবং মুখে উচ্চারণ করলো, নাহ ।
আমি যে আমার ময়না পাখিটাকে এ ঘরে দরজা বন্ধ করে গেছি তাতে তোমার কষ্ট হয় নি ?
হঠাৎ প্রান্তুর চোখে মুখে একটা উজ্জ্বলতা ফিরতে লাগলো। জানো বাপী, পাখিটার না কষ্ট হতো ! এজন্যই কি সে আমার হাতে কামড় দিতো ?
হাঁ। সে তোমাকে বলতে চাইতো, বাবু, তুমি আমাকে আমার মামণি আর বাপীর কাছে যেতে দাও। ও..ই দূরের জঙ্গলে বাসায় আমার মামণি আর বাপী কিচ্ছু না খেয়ে আমার জন্য কাঁদছে। আমাকে তুমি ছেড়ে দাও। আমি আমার মামণি আর বাপীর কাছে যাবো।

হঠাৎ প্রান্তু কাঁদতে শুরু করলো এবং কাঁদতে কাঁদতে বললে লাগলো, বাপী তুমি এভাবে বলছো কেন ? আমার যে কান্না আসছে ?
বাপী আবার তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তোমার তো কোন দোষ নেই বাবু। তুমি তো তাকে ভালোবাসতে, আদর করতে। কিন্তু তার কথা বুঝতে না বলেই তো তাকে ছাড়তে পারোনি তুমি, তাই না ?
বাপীর কাঁধের উপরে রাখা প্রান্তুর মাথাটা সম্মতি জানিয়ে নড়তে লাগলো।
এখন যে পাখিটা তার মামণি আর বাপীর কাছে ফিরে গেছে, তাতে কি ভালো হয়েছে না খারাপ হয়েছে ?
ঝনঝন করে উত্তর বেরিয়ে এলো, ভালো হয়েছে।
দেখি আমার দিকে চেয়ে বলো তো কেমন হয়েছে ?
পৃথিবীর সমস্ত আলো এখন প্রান্তুর মুখে, খুব ভালো হয়েছে বাপী !
গুড, এই তো মেধাবী ছেলের মতো কথা ! আচ্ছা এবার বলো তো, যাকে মানুষ ভালোবাসে তাকে কি কষ্ট দেয়া উচিৎ ?
কক্ষনো না !
তাহলে বাবুটা খায়নি বলে মামণিও যে আজ সারাদিন কিচ্ছু খায় নি, মামণির কষ্ট হচ্ছে না ?
হঠাৎ এক নির্মল কষ্টে প্রান্তুর মুখটা আরো বেশি নিষ্পাপ হয়ে ওঠলো। কী মনে করে ঝাঁপিয়ে পড়লো বাপীর বুকে। কেন যেন তার মনে হলো বাপীটা আসলে খুব ভালো। আর তখনি বাপীর কাঁধের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলো দরজায় দাঁড়ানো মামণিটা আসলে কতো বোকা ! তার এতো ভালো লাগছে, অথচ মামণিটা দাঁড়িয়ে বোকার মতো হাসতে হাসতে কাঁদছে !
(১৪/০৯/২০০৮)
[মাসিক 'টইটম্বুর'/ ঈদ ও বিজয় দিবস সংখ্যা- ডিসেম্বর ২০০৮]

[sachalayatan]