Thursday, July 30, 2009

[Hijra] হিজড়া, প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালের এক দুর্ভাগা শিকার !


হিজড়া, প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালের এক দুর্ভাগা শিকার !
রণদীপম বসু

স্মৃতি হাতড়ালে এখনো যে বিষয়টা অস্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে, শৈশবের অবুঝ চোখে সেইকালে বুঝে উঠতে পারতাম না, কারো বাড়িতে সন্তান জন্ম নিলে শাড়ি পরা সত্ত্বেও বিচিত্র সাজ-পোশাক নিয়ে কোত্থেকে যেসব মহিলা এসে নাচগান বা ঠাট্টা-মশকরা করে তারপর বখশিস নিয়ে খুশি হয়ে চলে যেতো, এদের আচার আচরণ ও বহিরঙ্গে দেখতে এরা এমন অদ্ভুত হতো কেন ! শৈশবের অনভিজ্ঞ চিন্তা-শৈলীতে পুরুষ ও নারীর পার্থক্যের জটিলতা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা না জন্মালেও স্বাভাবিকতার বাইরে দেখা এই অসঙ্গতিগুলো ঠিকই ধরা পড়েছে, যা প্রশ্ন হয়ে বুকের গভীরে জমে ছিলো হয়তো। পরবর্তী জীবনে তা-ই কৌতুহল হয়ে এক অজানা জগতের মর্মস্পর্শী পীড়াদায়ক বাস্তবতাকে জানতে বুঝতে আগ্রহী করে তুলেছে। আর তা এমনই এক অভিজ্ঞতা, যাকে প্রকৃতির নির্মম ঠাট্টা বা রসিকতা না বলে উপায় থাকে না !


অনিঃশেষ ট্র্যাজেডি
দেহ ও মানসগঠনে পূর্ণতা পেলে প্রাণীমাত্রেই যে মৌলিক প্রণোদনায় সাড়া দিয়ে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়, সেটা যৌন প্রবৃত্তি। অনুকুল পরিবেশে এই প্রবৃত্তি চরিতার্থ করা যেকোন স্বাভাবিক প্রাণীর পক্ষেই অত্যন্ত সাধারণ একটা ঘটনা। মানব সমাজের প্রমিত বা ভদ্র উচ্চারণে এটাকেই প্রেম বা প্রণয়ভাব বলে আখ্যায়িত করি আমরা। পুরুষ (male) ও স্ত্রী (female), লিঙ্গভিত্তিক দুই ভাগে ভাগ হয়ে পড়া প্রাণীজগতে এই মৌলিক প্রণোদনার সমন্বিত সুফল ভোগ করেই বয়ে যায় প্রাণীজাত বংশধারা। অথচ প্রকৃতির কী আজব খেয়াল ! কখনো কখনো এই খেয়াল এতোটাই রূঢ় ও মর্মস্পর্শী হয়ে উঠে যে, এর কোনো সান্ত্বনা থাকে না। মানবসমাজে প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালের সেরকম এক অনিঃশেষ ও দুর্ভাগা শিকারের নাম ‘হিজড়া’(hijra)। সেই আদি-প্রণোদনায় এরা তাড়িত হয় ঠিকই, কিন্তু তাদের জন্মগত লিঙ্গ-বৈকল্যধারী অক্ষম ক্লীব (neuter) বা নপুংশক দেহ যা তৃপ্ত করতে সম্পূর্ণ অনুপযোগী ! এরা ট্রান্সজেন্ডার (trans-gender), না-পুরুষ না-স্ত্রী। অর্থাৎ এমন এক লৈঙ্গিক অবস্থা যা দৈহিক বা জেনেটিক কারণে মেয়ে বা ছেলে কোন শ্রেণীতেই পড়ে না।

আমার অফিস পাড়ায় সপ্তাহের একটা নির্দিষ্ট দিনে দেখি সালোয়ার-কামিজ বা শাড়ি পরিহিত তরুণীর মতো এদের কয়েকজন এসে প্রতিটা দোকান থেকে অনেকটা প্রাপ্য দাবির মতোই ঠাট্টা-মশকরা করতে করতে দু’টাকা-চার টাকা-পাঁচ টাকা করে স্বেচ্ছা-সামর্থ অনুযায়ী তোলা নিয়ে যায়। এই তোলাটুকু দিতে কোন দোকানির কোনো আপত্তিও কখনো চোখে পড়েনি। বরং সহযোগিতার মায়াবি সমর্থনই চোখে পড়েছে বেশি। পুরনো কৌতুহলে আমিও তাদের সেই রহস্যময় গোপন জগতের সুলুক-সন্ধানের চেষ্টা করি। তাদের নীল কষ্টগুলো সত্যিই নাড়া দিয়ে যায় কোন এক কষ্টনীল অনুভবে।


মুছে যায় পুরনো পরিচয়
জন্মের পর পরই যে ত্রুটি চোখে পড়ে না কারো, ধীরে ধীরে বড় হতে হতে ক্রমশই স্পষ্ট হতে থাকা সেই অভিশপ্ত ত্রুটিই একদিন জন্ম দেয় এক অনিবার্য ট্র্যাজেডির। সমাজ সংসার আত্মীয় পরিজন পরিবার সবার চোখের সামনে মুছে যেতে থাকে একটি পরিচয়। আপনজনদের পাল্টে যাওয়া আচরণ, অবহেলা, অবজ্ঞাসহ যে নতুন পরিচয়ের দুঃসহ বোঝা এসে জুড়তে থাকে দেহে, তাতে আলগা হতে থাকে পরিচিত পুরনো বন্ধন সব, রক্তের বন্ধন মিথ্যে হতে থাকে আর ক্রমেই মরিয়া হয়ে একদিন সত্যি সত্যি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পরিবার থেকে সে। অভিশপ্ত নিয়তি এদের ফেরার পথটাও বন্ধ করে দেয় চিরতরে। কারণ অভ্যস্ত সমাজের বাইরে তার একটাই পরিচয় হয়ে যায় তখন- হিজড়া !

কই যায় সে ? সেখানেই যায়, যেখানে তাদের নিজস্ব জগতটা নিজেদের মতো করেই চলতে থাকে, বেদনার নীল কষ্টগুলো ভাগাভাগি করে নীল হতে থাকে নিজেরাই। হিজড়া পল্লী। কেননা পরিবারের মধ্যে থেকে বড় হতে হতে তার যে পরিবর্তনগুলো ঘটতে থাকে, তা অন্য কারো চোখে স্পষ্ট হয়ে ওঠার আগেই ধরা পড়ে যায় ভ্রাম্যমান অন্য হিজড়াদের চোখে। তাদের দুর্ভাগ্যের আগামী সাথী হিসেবে আরেকটা দুর্ভাগা প্রাণীকে তারা ভুলে না। এরা উৎফুল্ল হয় আরেকজন সঙ্গি বাড়ছে বলে। একসময় এরাই তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় তাদের নিজেদের পল্লীতে। পল্লী মানে সেই বস্তি যেখানে সংঘবদ্ধ হয়ে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে বাস করে হিজড়ারা। যেখানে তাদের নিজস্ব সমাজ, নিজস্ব নিয়ম, নিজস্ব শাসন পদ্ধতি, সবই ভিন্ন প্রকৃতির।


অন্য জীবন
যে সমাজ তারা ছেড়ে আসে সেই পুরনো সমাজ এদের কোন দায়-দায়িত্ব নিতে আগ্রহী নয়, তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ দিতে প্রস্তুত নয় কিংবা সামাজিক স্বীকৃতি দিতে ইচ্ছুক নয় বলে তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হয়ে যায় মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পেতে সাহায্য ভিক্ষা করা। এভাবে অন্যের কৃপা-নির্ভর বেঁচে থাকার এক অভিশপ্ত সংগ্রামে সামিল হয়ে পড়ে এরা। স্বাভাবিক শ্রমজীবীদের মতো উপার্জনের কাজে এদেরকে জড়িত হতে দেখা যায় না। নিজস্ব পদ্ধতিতে হাটে বাজারে তোলা উঠানোর পাশাপাশি বিনামূল্যে ভোগ্যপণ্য সংগ্রহ করেই এরা জীবিকা নির্বাহ করে। এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কৌতুককর মনোরঞ্জনকারী হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে নাচগানে অংশ নিয়ে থাকে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বিকৃত যৌনপেশাসহ নানান অপরাধের সাথেও জড়িয়ে পড়ে।

হিজড়াদের সমাজে প্রতিটা গোষ্ঠীতে একজন সর্দার থাকে। তারই আদেশ-নির্দেশে সেই গোষ্ঠী পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে হিজড়াদের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ বলে জানা যায়। তবে এই ক্ষেত্রে হিজড়াদের প্রকৃত জনসংখ্যা নিয়ে কিছুটা ধুয়াশা থেকেই যায়। কারণ নিজেদেরকে আড়ালে রাখা অর্থাৎ বহিরঙ্গে অপ্রকাশিত হিজড়াদের পরিসংখ্যান এখানে থাকার সম্ভাবনা কম। বাইরে থেকে যে চেহারাটা প্রকট দেখা যায় সেই লিঙ্গে আত্মপ্রকাশ করে এই বিরূপ সমাজে অনেকেই নিজেদেরকে সযত্নে ঢেকে রাখেন বলে বাইরের মানুষ তা জানতে পারে না। যে ক্ষেত্রে এই বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট অর্থাৎ ঢেকে রাখার মতো নয় এবং বাইরে থেকে বুঝা যায়, কেবল সেক্ষেত্রেই মানুষ নিজেকে হিজড়া হিসেবে প্রকাশিত করে এবং পরিবার থেকে বের হয়ে যায়। রাজধানী ঢাকাতে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় পনের হাজার। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অবস্থানরত হিজড়ারা পাঁচ থেকে পঞ্চাশজন হিজড়া সর্দারের নিয়ন্ত্রণে গোষ্ঠীবদ্ধ রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রের তথ্য। সর্দারদের নিজস্ব এলাকা ভাগ করা আছে। কেউ অন্য কারো এলাকায় যায় না বা তোলা ওঠায় না, এমনকি নাচগানও করে না। একেকজন হিজড়া সর্দারের অধীনে অন্তত অর্ধশতাধিক হিজড়া রয়েছে। হিজড়া সর্দারের অনুমতি ছাড়া সাধারণ হিজড়াদের স্বাধীনভাবে কিছু করার উপায় নেই। এমনকি সর্দারের আদেশ ছাড়া কোন দোকানে কিংবা কারো কাছে হাত পেতে টাকাও চাইতে পারে না এরা। সর্দারই ৫/৬ জনের একেকটি গ্রুপ করে টাকা তোলার এলাকা ভাগ করে দেয়। প্রত্যেক সর্দারের অধীনে এরকম ৮ থেকে ১০ টি গ্রুপ থাকে। প্রতিদিন সকালে সর্দারের সঙ্গে দেখা করে দিক নির্দেশনা শুনে প্রতিটি গ্রুপ টাকা তোলার জন্য বের হয়ে পড়ে। বিকেল পর্যন্ত যা টাকা তোলা হয়, প্রতিটি গ্রুপ সেই টাকা সর্দারের সামনে এনে রেখে দেয়। সর্দার তার ভাগ নেয়ার পর গ্রুপের সদস্যরা বাকি টাকা ভাগ করে নেয়।

প্রতি সপ্তাহে বা নির্দিষ্ট সময় পর পর হিজড়াদের সালিশী বৈঠক বসে। ১৫ থেকে ২০ সদস্যের সালিশী বৈঠকে সর্দারের নির্দেশ অমান্যকারী হিজড়াকে কঠোর শাস্তি দেয়া হয়। অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় বেত দিয়ে পেটানোসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক নির্যাতন এবং কয়েক সপ্তাহের জন্য টাকা তোলার কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়। কখনো কখনো জরিমানাও ধার্য্য করা হয় ৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। দণ্ডিত হিজড়াকে তার নির্ধারিত এলাকা থেকে তুলে এই টাকা পরিশোধ করতে হয়। এই শাস্তি হিজড়ারা মাথা পেতে মেনে নেয় এবং কেউ এর প্রতিবাদ করে না।


হিজড়া কেন হিজড়া ?
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যাদের জন্মপরবর্তী লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয়, মূলত তারাই হিজড়া। জীবনের স্বাভাবিক আনন্দ থেকে বঞ্চিত হিজড়াদের কামনা বাসনা আছে ঠিকই, ইচ্ছাপূরণের ক্ষেত্রটা নেই কেবল। এদের শারীরিক গঠন ছেলেদের মতো হলেও মন-মানসিকতায় আচার আচরণে সম্পূর্ণ নারীর মতো (she-male)। তাই তাদের সাজ-পোশাক হয়ে যায় নারীদের সালোয়ার কামিজ কিংবা শাড়ি। অনেকে গহনাও ব্যবহার করে। কৃত্রিম স্তন ও চাকচিক্যময় পোশাক ব্যবহার করতে পছন্দ করে এরা।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, হিজড়াদের নাকি বৈশিষ্ট্যগতভাবে দুইটি ধরন রয়েছে, নারী ও পুরুষ। নারী হিজড়ার মধ্যে নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য থাকলেও স্ত্রীজননাঙ্গ না থাকায় তার শারীরিক গঠন অস্বাভাবিক। পুরুষ হিজড়াদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। তবে হিজড়ারা নারী বা পুরুষ যাই হোক, নিজেদেরকে নারী হিসেবেই এরা বিবেচনা করে থাকে। সারা বিশ্বে প্রকৃতি প্রদত্ত হিজড়াদের ধরন একইরকম। শারীরিকভাবে পুরুষ, কিন্তু মানসিকভাবে নারীস্বভাবের হিজড়াদেরকে বলা হয় ‘অকুয়া’। অন্য হিজড়াদেরকে বলা হয় ‘জেনানা’। এছাড়া সামাজিক প্রথার শিকার হয়ে আরব্য উপন্যাসের সেই রাজ-হেরেমের প্রহরী হিসেবে পুরুষত্বহীন খোজা বানানো মনুষ্যসৃষ্ট সেইসব হিজড়াদেরকে বলা হয় ‘চিন্নি’।

হিজড়া থেকে কখনো হিজড়ার জন্ম হয় না। প্রকৃতিই সে উপায় রাখে নি। কুসংস্কারবাদীদের চোখে একে সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ কিংবা পিতামাতার দোষ বা প্রকৃতির খেয়াল যাই বলা হোক না কেন, আধুনিক বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা অন্যরকম। চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী মাতৃগর্ভে একটি শিশুর পূর্ণতা প্রাপ্তির ২৮০ দিনের মধ্যে দুটো ফিমেল বা স্ত্রী ক্রোমোজোম এক্স-এক্স প্যাটার্ন ডিম্বানু বর্ধিত হয়ে জন্ম হয় একটি নারী শিশুর এবং একটি ফিমেল ক্রোমোজোম এক্স ও একটি মেল বা পুরুষ ক্রোমোজোম ওয়াই মিলে এক্স-ওয়াই প্যাটার্ন জন্ম দেয় পুরুষ শিশুর। ভ্রূণের পূর্ণতা প্রাপ্তির একটি স্তরে ক্রোমোজোম প্যাটার্নের প্রভাবে পুরুষ শিশুর মধ্যে অণ্ডকোষ এবং মেয়ে শিশুর মধ্যে ডিম্বকোষ জন্ম নেয়। অণ্ডকোষ থেকে নিঃসৃত হয় পুরুষ হরমোন এন্ড্রোজেন এবং ডিম্বকোষ থেকে নিঃসৃত হয় এস্ট্রোজন। পরবর্তী স্তরগুলোতে পুরুষ শিশুর যৌনাঙ্গ এন্ড্রোজেন এবং স্ত্রী শিশুর যৌনাঙ্গ এস্ট্রোজনের প্রভাবে তৈরি হয়। ভ্রূণের বিকাশকালে এই সমতা নানাভাবে বিঘ্নিত হতে পারে। প্রথমত ভ্রূণ নিষিক্তকরণ এবং বিভাজনের ফলে কিছু অস্বাভাবিক প্যাটার্নের সূচনা হতে পারে। যেমন এক্স-ওয়াই-ওয়াই অথবা এক্স-এক্স-ওয়াই। এক্স-ওয়াই-ওয়াই প্যাটার্নের শিশু দেখতে নারী-শিশুর মতো। কিন্তু একটি এক্সের অভাবে এই প্যাটার্নের স্ত্রী-শিশুর সব অঙ্গ পূর্ণতা পায় না। একে স্ত্রী-হিজড়াও বলে। আবার এক্স-এক্স-ওয়াই প্যাটার্নে যদিও শিশু দেখতে পুরুষের মতো, কিন্তু একটি বাড়তি মেয়েলি ক্রোমোজম এক্সের জন্য তার পৌরুষ প্রকাশে বিঘ্নিত হয়। একে পুরুষ হিজড়াও বলে।

প্রকৃতির খেয়ালে হোক আর অভিশাপেই হোক, এই হিজড়াত্ব ঘোচাবার উপায় এখন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের নাগালে। চিকিৎসকদের মতে শিশু অবস্থায় চিকিৎসার জন্য আনা হলে অপারেশনের মাধ্যমে সে স্বাভাবিক মানুষের মতো পরিবারের মধ্যে থেকেই জীবন-যাপন করতে পারে। হয়তো সে সন্তান ধারণ করতে পারবে না, কিন্তু পরিবার ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে না হয়তো। দেখা গেছে যে অসচ্ছল নিম্নশ্রেণীর পরিবার থেকেই বাইরে বেরিয়ে যাবার প্রবণতা বেশি। তখন তাদের জীবনধারা সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। এরা না পারে নারী হতে, না পারে পুরুষ হতে। ফলে অন্যান্য অনেক অসঙ্গতির মতো হোমোসেক্স বা সমকামিতায় অভ্যস্ত হয়ে যায়।


হিজড়া কি মানুষ নয় ?
মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা হলো- দাসত্ব থেকে মুক্তির অধিকার, ভোটের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, কাজের অধিকার, মানসম্মত জীবন-যাপনের অধিকার, আইনের আশ্রয় ও নির্যাতন থেকে মুক্তির অধিকার এবং বিবাহ ও পরিবার গঠনের অধিকার। এইসব অধিকার পরিপন্থি কর্মকাণ্ডকে প্রতিরোধের জন্য আরো বহু চুক্তি ও সনদও রয়েছে। কিন্তু এসব অধিকারের ছিটেফোটা প্রভাবও হিজড়াদের জীবনে কখনো পড়তে দেখা যায় না। মানবাধিকার বঞ্চিত এই হিজড়ারা তাহলে কি মানুষ নয় ?

মানুষের জন্মদোষ কখনোই নিজের হয না। আর হিজড়ারা নিজেরা বংশবৃদ্ধিও করতে পারে না। এ অপরাধ তাদের নয়। স্বাভাবিক পরিবারের মধ্যেই অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে তাদের জন্ম। তবু প্রকৃতির প্রহেলিকায় কেবল অস্বাভাবিক লিঙ্গ বৈকল্যের কারণেই একটা অভিশপ্ত জীবনের অপরাধ সম্পূর্ণ বিনাদোষে তাদের ঘাড়ে চেপে যায়। প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালে একটা মেয়ে যদি ছেলে হয়ে যায়, কিংবা একটা ছেলে ঘটনাক্রমে মেয়ে হয়ে গেলেও এরকম পরিণতি কখনোই নামে না তাদের জীবনে, যা একজন হিজড়ার জীবনে অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া হয়। খুব অমানবিকভাবে যৌনতার অধিকার, পরিবারে সম্মানের সঙ্গে বসবাসের অধিকার, চাকরির অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার ইত্যাদি মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে যায় এরা। কিন্তু এসব অধিকার রক্ষা ও বলবৎ করার দায়িত্ব ছিলো রাষ্ট্রের। কেননা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযাযী রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হচ্ছে- ‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতৃপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আওতাধীন কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার’ প্রতিষ্ঠা করা। আদৌ কি কখনো হয়েছে তা ? অথচ পরিবার হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া হিজড়ারা প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তার অভাবে পৈতৃক সম্পত্তির বা উত্তরাধিকারীর দাবি প্রতিষ্ঠা থেকেও বঞ্চিত থেকে যায়। এমন বঞ্চনার ইতিহাস আর কোন জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের হয়েছে কিনা জানা নেই।

প্রকৃতির নির্দয় রসিকতার কারণে হিজড়াদের গতানুগতিকতার বাইরে ভিন্ন পদ্ধতির অনিবার্য যৌনতাকেও ইসলাম প্রধান দেশ হিসেবে সহজে মেনে নেওয়া হয় না। এমনকি ব্রিটিশ আমলেও এদেশে হিজড়াদের বিতাড়িত করা হয়েছে বলে জানা যায়। যৌনতার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ ভারতীয় আইনে হিজড়াদের যৌনতাকে ‘সডোমি’ অর্থাৎ অস্বাভাবিক ও অনৈতিক হিসেবে চিহ্ণিত করে পেনাল কোড (১৮৬০) এর ৩৭৭ ধারায় এটাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু তাদের মানবাধিকার রক্ষাকল্পে রাষ্ট্রীয় কোন উদ্যোগ কখনো হাতে নেয়া হয়েছে বলে শোনা যায় নি।

তাই বিবেকবান নাগরিক হিসেবে এ প্রশ্নটাই আজ জোরালোভাবে উঠে আসে, হিজড়ারা কি তাহলে রাষ্ট্রের স্বীকৃত নাগরিক নয় ? রাষ্ট্রের সংবিধান কি হিজড়াদের জন্য কোন অধিকারই সংরক্ষণ করে না ?

তবে খুব সম্প্রতি গত ০২ জুলাই ২০০৯ ভারতে দিল্লী হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ যুগান্তকারী এক রায়ের মাধ্যমে ‘প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে সমকামী সম্পর্ক’ ফৌজদারী অপরাধের তালিকাভুক্ত হবে না বলে ঘোষণা করেছে। ভারতের নাজ ফাউন্ডেশনের দায়ের করা এই জনস্বার্থমূলক মামলাটির রায়ে আদালত সমকামীদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির অপপ্রয়োগকে মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি, গণতন্ত্রের পরিপন্থি এবং অসাংবিধানিক বলে অভিমত দিয়েছে। আদালতের মতে এই প্রয়োগ ভারতীয় সংবিধান স্বীকৃত কয়েকটি মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি, যেগুলো হলো- আইনের দৃষ্টিতে সমতা (অনুচ্ছেদ ১৪), বৈষম্যের বিরুদ্ধে সুরক্ষা (অনুচ্ছেদ ১৫), জীবনধারণ ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার (অনুচ্ছেদ ২১)। রায়টির অব্যবহিত পরেই ভারত সরকারের পক্ষ থেকে রায়টিকে স্থগিত করার জন্য সুপ্রীম কোর্টের কাছে আবেদন করা হয় যা মঞ্জুর হয়নি (সূত্রঃ http://www.nirmaaan.com/blog/admin/4728 )। এই রায় ভারতের হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য এক বিরাট আইনি সহায়তার পাশাপাশি আমাদেরর দেশের জন্যেও একটা উল্লেখযোগ্য নমুনা হিসেবে উদাহরণ হবে। কেননা সেই ব্রিটিশ ভারতীয় এই আইনটিই আমাদের জন্যেও মৌলিক অধিকার পরিপন্থি হয়ে এখনো কার্যকর রয়েছে।


তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি নয় কেন ?
যুগ যুগ ধরে ফালতু হিসেবে অবজ্ঞা অবহেলা ঘৃণা টিটকারী টিপ্পনি খেয়েও বেঁচে থাকা ছোট্ট একটা বঞ্চিত জনগোষ্ঠী এই হিজড়াদের জন্য রাষ্ট্রের কোন বাজেট বা কোন পুনর্বাসন কার্যক্রম আদৌ হাতে নেয়া হয় কিনা জানা নেই আমাদের। আমরা শুধু এটুকুই জানি, পরিবার ও সমাজের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া হিজড়ারা বেঁচে থাকার তাগিদেই দলবদ্ধভাবে বসবাস করে বা করতে বাধ্য হয়। মানুষ হিসেবে তাদেরও যে অধিকার রয়েছে, তা সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্য নিয়ে হিজড়াদের উন্নয়নে হাতে গোনা কয়েকটি সংগঠন খুব ছোট্ট পরিসরে হলেও মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। বন্ধু সোস্যাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন, সুস্থ জীবন, বাঁধন হিজড়া সংঘ, লাইট হাউস, দিনের আলো ইত্যাদি সংগঠনের নাম কম-বেশি শোনা যায়। এদের কার্যক্রম ততোটা জোড়ালো না হলেও এইডস প্রতিরোধসহ কিছু উন্নয়ন কার্যক্রমে এরা যুক্ত রয়েছে বলে জানা যায়। সেখানে রাষ্ট্রের কোন অনুদান নেই। তাই রাষ্ট্রের কাছে হিজড়াদের প্রধান দাবি আজ, তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি। কেননা এই লিঙ্গস্বীকৃতি না পেলে কোন মানবাধিকার অর্জনের সুযোগই তারা পাবে না বলে অনেকে মনে করেন।

তবে আশার কথা যে, এবারের ভোটার তালিকায় এই প্রথম হিজড়াদেরকে অন্তর্ভূক্ত করার প্রশংসনীয় একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের এই উদ্যোগ বিবেকবান মানুষের সমর্থনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থারও প্রশংসা কুড়িয়েছে। আমরাও এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। তবু প্রায় এক লাখ হিজড়াকে এবারের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্তির ক্ষেত্রে বেশ কিছু জটিলতা এখনো রয়ে গেছে বলে জানা যায়। কেননা তাদেরকে তাদের নিজের পরিচয় হিজড়া হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি বা করা যায়নি। হয়েছে ছেলে বা মেয়ের লিঙ্গ পরিচয়ে, যেখানে যা সুবিধাজনক মনে হয়েছে সেভাবেই। ফলে এতেও হিজড়া হিসেবে সবকিছু থেকে বঞ্চিত এই সম্প্রদায়ের আদতে কোন স্বীকৃতিই মেলেনি। ফলে হিজড়াদের প্রাপ্য অধিকার ও মানুষ হিসেবে পুনর্বাসনের জন্য বিশেষ আইনের দরকার হয়ে পড়েছে আজ, যেখানে যৌক্তিক কারণেই তাদের হোমোসেক্স বা সমকামিতার অধিকার প্রতিষ্ঠাও জরুরি বৈ কি। আর এজন্যেই আজ অনিবার্য হয়ে উঠেছে হিজড়াদেরকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার মানবিক দাবিটাও।

প্রিয় পাঠক, আপনার স্বাভাবিক কর্মব্যস্ততার ফাঁকে হঠাৎ করেই কোন হিজড়ার সাথে দেখা হয়ে গেলে হয়তোবা স্বতঃকৌতুহলি হয়ে ওঠবেন আপনি। এই কৌতুহলের মধ্যে অজান্তেও কোন কৌতুক মেশাবার আগেই একটিবার অন্তত ভেবে দেখবেন কি, এই না-পুরুষ না-স্ত্রী সত্তাটি আপনার আমার মতোই সবক’টি নির্দোষ দৈহিক উপাদান নিয়েই কোন না কোন পারিবারিক আবহে জন্মেছিলো একদিন। মানবিক বোধেও কোন কমতি ছিলো না। কিন্তু প্রকৃতি তাকে দিয়েছে ভয়াবহ বঞ্চনা, যা আপনার আমার যে কারো ক্ষেত্রেই হতে পারতো ! অসহায় পরিবার ত্যাগ করেছে তাকে, অবিবেচক সমাজ করেছে প্রতারণা। নিয়তি করেছে অভিশপ্ত, আর রাষ্ট্র তাকে দেয়নি কোন সম্মান পাবার অধিকার। কোন অপরাধ না করেও ভাগ্য-বিড়ম্বিত সে কি আপনার আমার একটু সহানুভূতি থেকেও বঞ্চিত হবে ?
|তথ্য-কৃতজ্ঞতা: হিজড়া সম্প্রদায় তৃতীয় লিঙ্গ নয় কেন/ঝর্ণা রায়/সাপ্তাহিক ২০০০,বর্ষ১১ সংখ্যা২৭, ১৪ নভেম্বর ২০০৮|
Image: from internet except the top.

[sachalayatan]
[khabor.com]
[mukto-mona]
[somewherein|alternative]
[prothom-alo-blog]

Tuesday, July 28, 2009

# আহা জীবন ভ্রাম্য জীবন...০৭


|ইঁদুর|
রণদীপম বসু

ইঁদুরের বংশ
করে দিন ধ্বংস...!
.
.
যে অদৃশ্য ইঁদুরের দৌরাত্ম্যে ভোগে লোকটি পথে নেমেছে, ইঁদুর নামের কিছু দৃশ্যমান ও ক্ষতিকর প্রাণী ধ্বংস করে অন্যের দিন-যাপনকে আরেকটু নিরুপদ্রব করে দেয়ার জন্য, এসব দৃশ্যমান ইঁদুর হয়তো ধ্বংস হবে ঠিকই।
কিন্তু সেই অদৃশ্য ইঁদুরের দৌরাত্ম্য কি থামবে তাতে...?

[somewherein]

# ওই ছেমড়ি তোর পাছায় কাপড় কই !


| ওই ছেমড়ি তোর পাছায় কাপড় কই !
রণদীপম বসু

সমস্যা হলো পেটে দানা না থাকলেও পাছা বা লজ্জা আমাদের ঢেকে রাখতেই হয়। আমাদের মান সম্মান ইজ্জত ওই পাছার মধ্যেই থাকে কিনা ! তাই ভেতরে সদরঘাট হলেও বাইরে ফিটফাট থাকতে পারতপক্ষে কসুর করি না আমরা। কিন্তু চাইলেই কি ফিটফাট থাকা যায় ? প্রয়োজনীয় খাবার না পেলে আধপেটা কিংবা উপোস চালিয়ে দেয়া গেলেও পাছা অর্ধেকটা কিংবা পুরোটা উন্মুক্ত রাখার কায়দা কি আছে ? প্রকৃতির নিয়ম যে বড়ো উল্টো ! পাছা খোলা রাখো কিবা ঢেকে রাখো, প্রকৃতির কিচ্ছু যায় আসে না। কিন্তু পেটে দানা না দিয়ে সইবে কতো ? প্রকৃতি সয় না তা। শেষ পর্যন্ত প্রকৃতির বশ না হয়ে উপায়ও থাকে না আমাদের। পাছা ঢাকো কি না ঢাকো, পেটের জোগাড় আগেভাগেই করে রাখতে হয়। পেট আর পাছার এই যে সমন্বয়, কারো কারো কাছে তা কোনো বিষয়ই নয়, যাদের আয় উপার্জনে লক্ষ্মীর বর রয়েছে। কিন্তু লক্ষ্মীছাড়া যাদের অনিবার্য ব্যয়ের সাথে আয়ের সংগতি পরিহাসের পর্যায়ে চলে যায়, তাদের পাছায় যে সত্যি সত্যি কাপড় থাকবে সে গ্যারান্টি কে দেবে ?

তবে আশ্বস্তের কথা হলো, এই লক্ষ্মীছাড়ারা কখনো ভদ্রলোক হয় না। তাই তাদের আবার লজ্জা-শরম একটু কমই থাকে। যেভাবে ভদ্রলোকদের লজ্জা থাকে বেশি। আর লজ্জা বেশি বলেই লক্ষ্মীছাড়া মেয়েদের দেখে আমরা ভদ্রলোকেরা সাংঘাতিক লজ্জা পেয়ে বলে ওঠি- ওই ছেমড়ি তোর পাছায় কাপড় কই ! একথা বলি বটে, কিন্তু আমরা যে নিজের পাছা ঢেকে রেখে অন্যের উদোম পাছা দেখে মনে মনে বড়োই আমোদ পাই, এর প্রমাণ আমাদের মাননীয় সচিব কমিটির সুপারিশকৃত এবারের অদ্ভুত পে-স্কেল।

সপ্তম জাতীয় বেতন কমিশনের রিপোর্ট পর্যালোচনার জন্য গঠিত সচিব কমিটির রিপোর্ট ২৭-০৭-২০০৯ তারিখ সোমবার নাকি মন্ত্রীসভায় পেশ করার কথা। মন্ত্রীসভার বৈঠকে সচিব কমিটির সুপারিশ অনুমোদন পেলে পয়লা জুলাই থেকে নতুন বেতন কাঠামো কার্যকর করা হবে। কথা থাকলেও তা পেশ করা হয়েছে কিনা এখন পর্যন্ত তা জানা যাচ্ছে না। লেখাটা যখন লিখছি তখন পর্যন্ত সরকারি কোন ঘোষণাও আমরা পাইনি। তবে পত্র-পত্রিকা থেকে জানতে পারি এবারের পে-স্কেলে সচিব কমিটির সুপারিশে গ্রেড ভিত্তিক বেতন বৃদ্ধির শতকরা হার নাকি অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে দিচ্ছে। অর্থাৎ এই সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে এবার বেতন বাড়বে সবচেয়ে বেশি। ছা-পোষা চাকুরে হিসেবে আমাদের কাছে বড়ই প্রীত হবার মতো খবর বৈ কি। কিন্তু যে রাষ্ট্র দুর্নীতিতে পাঁচ পাঁচবার চ্যাম্পিয়নের রেকর্ড গড়ে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়, সেখানে রেকর্ডের কথা শুনলে পিলেটা তো চমকে ওঠেই, কৌতুহলও বেড়ে যায়। অথচ এমন রেকর্ড সৃষ্টিকারী হয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেও যথাসময়ে যথাস্থানে তা উপস্থাপন হলো না ! কেন ?

কী আছে এই বেতন স্কেলে ?

এই বেতন স্কেলে কী আছে না বলে বোধয় বলা উচিত ছিলো কী নেই এখানে ? তা জানতে হলে নিচের সচিব কমিটির সুপারিশকৃত বেতন-চার্টটা একটু দেখে নেয়া প্রয়োজন।

গ্রেড নং- বর্তমান মূল বেতন- প্রস্তাবিত মূল বেতন- বৃদ্ধির পরিমাণ- বৃদ্ধির হার

১------ ২৩,০০০/- ----- ৪০,০০০/- ------- ১৭,০০০/- -- ৭৪%
২------ ১৯,০০০/- ----- ৩৩,৫০০/- ------- ১৪,২০০/- -- ৭৪%
৩------ ১৬,৮০০/- ----- ২৯,০০০/- ------- ১২,২০০/- -- ৭৩%
৪------ ১৫,০০০/- ----- ২৫,৭৫০/- -------- ১০,৭৫০/- -- ৭২%
৫------ ১৩,৭৫০/- ----- ২২,২৫০/- ------- ৮,৫০০/- --- ৬২%
৬------ ১১,০০০/- ----- ১৮,৫০০/- ------- ৭,৫০০/- --- ৬৮%
৭------ ৯,০০০/- ------ ১৫,০০০/- ------- ৬,০০০/- --- ৬৭%
৮------ ৭,৪০০/- ------ ১২,০০০/- ------- ৪,৬০০/- --- ৬২%
৯------ ৬,৮০০/- ------ ১১,০০০/- ------- ৪,২০০/- --- ৬২%
১০----- ৫,১০০/- ------ ৮,০০০/- -------- ২,৯০০/- --- ৫৬%
১১----- ৪,১০০/- ------ ৬,৪০০/- --------- ২,৩০০/- --- ৫৬%
১২----- ৩,৭০০/- ------ ৫,৯০০/- --------- ২,২০০/- --- ৫৯%
১৩----- ৩,৫০০/- ------ ৫,৫০০/- --------- ২,০০০/- --- ৫৭%
১৪----- ৩,৩০০/- ------ ৫,২০০/- --------- ১,৯০০/- --- ৫৭%
১৫----- ৩,১০০/- ------ ৪,৯০০/- --------- ১,৮০০/- --- ৫৮%
১৬----- ৩,০০০/- ------ ৪,৭০০/- --------- ১,৭০০/- --- ৫৭%
১৭----- ২,৮৫০/- ------ ৪,৫০০/- --------- ১,৬৫০/- --- ৫৮%
১৮----- ২,৬০০/- ------ ৪,৪০০/- --------- ১,৮০০/- --- ৬৯%
১৯----- ২,৫০০/- ------ ৪,২৫০/- --------- ১,৭৫০/- ---- ৭০%
২০----- ২,৪০০/- ------ ৪,১০০/- --------- ১,৭০০/- ---- ৭০%

এখানে যে বিষয়টা খেয়াল রাখতে হবে, বর্তমান বেতন স্কেলের সাথে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঘোষিত অতিরিক্ত ২০% মহার্ঘ ভাতাটি কিন্তু প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো কার্য়করের সাথে সাথে বাতিল হয়ে যাবে। রেকর্ড ভঙ্গকারী এই বেতন তালিকার সাপেক্ষে বর্তমানে ৫০% থেকে ৭০% জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির হারের কথা নাই আনলাম। তা বিশ্লেষণ করার জন্য দেশে বহু অর্থনীতিবিদ ও সমাজ-বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। সেক্ষেত্রে ৪ সদস্যের একটা পরিবারের ব্যয় বিবেচনা করে প্রস্তাবিত এই বেতন কাঠামো দিয়ে ১০ম থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীরা বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে কী করে একটা পরিবার চালাতে পারেন তা পাঠকরাই বিশ্লেষণ করুন। আমার বক্তব্য ভিন্ন, এই সুপারিশের নৈতিকতা নিয়ে।

পাঠক হয়তো খেয়াল করে থাকবেন, প্রথম চারটি গ্রেডের কর্মকর্তারা বাড়ি গাড়ি টেলিফোন ইত্যাদি ইত্যাদি সকল রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ করে থাকেন। অথচ তাঁদের জন্যই বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে সর্বোচ্চ ৭৪%। যাঁরা এই বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ করেছেন সেই মহামান্য সচিবরা নিজেদের জন্য বেতন বৃদ্ধির পরিমাণ ও হার সর্বোচ্চ রেখে গাছের আগা ও মাঝখানটা নিজেদের ভাগে নিতে কার্পণ্য করেননি একটুও। কেননা তাঁরা যে অতি উচ্চ দরের ভদ্রলোক। ভদ্রলোকদের লজ্জা-শরম তো একটু বেশিই থাকে। আর এই বেশি পরিমাণের লাজলজ্জা ঢাকতে সবকিছুই তো বেশি বেশি লাগার কথা ! অন্যদিকে সেবা করার মহান ব্রত নিয়ে গাছের গোঁড়াটুকু থাকবে নিচের স্তরের সেইসব কর্মচারীদের ভাগে, যাদের লাজ লজ্জা আবার এমনিতেই কম। অতএব তাদের পাছা উদোম থাকলেও সমস্যার তো কিছু নেই !

নৈতিকতা শব্দটি মনে হয় একটা বিমূর্ত ধারণা মাত্র। নইলে নৈতিকতাবোধের কতোটা অবনমন ঘটলে এরকম একটা বেতন-স্কেলের সুপারিশ করেন আমাদের মহামান্য সচিবরা, ভাবলেই অবাক হতে হয় ! তাঁদেরকে কি এই তালিকার ডান পাশের বেতন বৃদ্ধির হারের কলামটা কোন সংবেদনাই জাগাতে পারে নি ! পেটের কথা ভাবতে গেলে যাদের পাছা ঢাকার কাপড় থাকে না, সেই সব কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির হার ৫৬-৫৭% নির্ধারণ করতে একটুও লজ্জা হয় নি কর্ম ও সেবার মাহাত্ম্য বর্ণনাকারী এই সচিব মহোদয়দের ! নিজেরা এতো সুবিধা পাওয়ার পরও নিজেদের বেতন বৃদ্ধির হার কিছুটা কম রেখে নিচের দিকে পর্যাক্রমে একটু একটু হার বাড়িয়ে দেবার মুরব্বি-সুলভ উদারতা দেখাতে নাইবা পারলেন তাঁরা। অন্তত বৃদ্ধির হার সবার জন্য ৭৪% এক ও অভিন্ন রাখলেও কি তাঁদের ভাগে প্রাপ্তির পরিমাণ কোন অংশে কম পড়তো ? অন্তত চক্ষুলজ্জা বলেও তো একটা কথা থাকে ! রাষ্ট্র কতো হাজার হাজার কোটি টাকা কতো খাতে খরচ করে। কিন্তু বিশাল কর্মী বাহিনী যারা সরকারের সব কর্মসূচি-কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের জন্য নিজেদের দেহ যৌবন খরচ করে ফেলে, তাদের জন্য রাষ্ট্র কি এতোটাই অনুদার ! রবীন্দ্রনাথ হয়তো এজন্যেই আক্ষেপ করেছিলেন- রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি !

অভিজ্ঞ বিশ্লেষকরা হয়তো বলতে পারবেন নতুন এই বেতন কাঠামো কার্যকর হলে সেই সব পাছা-খোলা কর্মচারীদের প্রকৃত বেতন বৃদ্ধি কতো হবে, কিংবা ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকার বেশি হবে কিনা। অথবা ১০ম গ্রেডের নমুনা উদাহরণ টেনে হিসেব কষে বের করবেন, নতুন বেতন কাঠামোয় বেতন বৃদ্ধির বদলে বেতন হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কাটা সত্যিই অমূলক কিনা। অথচ নতুন স্কেলে লক্ষ্মীর আশির্বাদপ্রাপ্ত সেইসব কর্মকর্তাদের গাড়ি ক্রয়ের জন্য সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, সাথে মেইনটেন্যান্স খরচ তো রাষ্ট্রই দেবে। এবং তার পরিমাণও সম্ভবত মাসে ৩৫,০০০ টাকা। দয়ার শরীর তাঁদের। তাই হয়তো কর্মচারীদের জন্য অত্যন্ত দয়াপরবশ হয়ে তাঁরা যাতায়াত ভাতার প্রস্তাব করে ফেলেছেন মাসিক ১৫০ টাকা।

রাষ্ট্রের বর্তমান গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সরকার বিষয়টাকে কিভাবে দেখছেন কে জানে। ভিশন ২০২১ কে প্রকৃতই সফল ও কার্যকর করে তুলতে এর প্রস্তুতি দৌঁড়ে জাতীয় বেতন স্কেলের কোন গুরুত্ব তাঁরা আদৌ অনুধাবন করেন কিনা সে প্রশ্নটা উহ্যই থাক। সরকারের দায়িত্ববান মন্ত্রী-এমপিদের কথাও কী আর বলবো ! দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তাঁরা যদি এই বিশেষ জ্ঞানটুকু রপ্ত করে ফেলেন যে, কেবল শীর্ষলেভেলে যত্ন-আত্তি করে কয়েকজন স্বাস্থ্যবান হাতি পুষলেই সরকার ব্যবস্থা চেলচেলাইয়া চলতে থাকে, তাঁদের সেই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা তাঁদেরই থাকুক। মূর্খ আমরা অনভিজ্ঞ বিবেচনা দিয়ে ভাবি, সচিব কমিটির প্রস্তাবিত সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত যখন ১ ঃ ১০ হয়ে যায়, নিশ্চয়ই তাঁদের খাওয়া পরা চলা সবই দশগুণ বেশিই হবে। এমনকি তাঁদের লজ্জাটাও নিশ্চয়ই দশগুণ বড়ই। এবং তা ঢাকার আয়োজনও দশগুণ বেশিই হতে হবে।

কিন্তু দুর্মুখেরাও যে তা দশগুণ ভিন্ন চোখেই দেখবে ! যে লজ্জা ঢাকতে দশগুণ বেশি আয়োজন করতে হয়, সে লজ্জা কি আদৌ ঢাকা পড়ে ? না কি লজ্জাটা অত্যন্ত লজ্জাকরভাবেই দশগুণ বেগে চিহ্ণিত হয়ে যায়, এর জবাব কে দেবে ? কাউকে কি দোষ দেয়া যাবে, সচিব মহোদয়দের এমন নির্লজ্জ আয়োজন দেখে যদি সত্যি সত্যি জানতে চায় কেউ- ওই ছেমড়ি তোর পাছায় কাপড় কই ?

[sachalayatan]

Thursday, July 23, 2009

# ‘কিংবদন্তী’


‘কিংবদন্তী’
রণদীপম বসু

“ আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল
তাঁর পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত ছিল।”


কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ’র ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ শিরোনামের বিখ্যাত এ অমর কবিতাটা পড়েননি বা এর কিছু পঙক্তি শুনেননি এমন বয়স্ক শিক্ষিত বাঙালি খুব বেশি নেই। বাঙালির ইতিহাস এই কিংবদন্তীরই ইতিহাস। এভাবেই আরেক কিংবদন্তী হয়ে ওঠা আমাদের প্রিয় মুক্তিযোদ্ধাদেরকে যেন আগামী প্রজন্ম কখনোই ভুলে না যায়, সেই অদম্য ইচ্ছের স্বপ্নই ঝরে পড়ে ভাস্কর হামিদুজ্জামান খানের গড়া ভাস্কর্য ‘কিংবদন্তী’র ঝকঝকে ধাতব শরীরে।


মিরপুর-১ এর সনি সিনেমা হলের সামনের গোল চক্করের প্রশস্ত সড়ক-দ্বীপে বসানো এই ভাস্কর্যটির শরীরে তখনো নীল পর্দায় মোড়ানো বিশাল অবগুণ্ঠন। ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান ও স্পন্সর প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভারের পদস্থ প্রতিনিধি সহ অন্যান্যদের হাতের টান পড়তেই খুলে গেলো ইচ্ছের গ্রন্থি। আজ ২৩-০৭-২০০৯ তারিখের অপরাহ্ণ ছ’টায় মেঘলা ছায়ার ফাঁকে বিকেলের সোনামাখা আলোয় ঝলমল করে উন্মোচিত হলো শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য ‘কিংবদন্তী’।


অস্ত্র হাতে অদম্য যোদ্ধার দেহাকৃতির এই ‘কিংবদন্তী’র কাছে গেলে আমাদের সেইসব কিংবদন্তী পুর্বপুরুষের কথা মনে না হয়েই যায় না ! কেননা তাঁরা চাইলে বুঝি অবাধ্য থাবায় ওই আকাশটাও নিয়ে নিতেন হাতের মুঠোয়। আর তাঁদেরই উত্তরাধিকার বয়ে আমরা কী করে গুটিয়ে থাকি ! আমাদের বুকের গভীরে যে নদীটা কুলকুল করে বয়ে যায়, কান পাতলে এখনো কি শুনতে পাই না সেই অজেয় বীরত্বের গাঁথা ! হার না মানার চিরায়ত সুর আর মাটির ক্রন্দন !


বুক ভরা নিঃশ্বাসে ঠিকই এখনো পাওয়া যায় করতলে ধরে রাখা পলিমাটির সৌরভ। আসুন, আমরা সেই কিংবদন্তীর কথা বলি, আমাদের পূর্বপুরুষের কথা বলি। কারণ তাঁদের পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত ছিলো। আমাদের দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে দিয়ে গেলেও তাঁরা যে ক্রিতদাস ছিলেন !





[somewherein|jonmojuddho]
[sachalayatan]

Wednesday, July 22, 2009

# আর ভিক্ষা করুম না, কানে ধরছি !


আর ভিক্ষা করুম না, কানে ধরছি !
রণদীপম বসু

কিছু কিছু ছবির কোন ক্যাপশান হয় না, হওয়া উচিত না। তবু বাঙড়ামি করে ক্যাপশান বসিয়ে দেই আমরা।
এ ছবিটার কি কোন ক্যাপশান হয়...! কিংবা নিচের এই ছবিটার...!


আপনারা কী বলেন ?

[somewherein]

# দেখুন তো, চিনতে পারেন কিনা ?


। দেখুন তো, চিনতে পারেন কিনা ?
রণদীপম বসু

ছবির বস্তুটাকে আপনি কি নারিকেল ভাবছেন ? নিশ্চিত থাকুন, এগুলো নারিকেল নয়। তবে তা যে-গাছের ফল বা বীজ, আমাদের অত্যন্ত পরিচিত সে গাছটাকে উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক শ্রেণীকরণে একে তৃণগোত্রের উদ্ভিদ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও গাছটির আকার আকৃতি বা উচ্চতা বিবেচনায় নিলে আমাদের অনভিজ্ঞ বিস্ময়ের সীমা থাকে না !


বীজই বলুন আর ফলই বলুন, চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরে নাকি এই বীজ একবারই ধরে। তাও যদি গাছটাকে সেই বয়েস পর্যন্ত জীবিত রাখি আমরা। সমস্যা হচ্ছে গাছটির ব্যবহারিক প্রয়োজনের সাথে পাল্লা দিয়ে এতগুলো বছর দুধ-কলা খাইয়ে এই গাছ পোষার মতো ধৈর্য্য বা ইচ্ছা কোনোটাই মানুষের থাকে না। ফলে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছাড়া এই বীজ দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য খুব নগন্য মানুষেরই হয়।


ক'দিন আগে শেষ হওয়া ঢাকা বৃক্ষমেলা থেকে আমার এক বন্ধু এই বীজ দুটো কিনে আনেন। এমন কৌতুহল উদ্দীপক কাহিনী শুনে কার না ইচ্ছে হবে ওগুলোকে ফটোফ্রেমে বেঁধে রাখার ! মোবাইল ক্যামেরাটা তাক করে আমিও খিচে দিলাম।


যাঁরা চিনেন, তাঁরা তো চিনেনই। যাঁরা চিনেন না, সুযোগে চিনে রাখুন। এগুলো হচ্ছে ব্যাম্বো সীডস বা বাঁশের বীজ। তাও যে সে বাঁশ নয়, হালকা পাতলা নিরীহ মুলিবাঁশ !
[সবার নিচের ছবিটা নেয়া হয়েছে এখান থেকে।]

[somewherein]

Friday, July 17, 2009

# লোকটা নাকি পাগল ছিলো...!


লোকটা নাকি পাগল ছিলো...!
রণদীপম বসু

টোনা কহিলো- টুনি পিঠা করো। টুনি কহিলো- চাল আনো, তেল আনো, নুন আনো, গুড় আনো ইত্যাদি ইত্যাদি। টোনা কহিলো- ঠিক আছে, আমি যাইতেছি, তুমি রান্নার বুঝ-ব্যবস্থা করো। এইভাবে টুনি ঘরের কাজে আটকা পড়িলো। আর টোনা ফুড়ুৎ কইরা উড়াল দিয়া গেলোগা। এবং অন্য আরেক টুনির সঙ্গে পুটুর-পাটুর করিতে লাগিলো।
এই গল্প থেকে থেকে আমরা কী শিক্ষা পাই ? শিক্ষা পাই- ছাগল দুই ধরনের। দেশি ছাগল আর রাম-ছাগল। দেশি ছাগল হইলো ব্ল্যাক বেঙ্গল। কান দুইটা ছোট ছোট। আর রামছাগল ? কান দুইটা এই লম্বা লম্বা ! বদমাইশি কইরা কইরা জীবনে বহুৎ কানমলা খাইছে তো, শরীরটা মাশাল্লা হৃষ্টপুষ্ট হইছে ! কিন্তু কানগুলা আমার চ্যাঙ্গের মতো ঝুইল্যা গেছে !

কী বুঝলি ?

আমার প্রথম কৈশোরের অভিজ্ঞতা তখনো এতো হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে নি। লোকটির সঙ্গতিহীন কথা আর আচানক ধরনের শব্দগুলোর অর্থ খুঁজতে খুঁজতে আমার অনভ্যস্ত কান দুটো গরম আর সম্ভবত লাল হয়ে ওঠছে। অতএব আমি আর কী বুঝবো !
আমাকে নিরুত্তর দেখে ফের প্রশ্ন- কিছুই বুঝস নাই ?
হ, বুঝছি !
কী বুঝছস ?
আপনি একটা পাগল !

উত্তর শুনে কটমট করে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। আমি ইতস্ততবোধ করছি। হঠাৎ হৈ হৈ করে ওঠলেন- তুই তো বড়ো সত্যিবাদী পোলা রে !
বলেই হেঁচকা টানে নিজের লুঙ্গিটা খুলে ফেললেন। আচম্বিতে এই অভুতপূর্ব ঘটনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি আতঙ্কিত নাক মুখ কুঁকড়ে অজান্তেই চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেলো। লাঞ্চিত হবার সমূহ আশঙ্কা সত্য হয় নাই দেখে আশ্বস্ত হলাম ঠিকই। কিন্তু এই বিব্রতকর অবস্থা কিভাবে সামাল দেবো ভাবতে ভাবতে কুচকানো বন্ধ চোখ দুটো আস্তে একটু একটু করে খুলতে লাগলাম। ধুয়াশা নজরে দেখছি সামনেটা ফাঁকা, কেউ নেই ! ঝট করে পুরো চোখ খুললাম।

লুঙ্গিটাকে কপালে বেঁধে রাস্তার রাজা শাহেনশাহের মতো নির্বিকার তিনি উন্মুক্ত নিম্নাঙ্গে ফুটপাত ধরে হেঁটে চলেছেন ! আমি একইসাথে বিস্মিত, বিব্রত এবং মনে মনে কুঞ্চিতও ! আশ্চর্যের ব্যাপার ! আশপাশ দিয়ে আনমনা পথচারী নারী-পুরুষগুলো আচমকা এমন এক দৃশ্যের মুখোমুখি হয়েও কেন যেন একটু না চমকিয়েই নির্দ্বিধায় পার হয়ে যাচ্ছে সবাই ! কেউ কেউ আবার লোকটির বিশেষ কোন জায়গায় হ্যাংলার মতো দৃষ্টি ফেলে অনায়াসে কৌতুক করতেও ছাড়ছে না !

একটু একটু করে অভিজ্ঞতায় পুষ্ট হতে হতে আমাদের বোকা কৈশোরটা তারুণ্য কিংবা যৌবন পেরিয়ে যেতে যেতে অবাক হবার ক্ষমতাটা হয়তো হারিয়েই ফেলে ! তবু মানুষের বুকে কোন কোন কৈশোর বোধ করি চিরকাল থেকে যায়। অন্য অনেক ঘটনার মতোই কৈশোরের ওই ঘটনাটা আমাকে কতোটা প্রভাবিত করেছে জানি না। তবে মন-ভুলে সেই কথাটা কখনো মনে এলেই একটা প্রশ্ন এখনো আমাকে তাড়া করে-
লোকটা কি সত্যিই পাগল ছিলো ?
একটা শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে লোকটা নিজেই নাকি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মরে যায় একদিন।

[sachalayatan]
[somewherein|alternative]

# [রম্যগল্প]...লিঙ্গান্তর...


লিঙ্গান্তর...
রণদীপম বসু

(০১)
হঠাৎ করিয়া একখান গায়েবী আওয়াজ হইলো- ‘ হে প্রাণীগণ, সৃষ্টির পুনর্বিন্যাসকাল আসন্ন। এবার প্রস্তুত হও। অনতিবিলম্বে তোমাদের মধ্যে পরস্পর লিঙ্গ পরিবর্তন করিয়া দেওয়া হইবে।’

চিরিং করিয়া উঠিয়া বসিলো আক্কাছ। অজান্তেই বাম হাতখানা অভ্যাসবশত তলপেট বাহিয়া নিচে নামিতে লাগিলো। এইটা কী শুনিলো ! বৈচিত্র্যহীন ছুটির দিনের মধ্যাহ্ণভোজ সারিয়া ক্রমে ক্রমে গরম হইয়া ওঠা মাথাটাকে নতুন কভার লাগানো বালিশখানায় ভালো করিয়া রাখিতেও পারিলো না, ওই পাশের ঘর হইতে স্ত্রী খালিজা বানু ওরফে কলিজা বেগমের হম্বিতম্বিটাও পুরাদমে শুনা যাইতেছে, আচমকা এই গায়েবী ঘোষণা ! এইটা কী করিয়া সম্ভব ! পুরুষগুলা সব নারী হইয়া নারীগুলি পুরুষ হইয়া যাবে ! নাহ্, সে ভুল শুনিয়াছে !

কিন্তু সে যে ভুলই শুনিয়াছে, এইটা ভাবিয়া নিশ্চিন্ত হইবার সুযোগ কোথায় ! তার আগেই লাফাইতে লাফাইতে কলিজা বেগম আসিয়া উপস্থিত- ‘ শুনতে পাইছো কিছু ?’ উল্লাসে লাল হইয়া ওঠা কলিজা বেগমের ভয়ঙ্কর মুখখানার দিকে ততোধিক আতঙ্ক লইয়া আক্কাছ রেহান ওরফে আক্কু রায়হান নির্নিমেষ চাহিয়াই রহিলো। ‘বহুৎ তেল হইছে তোমার, এইবার বুঝবা ! ডলা খাইলে জমাইন্যা তেল সব কেমনে বাইয়া বাইয়া পড়ে !’ কথার শেষে চুঁ চুঁ করিতে করিতে উৎফুল্ল কলিজা বেগম নাচিয়া নাচিয়া বাহির হইয়া গেলো।

‘ বেটা মিনষেগুলা বউৎ বাইড়া গেছে খালাম্মা ! এইবার এমন চিপা দিমু, খালি বাপ বাপ করবো !...’ কাজের বুয়া কদমির মা’র ঝাঁঝালো গলাটা অতি উচ্চমার্গে উঠিবার আগেই তাকে থামাইয়া দিয়া কলিজা বেগমের মিষ্টি-মধুর শাসানির শব্দ শুনা গেলো- ‘ চুপ করো তুমি ! আর শুনো, কাইল থাইকা তো তুমি আর বাসার কামে আইতে পারবা না ! এরপর থাইকা তোমার অই বাদাইম্যা পোলাটা কী জানি নাম, হ, অই কদমরেই পাঠাইয়া দিয়ো।’

অনতিবিলম্বে যাহা ঘটিতে যাইতেছে, তাহার ফলাফল কোথায় গিয়া দাঁড়াইবে, আর কাহিনী যে কী হইতে যাইতেছে, তাহা আগাম কল্পনা করিয়া আক্কাছ শিউড়িয়া উঠিলো। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের দ্রুতি বাড়িয়া বুকখানা দ্রুত উঠানামা করিতে লাগিলো। তখনি হঠাৎ করিয়া সন্দেহ হইলো- বুকটা কি কিঞ্চিৎ উঁচু উঁচু লাগিতেছে না ! নিশ্চিত হইবার জন্য বাম হাতখানা পুনরায় নড়িয়া চড়িয়া উঠিলো। এবং তখুনি সেই সোহাগী ডাকে চমকাইয়া উঠিলো- “ আক্কুউউউউউ.....!” অর্থাৎ আবারো কলিজা বেগম। “ আমার আক্কু বেগঅঅঅম...।” নামের লিঙ্গান্তরিত সম্বোধন শুনিয়া আচমকা মাথায় আগুন ধরিয়া গেলো ! এক্ষুনি ইহার একটা বিহিত করিবার নিমিত্তে চিৎকার করিতে গিয়াও শেষপর্যন্ত করা হইলো না। বুকের ভিতরে কোথায় যেন একটা তীক্ষ্ণ ব্যথা মোচড় দিয়া উঠিলো। আর কীইবা বিহিত করিবে সে ! এখন আর তাহার যে কিছুই করিবার নাই। পরিস্থিতি পুরা পাল্টাইয়া যাইতেছে ! তবে এই আপত্তিকর সম্বোধনের হেতু বুঝিতেও দেরি হইলো না। “ তোমার অই লাফাঙ্গা ইয়ারটা, গাবলু না লাবলু, অইটারে যে দেখি না আইজ কাইল ! তারেও এইবার আইতে কইয়ো ! মাইয়া হইলে তারে যা খাসা লাগবো না ! উফ !...” হাওয়ার মধ্যে এক অনির্বচনীয় তৃপ্তির শীৎকার ছাড়িয়া কলিজা বেগম ভাসিতে ভাসিতে পুনরায় চলিয়া গেলো।

দরদর করিয়া আক্কাছের ঘাম বাহির হইতে লাগিলো। আর দমকাইয়া দমকাইয়া আফসোসগুলিও ছলকাইয়া উঠিলো, আহা, কী কুক্ষণেই না এই মায়াদয়াহীন খান্নাছ মাইয়ালোকটার চক্করে সে পা দিয়াছিলো ! পুরুষ মানুষের একটু আধটু এইদিক সেইদিক যাইবার অভ্যাস থাকিতেই পারে ! তাহা না হইলে পুরুষ হইলো কী করিয়া ! অন্যথায় এই স্বামী পরিত্যক্তা কলিজা বেগমই বা আক্কু রায়হানের ঘরে আসিতো কিভাবে ! সেইদিন যদি এলাকার লোকজন তারল্যে বুদ হইয়া থাকা আক্কাছকে কলিজা বেগমের ঘরে হাতেনাতে ধরিয়া ফেলিয়া জোর করিয়া তাৎক্ষণিক বিবাহ করাইয়া না দিতো, কোথায় থাকিতো এই কলিজা বেগম ? দ্বিতীয় বিবাহের বোঝা ঘাড়ে লইয়া ঘরে আসিতে না আসিতে অরিজিনাল স্ত্রীটাও কিনা এক কথার উপর উল্টা তালাক দিয়া বাচ্চাটাকে হাতে ধরিয়া বাপের বাড়ি চলিয়া গেলো ! থলথলে কয়েক মণ মাংস লইয়া এই কলিজা বেগম কী করিয়া বুঝিবে যে, সেই দুঃখ ভুলিয়া থাকিতেই আক্কাছ ওরফে আক্কু রায়হানের পুরুষ শরীরটা এখনো মাঝে মাঝে একটু আধটু এইদিক ওইদিক চলিয়া যায় !

চরিত্রে কিঞ্চিৎ তারল্য আসিলেও ধর্মেকর্মে আক্কাছের বিশ্বাস বা মতিগতি এখনও শেষ হইয়া যায় নাই। তদুপরি এই গায়েবি বাণীকেই বা অবিশ্বাস করিবে কী দিয়া ! কোথায় যেনো পড়িয়াছিলো সে, বাহ্যিক পরিবর্তন হইবার আগেই মানুষের আভ্যন্তরীণ পরিবর্তন শুরু হইয়া যায়। কলিজা বেগমের ভাবভঙ্গিতে যে সেই আলামতই স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে, তাহা তো আক্কাছ হাড়ে হাড়ে টের পাইতে শুরু করিয়াছে !

সদ্য রূপান্তরিত আক্কাছের তন্বী শরীরটার দিকে ষণ্ডাপুরুষদেহী বীভৎস কলিজা বেগম যেইভাবে অশ্লীল আগ্রাসী লোলায়িত ভঙ্গিতে আগাইয়া আসিতে লাগিলো, দেখিয়াই তন্বী দেহখানা তাহার থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিলো। চক্ষু মুদিলেই ভবিষ্যৎ পরিণতির এইরকম ভয়ঙ্কর দৃশ্য ভাসিয়া উঠিলে আক্কাছের আর স্থির হইয়া চক্ষু বুজিবার উপায় রহিলো না। ভূমিকম্প হইবার প্রাক্কালে প্রকৃতির মধ্যে যেইরূপ অস্থিরতা শুরু হইয়া যায়, পাখিরা ইহাদের গাছ-গাছালির আশ্রয় ছাড়িয়া উদ্দেশ্যহীন কিচির-মিচির করিতে করিতে অস্থির হইয়া যায়, বাহিরেও সেইরকম কোলাহল শুনা যাইতে লাগিলো। এবং সেই সঙ্গে আক্কাছকেও বুঝি অস্থির রকমের অস্থিরতায় পাইয়া বসিলো। এতোকালের দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রাভ্যাসখানিও তাহাকে এই জনমের মতো ছাড়িয়া গেলো, ইহাতে আর সন্দেহ রহিলো না। কিছুই ভালো লাগিতেছে না। শরীরখানাকে এইদিক ওইদিক বারকয়েক মোচরাইয়াও কোন লাভ হইলো না। অনতিবিলম্বে যে অসহনীয় অপমানের মুখাপেক্ষি হইতে হইবে তাহা ভাবিয়া হঠাৎ করিয়া আক্কাছের মরিয়া যাইবার ইচ্ছাটা জাগিয়া উঠিলো। এবং তৎক্ষণাৎ আর কিছু না ভাবিয়া শরীরে জামা-কাপড় চাপাইয়া ঝটপট ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলো।

(০২)
মরিবার জায়গারও কি এইরকম অভাব পড়িয়া গেলো ! মরিবার জন্য উপযুক্ত জায়গা খোঁজাও যে এতো বেশি কষ্টের কাজ তাহা আগে কখনোই বুঝিতে পারে নাই আক্কাছ। প্রতিদিন যত্রতত্র কতো মৃত্যুর সংবাদ পড়িয়াছে পত্র-পত্রিকায়। এইসব বালখিল্য কর্মকাণ্ডের ঘোর বিরোধীও ছিলো সে। কিন্তু আজ সেইসব ঘাটে-আঘাটে অকাতরে মৃত্যুপ্রাপ্তদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ জাগিয়া উঠিলো তাহার- সত্যি তো, কতো সাধ্য-সাধনা করিয়াই না তাহাদেরকে এই কাজে সফল হইতে হইয়াছে ! অবিশ্রান্ত হাঁটিয়া হাঁটিয়া শেষে শ্রান্ত ক্লান্ত হইয়া ফুটপাতের মধ্যেই বসিয়া পড়িলো আক্কাছ। শরীর আর টানিতেছে না। একটা রিক্সাও চোখে পড়িলো না। পড়িবে কী করিয়া ! প্যাডেলের উপর শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি যেটুকু উদ্যমের প্রণোদনা মিশাইলে শক্তি কর্মক্ষম হইয়া উঠে, তাহাই যে অনুপস্থিত। অতএব রিক্সা চালাইবে কে !

স্ত্রীর পৃষ্ঠের উপর চেলাকাঠ ভাঙিয়া যেইসব পুরুষকূল এতোকাল মরদবাজী দেখাইয়াছে, উহাদের অবস্থা আরও শোচনীয় দেখাইতেছে। আগাম ইঙ্গিত অনুভব করিয়াই কিনা উহারা রীতিমতো বিমর্ষ হইয়া পড়িয়াছে। তবুও শহর জুড়িয়া অস্থিরতা। কিন্তু কোথাও কোন উদ্যমের লেশমাত্র নাই। এই শেষ বিকালেও দোকানগুলির অধিকাংশেরই ঝাঁপ নামাইয়া ফেলা। দুই একটা যাওবা খোলা রহিয়াছে, ক্রেতাহীন বিক্রেতার ফ্যাকাসে মুখখানা হাতের চেটোর উপর ঠেশ দিয়া রাখা। রাজ্যের হতাশা ধারণ করিয়া অনিবার্য পরিণতির অপেক্ষায় বলীর পাঁঠার মতো নিশ্চুপ হইয়া আছে। এদিকে পুলিশী বরাদ্দের চাঁদা তুলিতে নির্ধারিত কেউ না আসিলেও ফুটপাতের ভ্রাম্যমান দোকানগুলিতে প্রাণের কোন স্পন্দন নজরে আসিতেছে না। রাস্তায় রাস্তায় মোড়ে মোড়ে যানজটের পরিবর্তে মানুষের জটই চোখে পড়িতেছে বেশি। কে কাহার উপর হুমড়ি খাইয়া পড়িতেছে, কে কাহাকে কিভাবে গুঁতো মারিতেছে এইসবে এখন আর কাহারও ভ্রক্ষেপই নাই। কে কাহার সঙ্গে কোথায় কিভাবে যাইতেছে কিংবা যাইবে সেইরকম তাড়া কিংবা কৌতুহলও নজর হইতেছে না। যেনবা মৃতদের মিছিল !

এইসব দৃশ্য পরিদৃশ্য প্রত্যক্ষ করিয়া আক্কাছ আরো বেশি মুষড়াইয়া পড়িলো। কতকাল আগে বাপ-মা মরিয়া গেলেও যেই অনুভূতি কখনো হৃদয়ঙ্গম করে নাই, আজ তাহার নিজেকে বড়োই এতিম মনে হইতে লাগিলো। সে এখন কী করিবে কোথায় যাইবে কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছে না। কোন পার্ক-টার্কে গেলে কেমন হইতো ! কিন্তু সেই উপায়ও নাই। শহরের কোন শৃঙ্খলাই আর অবশিষ্ট নাই। একেবারে দুমড়াইয়া মোচড়াইয়া সবকিছু এলোমেলো হইয়া গিয়াছে যেন। হঠাৎ আক্কাছকে খুব আতঙ্কে পাইয়া বসিলো। মরিতে তো পারিলোই না, এখন কি এই রাস্তার মধ্যেই পড়িয়া থাকিতে হইবে ! কোনরূপ সিদ্ধান্তে আসিবার আগেই একসাথে কতকগুলি হাসির শব্দে চমকাইয়া উঠিলো।

কতক মেয়েছেলে তাহাকে ঘিরিয়া ধরিয়াছে। কিন্তু মেয়েছেলেগুলোর চেহারায় রমণীসুলভ কমনীয়তার কোন ছোঁয়া আছে বলিয়া মনে হইলো না। তাহার বদলে কী রকম পুরুষালী ভাব প্রকট হইয়া উঠিতেছে। প্রথম দৃষ্টিতে হিজড়া বলিয়াই ভ্রম হয়। এদিক সেদিক তাকাইয়া খেয়াল করিলো সে, আরো যেসব মেয়েছেলেরা একটু বেশিরকমভাবেই রাস্তায় আসা-যাওয়া করিতেছে, সবার মধ্যেই এইরকমের পুরুষালী ভাব প্রকাশ পাইতেছে এবং তাহাদের চলনে-বলনেও লজ্জাশীলা কোমলতার জায়গায় ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষিত হইতেছে। ঘিরিয়া ধরা মেয়েছেলেগুলির একজন তো তাহার উদ্দেশ্যে ফিস করিয়া মুখে শিষ দিয়া বসিলো ! ডোন্ট-কেয়ার ভাবের আরেকজন আক্কাছের চোখে চোখ মারিয়া নিজের ঠোঁটগুলি যেইভাবে চাটিতে লাগিলো, তাহাতে অবস্থা খুব সুবিধার মনে হইলো না ! এবং তখনি তাহার তলপেটে তীব্র একটা ব্যথা চাগাইয়া উঠিতে লাগিলো। হায় আল্লাহ্, সময় কি তাহলে আসিয়া পড়িলো ! ব্যথার সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে কী রকমের একটা অনুভূতিও জাগিয়া উঠিতেছে !

নিরূপায় আক্কাছের কী মনে হইলো কে জানে ! এই ঘোর সন্ধ্যাবেলায় শহরের একটা বিশৃঙ্খল রাস্তায় বেঘোরে ছিঁড়াফাড়া হইবার জন্য নিজেকে বিলাইয়া দেওয়ার চাইতে চক্ষের বিষ হইলেও কলিজা বেগমকেই শ্রেয় মনে হইতে লাগিলো। সময় দ্রুত ফুরাইয়া যাইতেছে ! ইহা ভাবিতেই ঝটকা মারিয়া দাঁড়াইয়া গেলো সে এবং উহাদের বেষ্টনি মারাইয়া পড়ি কি মরি হইয়া উর্ধ্বশ্বাসে দৌঁড়াইতে লাগিলো। পিছন হইতে উহারাও বুঝি তাড়া করিলো। ক্রমশই নিকটবর্তী হইতে থাকা পায়ের শব্দে আক্কাছ তাহার নিজের গতি আরও বাড়াইয়া দিতেই কিসের উপর যেন হুমড়ি খাইয়া পড়িয়া গেলো।

(০৩)
বেলা দ্বিপ্রহরে লোডশেডিং-এর সিদ্ধ গরমে ঘুমের মধ্যেই পাশে শায়িত স্ত্রী কলিজা বেগমের সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করিয়াছিলো কিনা ঠাহর করিতে পারিলো না। কিভাবে যেন খাট হইতে ছিটকাইয়া মেঝেতে পড়িয়া আক্কাছ সম্বিৎ ফিরিয়া পাইলো বটে। কিন্তু কিছুতেই সে নিশ্চিত হইতে পারিতেছে না, বিন্যাসমুহূর্তের আগে না কি পরে সে অবস্থান করিতেছে ! গায়েবী আওয়াজের কথা মনে হইতেই চিরিং করিয়া উঠিয়া বসিলো এবং অজান্তেই ফের বাম হাতখানা তাহার অভ্যাসবশত তলপেট বাহিয়া নিচে নামিতে লাগিলো...!

[sachalayatan]
[somewherein]
[mukto-mona]
[khabor.com]
[sa7rong]
[horoppa.wordpress]

Tuesday, July 14, 2009

# ছবি ও না-ছবি : একটি সংগীত-সন্ধ্যার নির্ঘণ্ট। ২য়/শেষ পর্ব।


ছবি ও না-ছবি : একটি সংগীত-সন্ধ্যার নির্ঘণ্ট। ২য়/শেষ পর্ব।
রণদীপম বসু

[১ম পর্ব এখানে...]

‘এই চর্মচক্ষে আমরা যাহা দেখি, তাহাই কি সত্যি ?’ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে নমুনা স্বরূপ আমাদেরকে সেই স্পটগুলোতে ঢুঁ মারতে হবে, যেখানে একটা সংগীত-সন্ধ্যা মুখর অনুষ্ঠানে (১২-০৭-২০০৯ রবিবার ঢাকার শাহবাগে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের শহীদ জিয়া মিলনায়তনে কিউটেনাস টি সেল লিম্ফোমা নামের ভয়াবহ রকমের ক্যান্সারে আক্রান্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা এ জে এস এম খালেদের চিকিৎসা সহায়তা তহবিল সংগ্রহার্থে আয়োজিত) আমাদের প্রিয় সচল মুখগুলো অনানুষ্ঠানিক যেসব মাধুর্য্য রচনা ও সংরক্ষণ করে গেছেন তা দেখার জন্য।


কথায় তো আর চিড়ে ভিজবে না। তার চে’ চলুন না হয় কিছু নমুনা ছবি বিশ্লেষণ করি !

সতর্কতা: ২মেগা পিক্সেল মোবাইল ক্যামেরার রাতকানা চোখকে বিশ্বাস করিলে ভালো, না করিলে আরো ভালো। তাই বলিয়া ছবির চরিত্রগুলি তো আর ছবি হইতে বাহির হইয়া এইদিক ওইদিক না তাকাইয়া সোজা হাঁটিয়া চলিয়া যাইবে না !


নমুনা ০১:
আমাদের সবার প্রিয় ছবিয়াল সচল মুস্তাফিজ ভাই অতি সজ্জন ব্যক্তি নিঃসন্দেহে। যে কোন ভুতের বেগার ও সহযোগিতামূলক কর্মকাণ্ডে তাঁর উপস্থিতি অনেকটা নিশ্চিতই বলা চলে। আর ছবিয়াল হিসেবে তিনি যে একেবারে গুরুগোত্রের মানুষ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ছোট্টখাট্ট ক্যামেরার এইটুকুন মুখে বহুগুণ বড়ো সাইজের হাতির শূরের মতো জুড়ে দেয়া দীঘালে-পাথালে বিশাল লম্বা মোটা বস্তুটাকে যাঁরা চিনেন তাঁরা তো তাঁকে সমঝে চলেনই, আমার মতো নাখান্দা বান্দাদের নিরীহ পিলেটাও তা দেখেই চমকে ওঠে ! দুনিয়া জুড়ে কতো কিছুর ছবি তুলে বেড়ান তিনি ! কিন্তু তাঁর নিজের ছবি অন্য কেউ তুলতে গেলে এ কী ব্যবহার বলুন তো ! ভাগ্যিস নমুনা প্রমাণ হিসেবে ছবিটা ছিলো ! নইলে ছবি তোলার কথা বললেই তিনি যেভাবে ভেঙচি কেটে ওঠেন, তা কি বিশ্বাস করানো যেতো ! দেখুন না, লজ্জা পেয়ে কানাডা থেকে সদ্য আগত অমিতও তাঁর মুখটা কিভাবে ঘুরিয়ে নিচ্ছে !


নমুনা ০২:
আমাদের অতি প্রিয় স্বনামখ্যাত ব্লগার ও লেখক সচল অমিত আহমেদের নামের সাথে প্রায় সবাই পরিচিত। কদিন পরই যাঁর নামের আগে ড. কিংবা পরে পিএইচডি বিশেষণ যুক্ত হতে যাচ্ছে। গল্প উপন্যাসের বারোভাজা সেরে এবার সাইফাই গল্পকেও যেভাবে তিনি সাইজ করতে নেমেছেন, ক’দিন পর যদি ভাত মারার অভিযোগে মুহাম্মদ জাফর ইকবাল তাঁকে লাঠি নিয়ে তাড়া করতে থাকেন, আশ্চর্যের কিছু হবে না। সেই অমিত আহমেদ ঢাকা এসেছেন শুনে দৌঁড়ে গেলাম জাদুঘরে। কিন্তু কোথায় অমিত ! একটু পরে রীতিমতো নায়কী চেহারার এক টিন-এজ ছেলে এসে বলে কিনা- আমি অমিত ! চারদিকে যেভাবে ঠগ-বাটপাড়ে ছেয়ে যাচ্ছে, তাতে কানা হলেও আমার ২ মেঃপিঃ মোবাইল ক্যামেরাটাকে কাজে লাগানো জরুরি মনে করেছি।


নমুনা ০৩:
অনুষ্ঠান ভেনু জাতীয় জাদুঘরের শহীদ জিয়া মিলনায়তনে কতো সুন্দর সুন্দর মুখ আর মিডিয়া পারফরমারদের আগমন ঘটবে, তাই হলের গেটে ষণ্ডামার্কা জুতসই দারোয়ান দরকার। আলগা ফুটানিতে অনেকেই ওস্তাদ, কিন্তু সময়কালে সেরূপ ষণ্ডামার্কা ফিগার আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ করে এগিয়ে এলেন আমাদের সচল আহমেদুর রশিদ টুটুল ভাই- ক্যান, আমাকে পছন্দ হয় না ? বিশ্বাস করুন টুটুল ভাই তাঁর বহুমাত্রিক যোগ্যতা দিয়ে অনুষ্ঠান প্রবেশস্থলটাকে এমন নিরাপদ করে তুললেন যে, কাউকে টু-ফা করতেও দেখা যায়নি। সমস্যা ছিলো একটাই, আমার রাতকানা ক্যামেরার চোখ কিছুতেই টুটুল ভাইকে খুঁজে পাচ্ছিলো না !


নমুনা ০৪:
সবেমাত্র অনুষ্ঠান হলে ঢুকলেন অমিত। জনাকয়েক সচল তাঁর দিকে এগিয়ে এসে পরিচিত হচ্ছেন। আমার তো শুরুতেই সন্দেহ, এই নায়ক চেহারার ছোকরা একটা ছেলে কিছুতেই ক’দিন পরের ড. অমিত আহমেদ হতেই পারে না ! সন্দেহের নমুনা রাখতেই পকেট থেকে বের করে মোবাইল ক্যামেরাটা তাক করেছি। কিন্তু রাম যে বুঝে ফেলেছে উল্টোটা ! ‘আমি থাকতে আবার নায়ক কেডায় !’- বলেই লাফ দিয়ে সামনে এসে বিশাল মুড নিয়ে নজরুল ভাই ! দেখুন না, ভাব দেখে আর বাঁচি না !


নমুনা ০৫:
রতনে রতন চিনে, উরায় চিনে ধুরা ! এ কথার কী অর্থ, আমি বুঝি না। তবে কিছুদিন যাবৎ এটা খেয়াল করি যে, চেয়ার ভেঙে মাটি ডেবে ফেলা জাতিয় কী একটা দুর্ঘটনার পর থেকে বিশালদেহী ব্লগার শাহেনশাহ সিমন যে চেয়ারে বসেন, তাঁর পাশের চেয়ারে কেউ বসেন না। পাহাড়চাপা পড়ার আতঙ্কে হয়তো। তবু সিমনের পাশে যোগ্য আসন সঙ্গি পেতে দেরি হলো না। সেই খালি পড়ে থাকা চেয়ারটাতেই বড় আয়েশ করে বসে নিশ্চিন্তে অনুষ্ঠান উপভোগ করছেন আরেক বিখ্যাত ব্লগার আরিফ জেবতিক। সত্যি, রতনেই রতন চিনে !


নমুনা ০৬:
অনুষ্ঠানের মাঝামাঝি সময়টাতে হঠাৎ করে দেখা গেলো মিলনায়তনের ভেতরে আমাদের নক্ষত্র ব্লগার সচলরা কেউ নেই ! কী ব্যাপার ? খুঁজতে খুঁজতে কিঞ্চিৎ আলামত উদ্ধার করে সেই মোতাবেক প্রশস্থ প্যাসেজ ধরে একেবারে দক্ষিণপ্রান্তের আলোহীন ছায়াচ্ছন্ন কোনাটাতে একত্রে সবাইকে পাওয়া গেলো। কিন্তু কেউই নিজের নিজের চেহারাটা খোলতাই করছেন না। গোটা জাদুঘর এলাকাই ভেতরে-বাইরে ধুমপানমুক্ত শুধু নয়, ধুমপান নিষিদ্ধ এলাকাও। কিন্তু এই চিপায় এসে এখানে কী করছে এরা ! আমিই বুঝতে পারছি না, আমার কানা ক্যামেরা আর বুঝবে কী !


নমুনা ০৭:
সংসারে থেকেও যিনি সংসারের সকল মায়াচ্ছন্নতার উর্ধ্বে উঠে নিজেকে বিচরণ করান, তিনি আমাদের আরেক নাক্ষত্রিক গোসাই ব্লগার সচল মাহবুব লীলেন। আমাদের সাধারণ দৃষ্টিতে বিবেচ্য মহার্ঘ জিনিসপত্রও তাঁর কাছে গুরুত্বহীন তুচ্ছাতিতুচ্ছ ! সবাই জানে তিনি সমস্ত লোভ লালসার উর্ধ্বে সাধনার সপ্তশিখরে অবস্থান করেন। অথচ পোলাপাইন ব্লগার পান্থ রহমান রেজা কিসের প্যাকেটটা যেন কিনে এনে কেবল ছিঁড়েছে, অমনি লীলেন ভাই ‘এটা বাচ্চাদের খাবার নয়’ বলেই ছোঁ মেরে পান্থর হাত থেকে প্যাকেটটা তুলে নিয়ে গোগ্রাসে কেবল গিলতেই থাকলেন ! এটা কী জিনিস, তা সামান্য চেখে দেখার জন্য কত্তো কাকুতি-মিনতি করলাম। আশ্চর্য, তাঁকে একটুও গলাতে পারলাম না ! ভাগ্যিস মোবাইল ক্যামটা সাথে ছিলো। মনে ভীষণ ব্যথা নিয়ে পান্থ তো প্রায় ছিনিয়েই নিলো মোবাইলটা আমার হাত থেকে। এবং খিচে দিলো। নইলে কেউ কি বিশ্বাস করতো ?
আর টুটুল ভাই’র বহুমাত্রিক যোগ্যতাটা আবারো একটু যাচাই করে দেখুন তো, ফটকের নিরাপত্তায় দায়িত্বরত অবস্থায় টুটুল ভাইকে মানিয়েছে কেমন ?
হাহ্ হাহ্ হা !

বোনাস: কিছু কানা ছবির নমুনা

















[sachalayatan]

Monday, July 13, 2009

# ছবি ও না-ছবি : একটি সংগীত-সন্ধ্যার নির্ঘণ্ট। ১ম পর্ব।


ছবি ও না-ছবি : একটি সংগীত-সন্ধ্যার নির্ঘণ্ট। ১ম পর্ব।
রণদীপম বসু

ছবি দেয়ার সবচে’ সহজ ও কঠিন সুবিধাটা হলো- নিরেট বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে একাধারে আমার মতো এক্কেবারে হাবাগোবা বেক্কল-টাইপ লোকটিও হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন এমন অসাধ্য প্রচেষ্টায় ইতংবিতং লিখে শহীদ হয়ে যাবার কোন ঝামেলা নেই। ছবিই সবকিছু বলে দেয়। এবং এমনভাবেই বলে দেয় যে, লেখার বাবারও সাধ্যি নেই এর চেয়ে বেশি কিছু বলা বা বুঝানোর। আর বেশি বুঝানো তো দূরের কথা, একটা ছবি দেখে আমরা যা বুঝতে পারি তার সমান বুঝ সাপ্লাই দেয়াও কি যার তার দ্বারা সম্ভব ! আমার দ্বারা তো নয়ই ! এই দেখুন না, এ মুহূর্তে আমি যে কী বুঝাতে চাচ্ছি, এখন নিজেই সেটা বুঝতে পারছি না ! অন্যকে আর বুঝাবো কী ! অতএব এসব ক্যাচক্যাচানি বাদ দিয়ে বরং নিচে কিছু নমুনা ছবি ও উদাহরণ টানাই নিরাপদ উপায় হবে।


এই ১২-০৭-২০০৯ রবিবার ঢাকার শাহবাগে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের শহীদ জিয়া মিলনায়তনে কিউটেনাস টি সেল লিম্ফোমা নামের ভয়াবহ রকমের ক্যান্সারে আক্রান্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা এ জে এস এম খালেদের চিকিৎসা সহায়তা তহবিল সংগ্রহার্থে আয়োজিত সংগীত সন্ধ্যাটির কথাই ধরুন। একেকজন ভয়ঙ্কর সব চকচকে ক্যামেরার মাথায় ইয়া বড়ো বড়ো কামান মর্টার ফিট করে যেভাবে মিলনায়তনটিকে কাঁপিয়ে তুলছিলেন ক্লিক ক্লিক করে, এইসব মহাযোদ্ধাদের ভীড়ে বিন্দুমাত্র হায়া-শরম থাকলে কেউ ২ মেঃপিঃ রাতকানা মোবাইল ক্যামেরা নিয়ে এই যুদ্ধে সামিল হতে পারে এটা আপনারা বিশ্বাস করলেও করতে পারেন, কিন্তু আমি করি না ! এরপরেও বেশরম আমি কেন গিয়েছি জানেন ? আত্মহত্যা করার কোন উপায় নেই আমার, এজন্যেই। তাই সাধ্যে না কুলালেও বেশরমবাজী করার ক্ষেত্রে আমার আন্তরিকতায় কোন ঘাটতি ছিলো না !


ওহ্ হো ! এবার মনে পড়েছে, কী বলতে চেয়েছিলাম আগে। আমি বলতে চেয়েছিলাম যে, আমি যা বলতে চাই তা বলার ক্ষমতা আমার রাতকানা মোবাইল ক্যামেরার বলা কথার ন্যুনতম ক্ষমতার চেয়েও কোনভাবেই বেশি নয়। তাহলে কিছু নমুনা দেখুন !


নমুনা ০১:
এটা যে ১৯৫৮-৫৯ সালে (বর্তমানে নাকি নিখোঁজ) ভাস্কর নভেরা আহমেদের তৈরি একটা ভাস্কর্য, তা একজন কানাও চোখ বুজে বলে দিতে পারে। কিন্তু চক্ষুষ্মান হলেও যিনি ভাস্কর্যটি ইতিপূর্বে কখনোই দেখেন নি, তাঁকে ছবি ছাড়া এই ভাস্কর্যটি সম্পর্কে গড়ন-গাড়ন, দেখতে কেমন, কতো বড়ো ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ের স্পষ্ট ধারণা দেয়ার জন্য যে রকম শক্তিশালী ভাষার ব্যবহার দরকার, তা কি আমার আছে ? আর শুধু লেখা পড়েই চোখ বুজে কখনো না-দেখা একটা ভাস্কর্যের ছবি মনের মধ্যে হুবহু তৈরি করে ফেলা আদৌ কি সম্ভব ? অথচ কানা হোক তবু এরকম একটা ছবি হলে কোন ভাষার কি আদৌ প্রয়োজন হয় !


নমুনা ০২:
দেখুন তো, কী চমৎকার ছিমছাম মঞ্চ ! হালকা আলোয় মঞ্চের প্রতিটা উপকরণ নিজে নিজেই কীরকম প্রাণময় হয়ে ওঠেছে। বৈশিষ্ঠ্যে জড়বস্তু হলেও একজন অসুস্থ বীর মু্ক্তিযোদ্ধা পিতার সারাজীবনের অবদানকে ওরা সকৃতজ্ঞ শ্রদ্ধায় প্রণতি জানাচ্ছে যেন ! কোন্ যোগ্য ভাষা দিয়ে অযোগ্য আমি তা ব্যাখ্যা করবো ?


নমুনা ০৩:
প্রেস রিলিজের জন্য ফটোসেশান হলেও আগত শিল্পীদের ধারণকৃত ছবির এই একাংশের মধ্যে শিল্পীসত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ কি তাঁদের চেহারায় মুখভঙ্গিতে দারুণভাবে ফোটে ওঠেনি ! কৃতজ্ঞতাবোধে উজ্জীবিত এই শিল্পীসত্ত্বারা যে একজন দূরারোগ্য জটিল ক্যান্সারে আক্রান্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষকের প্রতি তাঁদের সুরসাধনালব্ধ সবটুকু আবেগ উজার করে ঢেলে দিতে পারেন, সেই বোধটুকু কোন্ কলমে ব্যাখ্যা করবো আমি !


নমুনা ০৪:
আবদুননূর তুষার, মিডিয়া জগতের একজন খ্যাতিমান তারকা উপস্থাপক। অত্যন্ত মানবিক এই অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করতে গিয়ে অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধায় কৃতজ্ঞতায় তিনিও তাঁর আপ্লুত আবেগকে কিভাবে আগত শ্রোতা-দর্শকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, তা কি এই ছবিই বলে দেয় না !


নমুনা ০৫:
অন্তর্গত আবেগের কোন বহিঃস্থ পণ্যমূল্য থাকে না। তবুও আমাদের আবেগগুলো কোন না কোনভাবে প্রকাশ পেয়েই যায়, ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক যেভাবেই হোক। এই আয়োজনটি যে কোনো উচ্ছ্বসিত উল্লাসের প্রতীকায়ন ছিলো না, বরং আমাদের কৃতজ্ঞবোধ প্রকাশের মহার্ঘ মুহূর্ত ছিলো, কানা ছবিতে মিলনায়তনের দর্শক গ্যালারি যেভাবে তা প্রকাশ করছে, সীমাবদ্ধ আমার ভাষার অক্ষর কি ততোটা সংহত হতে পারতো !


নমুনা ০৬:
কঠিন আবৃত্তিকার হাসান আরিফ। আবৃত্তির গমকে গমকে মিলানায়তন জুড়ে যে চমৎকার এক মোহমুগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়েছেন, দর্শক-শ্রোতাদের হৃদয় ছুঁয়ে ছুঁয়ে তা কখনো প্রেমের, কখনো বিদ্রোহের, কখনো আবেগের, কখনো যুদ্ধের এবং একাত্তরের মানবিক স্পন্দন হয়ে ধ্বণিত-প্রতিধ্বণিত হতে থাকলো। স্বাস্থ্যগত জটিলতায় হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হলেও তাঁর কণ্ঠশীলনের তুখোড় স্বাস্থ্য ও দক্ষতা কতোটা যে দুর্বিনীত ছিলো, তার প্রকাশ আমার এই কানা ক্যামেরার সাধ্যেরও বাইরে।

নমুনা ০৭-১৭:
আমি চিৎকার করে করে যতোই গলা ফাটিয়ে ফেলি না কেন, কিভাবে প্রমাণ করবো যে যেসব শিল্পীরা তাঁদের শিল্পীসত্ত্বা উজাড় করে একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন সুরে সুরে, তাঁরা হলেন- বংশীবাদক গাজী আব্দুল হাকিম, কণ্ঠশিল্পী লিলি ইসলাম, লীনা তাপসী, ফাহিম হোসেন চৌধুরী, শাম্মি আক্তার, খুরশিদ আলম, আকরামুল ইসলাম, সজীব, কৃষ্ণকলি, আবু বকর সিদ্দিক ও আলবেরুনী অনু। এবং যন্ত্রে সঙ্গত করেছেন তবলায় রঞ্জন, কীবোর্ডে সাজু ও অক্টোপ্যাডে দীপ ! বৃক্ষ তোমার নাম কী, ফলেই পরিচয়ের মতোই পর্যায়ক্রমিক ছবিগুলো হলে আর কোন কথা বলার দরকার আছে ?






















ছবির ভাষা বহুমাত্রিক। অনেক কথাই বলে সে। এবং কখনো কখনো এমন কথাও বলে, যা বিশ্বাসই হতে চায় না ! তবু বিশ্বাস না করে উপায় থাকে কি ? কিন্তু প্রামাণ্যবিহীন আপাত অবিশ্বাস্য কথা বিশ্বাস করানোর মতো কোন দালিলিক ভাষা কি আমাদের আয়ত্তে আছে ? এজন্যেই হয়তো দালিলিক ছবির আবশ্যিকতা। এ অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতার বাইরে আমাদের অনেক শ্রমনিষ্ঠ সচল ও অসচল বন্ধুদের যে আন্তরিকতা এই আয়োজনের পরতে পরতে ছুঁয়ে আছে তাঁর কোন ছবি আমার এ কানা ক্যামেরা ধারণ করতে পারে নি বলে আফসোস থেকে গেলো। তবে আগামী পর্বের জন্য গুটিকয় সচলের কীর্তিকলাপের যেসব ছবি রয়ে গেলো, তা নিশ্চয়ই দালিলিকই হবে।

[আগামী পর্বে সমাপ্য]

[sachalayatan]
[somewherein|jonmojuddho]