Monday, July 13, 2009

# ছবি ও না-ছবি : একটি সংগীত-সন্ধ্যার নির্ঘণ্ট। ১ম পর্ব।


ছবি ও না-ছবি : একটি সংগীত-সন্ধ্যার নির্ঘণ্ট। ১ম পর্ব।
রণদীপম বসু

ছবি দেয়ার সবচে’ সহজ ও কঠিন সুবিধাটা হলো- নিরেট বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে একাধারে আমার মতো এক্কেবারে হাবাগোবা বেক্কল-টাইপ লোকটিও হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন এমন অসাধ্য প্রচেষ্টায় ইতংবিতং লিখে শহীদ হয়ে যাবার কোন ঝামেলা নেই। ছবিই সবকিছু বলে দেয়। এবং এমনভাবেই বলে দেয় যে, লেখার বাবারও সাধ্যি নেই এর চেয়ে বেশি কিছু বলা বা বুঝানোর। আর বেশি বুঝানো তো দূরের কথা, একটা ছবি দেখে আমরা যা বুঝতে পারি তার সমান বুঝ সাপ্লাই দেয়াও কি যার তার দ্বারা সম্ভব ! আমার দ্বারা তো নয়ই ! এই দেখুন না, এ মুহূর্তে আমি যে কী বুঝাতে চাচ্ছি, এখন নিজেই সেটা বুঝতে পারছি না ! অন্যকে আর বুঝাবো কী ! অতএব এসব ক্যাচক্যাচানি বাদ দিয়ে বরং নিচে কিছু নমুনা ছবি ও উদাহরণ টানাই নিরাপদ উপায় হবে।


এই ১২-০৭-২০০৯ রবিবার ঢাকার শাহবাগে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের শহীদ জিয়া মিলনায়তনে কিউটেনাস টি সেল লিম্ফোমা নামের ভয়াবহ রকমের ক্যান্সারে আক্রান্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা এ জে এস এম খালেদের চিকিৎসা সহায়তা তহবিল সংগ্রহার্থে আয়োজিত সংগীত সন্ধ্যাটির কথাই ধরুন। একেকজন ভয়ঙ্কর সব চকচকে ক্যামেরার মাথায় ইয়া বড়ো বড়ো কামান মর্টার ফিট করে যেভাবে মিলনায়তনটিকে কাঁপিয়ে তুলছিলেন ক্লিক ক্লিক করে, এইসব মহাযোদ্ধাদের ভীড়ে বিন্দুমাত্র হায়া-শরম থাকলে কেউ ২ মেঃপিঃ রাতকানা মোবাইল ক্যামেরা নিয়ে এই যুদ্ধে সামিল হতে পারে এটা আপনারা বিশ্বাস করলেও করতে পারেন, কিন্তু আমি করি না ! এরপরেও বেশরম আমি কেন গিয়েছি জানেন ? আত্মহত্যা করার কোন উপায় নেই আমার, এজন্যেই। তাই সাধ্যে না কুলালেও বেশরমবাজী করার ক্ষেত্রে আমার আন্তরিকতায় কোন ঘাটতি ছিলো না !


ওহ্ হো ! এবার মনে পড়েছে, কী বলতে চেয়েছিলাম আগে। আমি বলতে চেয়েছিলাম যে, আমি যা বলতে চাই তা বলার ক্ষমতা আমার রাতকানা মোবাইল ক্যামেরার বলা কথার ন্যুনতম ক্ষমতার চেয়েও কোনভাবেই বেশি নয়। তাহলে কিছু নমুনা দেখুন !


নমুনা ০১:
এটা যে ১৯৫৮-৫৯ সালে (বর্তমানে নাকি নিখোঁজ) ভাস্কর নভেরা আহমেদের তৈরি একটা ভাস্কর্য, তা একজন কানাও চোখ বুজে বলে দিতে পারে। কিন্তু চক্ষুষ্মান হলেও যিনি ভাস্কর্যটি ইতিপূর্বে কখনোই দেখেন নি, তাঁকে ছবি ছাড়া এই ভাস্কর্যটি সম্পর্কে গড়ন-গাড়ন, দেখতে কেমন, কতো বড়ো ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ের স্পষ্ট ধারণা দেয়ার জন্য যে রকম শক্তিশালী ভাষার ব্যবহার দরকার, তা কি আমার আছে ? আর শুধু লেখা পড়েই চোখ বুজে কখনো না-দেখা একটা ভাস্কর্যের ছবি মনের মধ্যে হুবহু তৈরি করে ফেলা আদৌ কি সম্ভব ? অথচ কানা হোক তবু এরকম একটা ছবি হলে কোন ভাষার কি আদৌ প্রয়োজন হয় !


নমুনা ০২:
দেখুন তো, কী চমৎকার ছিমছাম মঞ্চ ! হালকা আলোয় মঞ্চের প্রতিটা উপকরণ নিজে নিজেই কীরকম প্রাণময় হয়ে ওঠেছে। বৈশিষ্ঠ্যে জড়বস্তু হলেও একজন অসুস্থ বীর মু্ক্তিযোদ্ধা পিতার সারাজীবনের অবদানকে ওরা সকৃতজ্ঞ শ্রদ্ধায় প্রণতি জানাচ্ছে যেন ! কোন্ যোগ্য ভাষা দিয়ে অযোগ্য আমি তা ব্যাখ্যা করবো ?


নমুনা ০৩:
প্রেস রিলিজের জন্য ফটোসেশান হলেও আগত শিল্পীদের ধারণকৃত ছবির এই একাংশের মধ্যে শিল্পীসত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ কি তাঁদের চেহারায় মুখভঙ্গিতে দারুণভাবে ফোটে ওঠেনি ! কৃতজ্ঞতাবোধে উজ্জীবিত এই শিল্পীসত্ত্বারা যে একজন দূরারোগ্য জটিল ক্যান্সারে আক্রান্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষকের প্রতি তাঁদের সুরসাধনালব্ধ সবটুকু আবেগ উজার করে ঢেলে দিতে পারেন, সেই বোধটুকু কোন্ কলমে ব্যাখ্যা করবো আমি !


নমুনা ০৪:
আবদুননূর তুষার, মিডিয়া জগতের একজন খ্যাতিমান তারকা উপস্থাপক। অত্যন্ত মানবিক এই অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করতে গিয়ে অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধায় কৃতজ্ঞতায় তিনিও তাঁর আপ্লুত আবেগকে কিভাবে আগত শ্রোতা-দর্শকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, তা কি এই ছবিই বলে দেয় না !


নমুনা ০৫:
অন্তর্গত আবেগের কোন বহিঃস্থ পণ্যমূল্য থাকে না। তবুও আমাদের আবেগগুলো কোন না কোনভাবে প্রকাশ পেয়েই যায়, ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক যেভাবেই হোক। এই আয়োজনটি যে কোনো উচ্ছ্বসিত উল্লাসের প্রতীকায়ন ছিলো না, বরং আমাদের কৃতজ্ঞবোধ প্রকাশের মহার্ঘ মুহূর্ত ছিলো, কানা ছবিতে মিলনায়তনের দর্শক গ্যালারি যেভাবে তা প্রকাশ করছে, সীমাবদ্ধ আমার ভাষার অক্ষর কি ততোটা সংহত হতে পারতো !


নমুনা ০৬:
কঠিন আবৃত্তিকার হাসান আরিফ। আবৃত্তির গমকে গমকে মিলানায়তন জুড়ে যে চমৎকার এক মোহমুগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়েছেন, দর্শক-শ্রোতাদের হৃদয় ছুঁয়ে ছুঁয়ে তা কখনো প্রেমের, কখনো বিদ্রোহের, কখনো আবেগের, কখনো যুদ্ধের এবং একাত্তরের মানবিক স্পন্দন হয়ে ধ্বণিত-প্রতিধ্বণিত হতে থাকলো। স্বাস্থ্যগত জটিলতায় হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হলেও তাঁর কণ্ঠশীলনের তুখোড় স্বাস্থ্য ও দক্ষতা কতোটা যে দুর্বিনীত ছিলো, তার প্রকাশ আমার এই কানা ক্যামেরার সাধ্যেরও বাইরে।

নমুনা ০৭-১৭:
আমি চিৎকার করে করে যতোই গলা ফাটিয়ে ফেলি না কেন, কিভাবে প্রমাণ করবো যে যেসব শিল্পীরা তাঁদের শিল্পীসত্ত্বা উজাড় করে একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন সুরে সুরে, তাঁরা হলেন- বংশীবাদক গাজী আব্দুল হাকিম, কণ্ঠশিল্পী লিলি ইসলাম, লীনা তাপসী, ফাহিম হোসেন চৌধুরী, শাম্মি আক্তার, খুরশিদ আলম, আকরামুল ইসলাম, সজীব, কৃষ্ণকলি, আবু বকর সিদ্দিক ও আলবেরুনী অনু। এবং যন্ত্রে সঙ্গত করেছেন তবলায় রঞ্জন, কীবোর্ডে সাজু ও অক্টোপ্যাডে দীপ ! বৃক্ষ তোমার নাম কী, ফলেই পরিচয়ের মতোই পর্যায়ক্রমিক ছবিগুলো হলে আর কোন কথা বলার দরকার আছে ?






















ছবির ভাষা বহুমাত্রিক। অনেক কথাই বলে সে। এবং কখনো কখনো এমন কথাও বলে, যা বিশ্বাসই হতে চায় না ! তবু বিশ্বাস না করে উপায় থাকে কি ? কিন্তু প্রামাণ্যবিহীন আপাত অবিশ্বাস্য কথা বিশ্বাস করানোর মতো কোন দালিলিক ভাষা কি আমাদের আয়ত্তে আছে ? এজন্যেই হয়তো দালিলিক ছবির আবশ্যিকতা। এ অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতার বাইরে আমাদের অনেক শ্রমনিষ্ঠ সচল ও অসচল বন্ধুদের যে আন্তরিকতা এই আয়োজনের পরতে পরতে ছুঁয়ে আছে তাঁর কোন ছবি আমার এ কানা ক্যামেরা ধারণ করতে পারে নি বলে আফসোস থেকে গেলো। তবে আগামী পর্বের জন্য গুটিকয় সচলের কীর্তিকলাপের যেসব ছবি রয়ে গেলো, তা নিশ্চয়ই দালিলিকই হবে।

[আগামী পর্বে সমাপ্য]

[sachalayatan]
[somewherein|jonmojuddho]

No comments: