Monday, November 24, 2008
@ ইহা কাজের কথা নয়
ইহা কাজের কথা নয়
রণদীপম বসু
চল্লিশার প্রভাব কিনা জানি না, সাদাকে কালো বলিয়া ভ্রম হইতেও পারে। তথাপি যাহা দেখিতেছি তাহার জন্য মনটা হু হু করিয়া উঠিল। এইরকমের বিরল হইয়া যাওয়া দৃশ্য কতোকাল যাবৎ দেখিতেছি না ! ছয়-সাতটি বছর তো গত হইয়াই গেল !
সুরমার ব্যঞ্জনা মাখিয়া চক্ষু দুইখানা উজ্জল হইল কিনা কে জানে। ভক্ত আশেকান কর্মী সমর্থক বেষ্টিত হইয়া ধবধবে পোশাক পরিয়া তিনি বয়সকে দমাইয়া রাখিয়া যেইভাবে মহল্লার সদর রাস্তাটিকে এইপার ওইপার করিতে লাগিলেন, ভাবিতে লাগিলাম, আহা, এইরকম স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া কয়জনে ইহা করিতে পারে ! নেতা হইবার যোগ্যই বটে ! এইরূপ ঘটা করিয়া কুশল বিনিময়ের হেতু বুঝিয়া উঠিতে আমার গুটিকয় মুহূর্ত চলিয়া গেলো। হঠাৎ করিয়া মাথার ভিতরে দিব্যজ্ঞান আসিয়া ভর করিতে লাগিল। কোনরূপ শ্লোগান বা স্বরোৎক্ষেপণ না ঘটিলেও নেতাজীর ভক্তকূলের মুখভঙ্গি অবলোকন করিয়া কীভাবে যেনো তাহাদের বক্ষাভ্যন্তরে গুমড়াইয়া উঠা কথাগুলি দিব্যকানে শুনিতে লাগিলাম- আসিতেছে শুভদিন অমুক ভাইয়ের সালাম নিন, তোমার ভাই আমার ভাই অমুক ভাই অমুক ভাই !
এইবার দিব্যচোখ বর্তমান পার হইয়া কয়েক কদম আগাইয়া গেল। মনের মাধুরি মিশাইয়া চারিদিকে কতকিছু উৎকীর্ণ দেখিতেছি। অমুক ভাইয়ের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র, আর কোন চিন্তা নাই আসিয়াছেন তমুক ভাই, মা-বইনেরা সালাম নিন শমুক ভাইরে চিনে নিন, তমুক ভাইকে রায় দিন জনসেবার সুযোগ দিন। দিব্যদৃষ্টি কাঁপিতে লাগিল, কেননা হঠাৎ করিয়া জনসেবকের ভীড় দ্রুত বাড়িয়া যাইতেছে। রীতিমতো ঠেলাঠেলি পড়িয়া গেল। কাহার আগে কে জনসেবায় ঝাঁপাইয়া পড়িবে তাহার ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা লাগিয়া গিয়াছে। এ উহাকে ঠেলিতেছে, সে তাহাকে ধাক্কাইতেছে, তিনি উনাকে গুঁতাইতেছেন। একেবারে হৈহৈ রৈরৈ কাণ্ড বাঁধিয়া গিয়াছে। বহুদিনের অনভ্যস্ত দৃষ্টি তাহা সহ্য করিতে পারিল না। অধিকতর সমস্যার আশঙ্কায় তাড়াতাড়ি দিব্যজ্ঞান গুটাইয়া পুনরায় বর্তমানে আসিয়া খাড়া হইলাম। এ কী ! এইবার আমিই কুশল বিনিময়ের লক্ষ্য হইয়া গেলাম ! তাঁহার বিগলিত বদনের উষ্ণতায় শেষপর্যন্ত আমি অধমও বুঝি গলিয়া গেলাম।
বিগলিত বক্ষে হাঁটিতেছি আর ভাবিতেছি, এই ভূ-ভারতে আর কোন্ দেশটি রহিয়াছে যেইখানে নিজের খাইয়া বনের মোষ তাড়াইবার মতো জনসেবা করিবার জন্য চারিদিকে হুড়াহুড়ি লাগিয়া যায় ? হঠাৎ করিয়া প্রশ্ন জাগিল, জগতে কোন্ দেশের নাগরিকদের মধ্যে জনসেবার আগ্রহ শীর্ষ অবস্থানে রহিয়াছে ? প্রশ্নটা যথার্থ হইল কিনা জানি না। কিন্তু জ্ঞান-গম্যির সীমা-পরিসীমা আতিপাতি করিয়া খুঁজিয়াও ইহার উত্তর পাইলাম না। সম্ভাব্য গ্রন্থ-পুস্তকাদিও ঘাঁটাঘাটি করিয়া ফেলিলাম প্রচুর। সকলই বৃথা হইল। জ্ঞানের জন্য সুদূর চীন দেশে যাইতেও বাধা নাই জানিয়া অবশেষে যাহাকেই সামনে পাই তাহাকেই প্রশ্ন করিতে লাগিলাম। কেহ নিজের অজ্ঞানতা প্রকাশ করিল, কেহ ভাবিল বিদ্রুপ করিতেছি, আবার কেহ ভাবিল এইবার সারা হইয়াছে ! মস্তিষ্কের আশু সার্ভিসিং প্রয়োজন জ্ঞান করিয়া তাৎক্ষণিক পরামর্শটুকু জানাইয়া দিতেও কেহ কেহ দ্বিধা করিল না। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর না পাইয়া আমি যে কীরূপ মর্মাহত হইলাম, তাহা কেহই বুঝিল না। সবাই কি তাহলে অন্ধ হইয়া গেল !
যেই দেশে জনসেবা করিবার সুযোগ হাতছাড়া হইবার আশঙ্কায় প্রতিযোগী জনসেবককে খুন করিয়া ফেলাটা বিস্ময়ের কিছু নয়, অধিক জনসেবা করিবার আশায় গোষ্ঠী বা দলের বড় পদে অধিষ্ঠিত হইতে মুহূর্তকালের মধ্যেই মারামারি লাগিয়া যায়, অথবা কে কাহাকে ছাড়াইয়া আরো তীব্রতর জনসেবা করিতে পারে সেই প্রচেষ্টায় একে অন্যের চরিত্র লুণ্ঠন করিতে সর্বশক্তি লইয়া ঝাঁপাইয়া পড়ে, কিংবা জনসেবার কিঞ্চিৎ সুযোগ পাইবার নিমিত্তে সকাল-বিকাল দল বদলের গড়াগড়ি করিতেও বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করে না, সেই দেশের নাগরিক হইয়া নিজেদের গর্বকেও ঠাহর করিতে পারিল না কেহ ! ইহা কি মর্মাহত হইবার মতো কথা নয় ! জনসেবার আগ্রহে সর্বাধিক পয়েণ্টে বিজয়ী নাগরিকের গর্বিত দেশটির নাম যাহারা বলিতে পারিল না, তাহাদের জন্য আমার অনুতাপ হইতে লাগিল। তাহারা কি এখনো দেখিতেছে না যে, দেশ ও দশের সেবা করিবার মনোবৃত্তি লইয়া নিজ নিজ দলের মনোনয়ন প্রত্যাশায় চতুর্দিকে কীরূপ ব্যতিব্যস্ত অবস্থার উদ্রেক হইয়াছে ! কেহ কেহ সাঙ্গপাঙ্গ লইয়া দলীয় প্রধানের কার্যালয় বা বাসভবনের সম্মুখে ধনুর্ভঙ্গ পণ লইয়া অবস্থান ধর্মঘটে বসিয়া গিয়াছে, জায়গার সঙ্কুলানে কাড়াকাড়ি পড়িয়া গিয়াছে। জনসেবাই যদি করিতে না পারিল তাহা হইলে এই জীবন আর রাখিয়া কী হইবে ভাবিয়া কেহ কেহ আমরণ অনশনের কর্মসূচি জানাইয়া দিয়াছে। কেহ কেহ জনসেবা করিবার দলীয় টিকিট না পাইয়া তীব্র হতাশায় গাড়ি-ঘোড়া-দোকান-পাট ইত্যাদি ভাঙচুর এবং জ্বালাও পোড়াও শুরু করিয়া দিয়াছে ! আবার কেহ কেহ তো জনসেবার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষায় বিদ্রোহী প্রার্থী হইয়া নিজের যোগ্যতা দেখাইয়া দিতে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া দিয়াছে ! দেশের ও দশের এই অভূতপূর্ব সেবা করিবার তীব্রদাহন কে কবে কোথায় আর দেখিয়াছে এমন !
সেবা গ্রহণের বা হজমের যোগ্যতা মূর্খ জনগণের না থাকিতে পারে। তাই বলিয়া যেই দেশে সেবা করিবার এইরকম মারাত্মক ইচ্ছাধারণকারী জনসেবকের অবিরল বন্যা বহিয়া যায়, সেই দেশের ভবিষ্যৎ লইয়া যাহারা দুশ্চিন্তা করিয়া রাত্রির ঘুম নষ্ট করিয়া ফেলে, তাহাদের জন্য অনুতাপ করিতে করিতে আমিও কি ঘুম নষ্ট করিব ? ইহা কাজের কথা নয়।
হঠাৎ জাগিয়া উঠিলাম! কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। চারিদিকে এইসব যাহাকিছু ঘটিতেছে, সকলকিছুই কি স্বপ্নের মধ্যেই ঘটিতেছে! আমি কি তবে ঘুমাইয়াই আছি? ইহার উত্তর দিবার মতো কেহ কি কোথাও জাগিয়া নাই ?
(২৩/১১/২০০৮)
[sachalayatan]
[mukto-mona blog]
[khabor.com]
[sa7rong]
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment