Tuesday, February 10, 2009
# মেধাবী ছেলে..
মেধাবী ছেলে..
রণদীপম বসু
বাপীর সাথে বইমেলা থেকে কিনে আনা মজার মজার বইগুলো পড়ে প্রান্তু ঠিকই জেনে গেছে লেখাপড়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য খেলাধূলাও করতে হবে নিয়মিত। তাই ইস্কুল ছুটির পরই ইস্কুলভ্যানটা না আসা পর্যন্ত তাড়াহুড়ো করে কটকটে রোদের মধ্যেই অন্য সহপাঠিদের সাথে দৌঁড়ঝাপ করতে শুরু করে। তা করতে গিয়ে মাঠের মধ্যে কখনো চিৎ হয়ে কখনো কাৎ হয়ে কখনো বা উপুড় হয়ে আছড়ে পড়ে। ইউনিফরমটা ধুলোতে মাটিতে একাকার হয়ে ময়লা দাগ বসে যায়। তাতে যে প্রান্তুর কোন দোষই নেই মামণিটা তা কিছুতেই বুঝতে চায় না। মেধাবী ছেলেরা কি আর এমনি এমনি মাটিতে গড়াগড়ি খায় ? বাসায় এলেই মামণির এই গজরগজর এক্কেবারেই অপছন্দ তার।
ইস্কুল-ব্যাগটা এক ঝটকায় বিছনায় ছুঁড়ে দিয়ে দ্রুত ছুটে যায় বেলকনির দিকে। ময়নাটা না জানি কতক্ষণ যাবৎ কিচ্ছু খায় নি কে জানে। বেতের মোড়াটায় লাফ দিয়ে উঠে পড়ে সে। ঝুলানো খাঁচার লোহার শলাগুলোর ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় ভেতরে আটকে রাখা খাবারের পাত্রটার দিকে। একটা ছোলাও নেই। তাকে দেখে ময়নাটাও চঞ্চল হয়ে ওঠে। আহারে, কতক্ষণ ধরে উপোস ! এক ঝটকায় ফিরে আসে পড়ার টেবিলের ধারে। পাশেই প্লাস্টিকের বয়ামে ভিজিয়ে রাখা ছোলাগুলো ফুলেফেঁপে কেমোন টসটস করছে। মুহূর্তেই হাত ঢুকিয়ে দেয় ভেতরে। কিন্তু তার আগেই মামণিটা এসেই জাপটে ধরে তাকে। এই খোল্ খোল্ বলে ইস্কুল ড্রেসটাতে হামলে পড়ে। ইশ্, কী করেছে সাদা শার্টটাকে দেখো। গা থেকে পুরো পোশাকটা না পাল্টে মামণির আর ক্ষান্তি নেই। কিছুতেই বুঝানো যায় না যে ময়নাটা খাবারের জন্য কী করুণ চোখে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে।
ড্রেসটা হাতে নিয়ে গজগজ করতে করতে মামণি বাথরুমের দিকে যাবে। ডিটারজেণ্টে মিশিয়ে বালতিতে ভিজিয়ে রাখতে রাখতে গজরগজর চলতেই থাকবে- 'অসভ্য কোথাকার, তোর মতো আরেকটা খাটাশ ছেলে পাবি নাকি ইস্কুলে ! প্রত্যেকদিন এক সেট করে কাপড় নোঙরা নর্দমায় মাখিয়ে আনবে ! কাহাতক ভালো লাগে এসব... !' যখন মুড ভালো থাকে তখন মামণির সম্বোধনটা হয় তুমি তুমি করে। আর যখনই মুড খারাপ, তখনই তুই তুই ছাড়া আর কথাই নেই। অন্য কেউ কখনো প্রান্তুকে তুই বলে সম্বোধন করলেই খুব অপমান বোধ করে সে। মুখের উপর বলে দেয়, আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন ? কিন্তু মামণির এই রাগ করে তুই তুই বলাটাকে কিছুই মনে করে না সে। বরং ভালোই লাগে তার। যেন এটাই স্বাভাবিক। আর তাই এগুলোকে তোয়াক্কা না করে সোজা চলে যায় ময়নাটার কাছে। শিকগুলোর ফাঁক দিয়ে মুঠো ভরে আনা ছোলাগুলো একটা দু'টা করে পাত্রটাতে ছাড়তে থাকে। কখনো আবার খুব আদর করতে ইচ্ছে হলে খাঁচার ছোট্ট দরজাটা আলতো খুলে হাতটা ঢুকিয়ে দেয় ভেতরে। পাখিটাও এদিক থেকে সেদিকে সরতে গিয়ে হাতের সাথে যে স্পর্শগুলো টের পায় তাতেই বুকটা ভরে ওঠে তার। পাখিটা দুষ্টুও আছে। কখনো কখনো ঠোকর বসিয়ে দেয় হাতে। এত্তো বোকা পাখি, বুঝেই না যে সে তাকে আদর করতেই হাত বাড়িয়েছে। আচ্ছা, শুধু ছোলা খেতে কি ভালো লাগবে ওর ? কিছু ভাতও দেয়া যেতে পারে। যেই ভাবা সেই কাজ। রান্নাঘরের দরজায় পা দিতে না দিতে যেখানেই থাক মামণি কী করে যেনো টের পেয়ে যায়,- 'এই কিছুতে হাত দিবি না খবরদার !'
সত্যি বলতে কী, এই ময়নাটাই প্রান্তুর ধ্যান জ্ঞান। মাত্র ক'দিন হলো এটা কেনা হয়েছে। প্রতিদিনের মতো সেদিনও ইস্কুল থেকে ফিরে দোতলার এই ফ্ল্যাটের বেলকনির গ্রিল ধরে সঙ্গিহীন উদাস দাঁড়িয়ে বাইরের পৃথিবীটা দেখছে। ইস্কুলের সময় ছাড়া আর বাকি সময়টাই তো এই চার দেয়ালের অসহ্য জীবন তার। কখনো ছড়া গল্পের বই পড়া, কখনো টিভির নবটাকে শুধু শুধু মোচড়ানো। কখনো বা এই গ্রিল ধরে নিষ্প্রাণ দাঁড়িয়ে থাকা। হঠাৎ এক অদ্ভুত দৃশ্য। লোকটা কাঁধে একটা লম্বা লাঠিতে অনেকগুলো খাঁচা ঝুলিয়ে ‘এই ময়না টিয়া শালিক’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে চলে যাচ্ছে। প্রতিটা খাঁচার মধ্যে রঙবেরঙের কী সুন্দর সুন্দর পাখিগুলো নাচানাচি করছে। প্রান্তুর হঠাৎ কী হলো যেনো। মামণি মামণি বলে চিৎকার করতে লাগলো। এমন অকস্মাৎ চিৎকারে উৎকণ্ঠিত মামণি 'কিরে কী হয়েছে' বলে দৌঁড়ে এলো। সে অঙ্গুলি নির্দেশে লোকটাকে দেখিয়ে চেঁচাতে লাগলো আমাকে ওটা একটা এনে দাও এনে দাও। এমন চেচামেচিতে পাশের ফ্ল্যাটের বেলকনিতেও কৌতুহলী মুখগুলো ভীড় করতে লাগলো। এবং কী আশ্চর্য, সেই পাখি ফেরি করা লোকটাও এসে নিচে দাঁড়িয়ে রইলো। মামণি কী বুঝলো কে জানে, 'ঠিক আছে ঠিক আছে' বলে লোকটাকে ইশারা করে নিচে নেমে গেলো। পেছন পেছন প্রান্তুও ছুটলো।
‘এই বাচ্চাটা নেন, ময়না, ইচ্ছে মতো বুলি শিখাইতে পারবেন’ বলে খাঁচাটা ধরিয়ে দিলো। বিশাল যুদ্ধজয়ের আনন্দে উদ্বেল সে। বেলকনিতে ঝুলিয়ে রাখা হলো। সেই থেকে প্রান্তুকে আর পায় কে। ভীষণ ব্যস্ত সে। কোন পরিচর্যায় কী রকমভাবে পাখিটা বেশি সন্তুষ্ট হচ্ছে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আর পরপরই এসে মামণির কাছে বিশদ ধারাবর্ণনা। বাসা জুড়ে একেবারে ঝালাপালা অবস্থা। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে ঘরে পা দিতে না দিতে বাপীর হাত ধরে টেনে বেলকনিতে। এই দেখো বাপী, পাখিটা না আমার সব কথা বুঝতে পারে। আমি চুপ বললেই ওটা দুষ্টুমি বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকে। জানো ওটা না কীরকম করে আমার চোখের দিকে একটুও পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকে। দেখবে ?... কিন্তু বাপীর কোন উচ্ছ্বাস না দেখে দমে গেলো সে। 'হুম' বলে বাপী চলে গেলো। কিন্তু পাখি বিষয়ক তার উৎসাহ দিন দিন বাড়তেই লাগলো। ওটাকে যে কথা বলা শেখাতে হবে ! আর এইসব অভিযান কার্যকর করতে গিয়ে প্রান্তুর আদেশ নির্দেশের ঠেলায় ছোট্ট কাজের মেয়েটার অবস্থা আরও কাহিল। বাসার অন্য সব কাজ বাদ দিয়েও তার নাভিশ্বাস ওঠার যোগাড়।
আজকেও যথারীতি স্কুল থেকে ফিরে বেলকনিতে উঁকি দিতেই প্রান্তুর বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠলো। খাঁচাটা খালি কেন ! ময়নাটা কই ? মামণি ! মামণি ! আমার ময়না কোথায় ? হাউমাউ কান্না আর বুকফাটা তীব্র চিৎকারে ঝনঝন করে ওঠলো ঘর দরজা সব। শোন্ বাবা শোন্, আমি আরেকটা কিনে দেবো তোকে, শোন.. মামণির আতঙ্ক মিশ্রিত অভয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। 'এক্ষুনি আমার ময়না এনে দাও, এনে দাও' বলে উন্মত্ত হয়ে ওঠলো সে। এমন আশঙ্কাই করেছিলেন তিনি। সে ইস্কুল থেকে আসার আগ পর্যন্ত সারাটাদিন দুশ্চিন্তায় কেটেছে তাঁর। মেয়েটিকেও আচ্ছা করে যেভাবে বকেছেন, এমনটা তিনি করেন না কখনো। কী দরকার ছিলো তোর এতো আহাদ দেখিয়ে পাখিটাকে আদর করতে যাওয়ার ? আর গেলি তো গেলি, খাঁচার মুখটা ভালো করে আটকে গেলি না কেনো ? মুখে এসব বললেও তিনি ঠিকই বুঝেন প্রান্তুর সাথে ওই মেয়েটির পার্থক্য আর কীইবা ! শিশুই তো। এই বন্দি জীবনে ওরও তো সাধ আহাদগুলো বন্দি হয়ে গেছে। লেখাপড়ার করার এই বয়সে অন্যের বাড়িতে কাজ করে পেটের ভাত যোগাড় করতে হয় ! তাইতো অবসর সময়ে তাকেও তিনি বর্ণপরিচয় শেখাতে লেগে যান। কিন্তু এখন কী হবে ? প্রান্তুর চিৎকার চেচামেচি কান্নায় বাড়িঘর মাথায় তুলে ফেলার অবস্থা। তার উন্মত্ততা যখন সীমা অতিক্রম করে জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে লাগলো, তখনি ঠাশ করে চড় কষলেন তার গালে।
যে মামণি কখনো মারে না তাকে, হঠাৎ এভাবে মামণির চড় খেয়ে তার কী যে হয়ে গেলো, শো-কেসের সামনেই কাচের জগটা হাতের নাগালে পেয়েই ধুরুম করে আছরে ফেললো। একটা টুকরা কিভাবে যেন ছিটকে গিয়ে মামণির কপালে লাগলো। মামণি একটা হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরলো। হতভম্ব হয়ে গেলো প্রান্তু। সোজা পড়ার টেবিলে গিয়ে মুখ গুঁজে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
বিকেলে অফিস শেষে বাপী বাসায় ফিরেই সব শুনলেন। কিন্তু কী আশ্চর্য, প্রান্তুকে বকলেনও না। শুধু ঘোষণা দিলেন, আগামীকাল প্রান্তু স্কুলে যাবে না। কেন ? মামণির প্রশ্নের উত্তরে শুধু বললেন, কেন, তা সকালেই বলবো।
পরদিন সকাল আটটায় অফিসে যাবার আগে বাপী প্রান্তুকে সামনের রুমে রেখে মামণিকে বললেন, আজ সারাদিন প্রান্তু এ রুমের বাইরে যেতে পারবে না। রুমের এটাচ্ড বাথরুম ব্যবহার করবে এবং তার খাবার তাকে এই রুমেই দেয়া হবে। বলেই বাইরে থেকে দরজাটা লাগিয়ে চাবি মামণির কাছে দিয়ে বললেন, শুধু দুপুরের খাবার দেয়ার সময় এ দরজা একবার খোলা হবে, ব্যস। জানলা দিয়ে প্রান্তু দেখলো শুধু, বাপী একবারও পেছনে না তাকিয়ে হন হন করে চলে গেলেন। গলি পেরিয়ে বাঁক ঘুরে মিলিয়ে যেতেই প্রান্তু দরজায় গিয়ে থাবাতে লাগলো, মামণি মামণি দরজা খোলো দরজা খোলো। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। ধাম ধাম করে কয়েকটা লাথি দিলো এবার। তারপরেই বিছানায় পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
সে বুঝে ফেলেছে বাপী তাকে একটুও পছন্দ করে না। নইলে কেউ কাউকে এভাবে তালা মেরে যায় ! মামণিটার প্রতি রাগ হলো সবচেয়ে বেশি। সে তো মামণিকে কতো ভালোবাসে। মামণিও বাপীকে কিছু বললো না ! আর কথাই বলবে না সে কারো সাথে। এরপরই আবার কাঁদতে শুরু করলো। কিন্তু এবারের কান্নাটা কেমন যেন ! এ কান্নাতে কী রকম কষ্ট লাগছে তার। অন্য কান্নাতে তো এমন মনে হয় না ! হঠাৎ দরজায় ক্যাচক্যাচ শব্দে মুখ তোলে তাকিয়ে দেখে মামণি প্লেটে করে তার প্রিয় ভাপা পিঠা বানিয়ে এনেছে অনেকগুলো। খুশি হয়ে ওঠলো সে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো সে তো কারো সাথে কথা বলবে না। এমন কি কিছু খাবেও না। মামণির প্রতি অভিমানে বুক ভার হয়ে এলো তার। চোখ দিয়ে পানি আসতে শুরু করেছে। কোন কথা না বলে বিছানায় পাশ ফিরে মামণিকে পেছন দিয়ে শুয়ে পড়লো।
বাবু তোমার জন্য বানিয়েছি, উঠে পিঠা খাও ? কয়েকবার আদর করে ডাকলেও মামণির ডাকে কোনো সাড়া না দিয়ে তীব্র অভিমানে প্রান্তু ওভাবেই পড়ে রইলো। আচ্ছা ঠিক আছে, এই রেখে গেলাম। খিদে পেলে খেও, বলে পিঠার প্লেটটা টেবিলে রেখে দরজাটা আস্তে করে ভেজিয়ে দিয়ে মামণি চলে গেলো।
দুপুরেও অনেক সাধাসাধি করেও প্রান্তুকে খাওয়ানো গেলো না। মামণি শেষ পর্যন্ত কেঁদেই দিলো। কোলে টেনে নিলো তাকে। কী আশ্চর্য, মামণির এই কান্না তার এতো ভালো লাগছে কেন ! কিন্তু সে কিছুতেই খাবে না। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেলো সে মেধাবী ছেলে। তাকে তালা মেরে রাখায় তার অপমান হয়েছে। মেধাবী ছেলেরা অন্য সবার মতো নয়। কোন অনুনয় বিনয়ে কাজ হলো না। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে মামণি উঠে চলে গেলো। ওপাশ থেকে আর কারোরই খাওয়া দাওয়া বা অন্য কোন সাড়াশব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু হালকাভাবে প্রান্তুর কানে এলো মামণি কাকে যেন ফোন করছে, হ্যালো...।
দুপুরের পরপরই বাপী চলে এলো অফিস থেকে। প্রান্তুর কিছুটা ঘুম ঘুম ভাব এসে গিয়েছিলো। বাপীর ডাকে সে সচকিত হয়ে ওঠলো। কইরে বাবু ওঠো, ভাত খাবে না ? অন্যদিন থেকে বাপীর কণ্ঠটা কেমন মোলায়েম লাগছে। এতোটা মোলায়েম করে বাপী সাধারণত কখনো ডাকেন না। কিন্তু প্রান্তু চুপ করে রইলো। সে যে কারো সাথে কোন কথা বলবে না। তাছাড়া বাপীর সাথে তো প্রশ্নই আসে না।
হঠাৎ প্রান্তু শূন্যে ভাসতে লাগলো। অর্থাৎ বাপী তাকে দুহাতে তুলে ধরেছেন। তারপরই বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কী হয়েছে বাবু তোমার ? কেমন একটা অস্বস্তি হতে লাগলো প্রান্তুর। কারণ বাপী তাকে এভাবে খুব একটা কোলে নেন না। কিন্তু ভালোও লাগছে খুব। আবারো বাপীর প্রশ্ন, বলো না বাবু কী হয়েছে তোমার ? তুমি নাকি কিছু খাওনি ?
সে যে কথা বলবে না এটা বাপীকে জানানো দরকার। নইলে বাপীর প্রশ্ন থামবে না সে জানে। তাই বললো, বাপী আমি তো কারো সাথে কথা বলবো না।
কেন বলবে না ?
সেটা তো বলা যাবে না।
কেন বলা যাবে না ?
এবার খুব রাগ হলো তার। বেশ ঝাঁঝ দিয়ে বললো, কেন ? বলতে না চাইলেও বলতে হবে নাকি ?
অবশ্যই না ! বলতে না চাইলে বলবে কেন ? তবে আমাদের ময়নাটা কেন কথা বলবে না, এটা না জানলে যে আমাদেরও কিচ্ছু ভালো লাগবে না !
তুমি কি আমার সাথে ঠাট্টা করছো ?
এই একটু একটু করছি।
তুমি জানো না, আমার কাছে ঠাট্টা ভালো লাগে না ?
আগে তো তাই জানতাম। কিন্তু তুমি যে তোমার ময়নাটার সাথে ঠাট্টা করতে, সেটা কেন করতে ?
তুমি কিভাবে জানো তা ? প্রান্তুর চোখে বিস্ময়। বাপী জানলো কী করে !
আমি যে আমাদের ময়নাটার চোখ দেখেই বলে দিতে পারি !
সত্যি বলছো ?
হাঁ সত্যি। তুমি আমার দিকে তাকাও, দেখো আমি কিভাবে সব বলে দেই।
শিশুর নিষ্পাপ দুটো চোখ আকাশের চে’ও বড় হয়ে মেলে রইলো। তাহলে বলো তো বাপী আমি এখন কী ভাবছি ?
হুঁম.. তুমি তো দেখছি অনেকগুলো কথা একসাথে ভাবছো ! আমি একে একে বলি ?
মাথাটা একপাশে হেলে সম্মতি জানালো সে।
তুমি ভাবছো, বাপীটার মাথা টাথা ঠিক আছে তো ?
যাও, কথা বলবো না। আমি তো এটা ভাবি নি !
উঁহু, তুমি জানোই না যে তুমি তা ভাবছো। কিভাবে ? তা বলছি। তবে তার আগে আমি যে প্রশ্নগুলো করবো তার উত্তর কিন্তু ঠিক ঠিক দিতে হবে। আচ্ছা তুমি কি জানো, কেন আমি সকালে দরজাটা বন্ধ করে গেলাম ?
হঠাৎ যেন পুরনো কষ্টটা আবার মনে হয়ে গেলো তার। মনটা বিষন্ন হয়ে গেলো ফের। শুধু মাথাটা দুপাশে নাড়িয়ে তার না জানার কথাটা প্রকাশ করলো।
তুমি যে পাখির খাঁচাটা বন্ধ করে রাখতে, তাতে পাখিটার কষ্ট হতো কিনা তা কি তুমি জানো ?
আবারো সে দ্রুত মাথা নাড়িয়ে এবং মুখে উচ্চারণ করলো, নাহ ।
আমি যে আমার ময়না পাখিটাকে এ ঘরে দরজা বন্ধ করে গেছি তাতে তোমার কষ্ট হয় নি ?
হঠাৎ প্রান্তুর চোখে মুখে একটা উজ্জ্বলতা ফিরতে লাগলো। জানো বাপী, পাখিটার না কষ্ট হতো ! এজন্যই কি সে আমার হাতে কামড় দিতো ?
হাঁ। সে তোমাকে বলতে চাইতো, বাবু, তুমি আমাকে আমার মামণি আর বাপীর কাছে যেতে দাও। ও..ই দূরের জঙ্গলে বাসায় আমার মামণি আর বাপী কিচ্ছু না খেয়ে আমার জন্য কাঁদছে। আমাকে তুমি ছেড়ে দাও। আমি আমার মামণি আর বাপীর কাছে যাবো।
হঠাৎ প্রান্তু কাঁদতে শুরু করলো এবং কাঁদতে কাঁদতে বললে লাগলো, বাপী তুমি এভাবে বলছো কেন ? আমার যে কান্না আসছে ?
বাপী আবার তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তোমার তো কোন দোষ নেই বাবু। তুমি তো তাকে ভালোবাসতে, আদর করতে। কিন্তু তার কথা বুঝতে না বলেই তো তাকে ছাড়তে পারোনি তুমি, তাই না ?
বাপীর কাঁধের উপরে রাখা প্রান্তুর মাথাটা সম্মতি জানিয়ে নড়তে লাগলো।
এখন যে পাখিটা তার মামণি আর বাপীর কাছে ফিরে গেছে, তাতে কি ভালো হয়েছে না খারাপ হয়েছে ?
ঝনঝন করে উত্তর বেরিয়ে এলো, ভালো হয়েছে।
দেখি আমার দিকে চেয়ে বলো তো কেমন হয়েছে ?
পৃথিবীর সমস্ত আলো এখন প্রান্তুর মুখে, খুব ভালো হয়েছে বাপী !
গুড, এই তো মেধাবী ছেলের মতো কথা ! আচ্ছা এবার বলো তো, যাকে মানুষ ভালোবাসে তাকে কি কষ্ট দেয়া উচিৎ ?
কক্ষনো না !
তাহলে বাবুটা খায়নি বলে মামণিও যে আজ সারাদিন কিচ্ছু খায় নি, মামণির কষ্ট হচ্ছে না ?
হঠাৎ এক নির্মল কষ্টে প্রান্তুর মুখটা আরো বেশি নিষ্পাপ হয়ে ওঠলো। কী মনে করে ঝাঁপিয়ে পড়লো বাপীর বুকে। কেন যেন তার মনে হলো বাপীটা আসলে খুব ভালো। আর তখনি বাপীর কাঁধের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলো দরজায় দাঁড়ানো মামণিটা আসলে কতো বোকা ! তার এতো ভালো লাগছে, অথচ মামণিটা দাঁড়িয়ে বোকার মতো হাসতে হাসতে কাঁদছে !
(১৪/০৯/২০০৮)
[মাসিক 'টইটম্বুর'/ ঈদ ও বিজয় দিবস সংখ্যা- ডিসেম্বর ২০০৮]
[sachalayatan]
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment