Monday, January 19, 2009
# ছেঁড়া ঘুড্ডি। ০২। দাগ
দাগ
রণদীপম বসু
রুমে ঢোকার মুখেই প্রথম বাধা, ব্যাগ আর জুতা রেখে যান। নির্দেশসুলভ কণ্ঠে ভদ্রতার ছোঁয়াটুকুও নেই। পোর্টফোলিও ব্যাগটা দরজার পাশেই নামিয়ে রাখলাম। জুতা-মোজা খুলে রেখে ভেতরে ঢুকতেই সামরিক পোশাক পরা দ্বিতীয় লোকটার ইঙ্গিত আমার মাথার দিকে। পূর্ণমুণ্ডিত বিরলকেশ মাথাটা উন্মুক্ত করে চারধার উঁচু করা গোলাকার সাদা ক্রিকেটিয় ক্যাপটা নামিয়ে পাশের টেবিলে রাখতে যাচ্ছি, আরেকজন সামরিক কায়দার লোক এসে ক্যাপটা নিয়ে গেলো। ভেতরের আরেকটি রুমে ঢোকার দরজার পাশে মেঝেতে ফেলে রাখলো।
ওটা কী ? দ্বিতীয় ব্যক্তিটির প্রশ্নে ফের মনোযোগ ফিরে এলো এদিকে। সন্দেহজনক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমার ব্রম্মতালুর দিকে। কম করেও প্রায় ছ’ফিট উঁচু অবস্থান থেকে পাঁচ ফিট সাত ইঞ্চি আমার তালুতে সদ্য জোড়া-তালি সেলাইয়ের আড়াআড়ি দাগটা তাঁর চোখে পড়তে কোনো সমস্যা হয় নি। আমি মৃদু স্বরে উত্তর করলাম- দাগ।
কিসের দাগ ?
সেলাই।
এবার বুঝি তাঁর কমান্ডিং স্বরটা গাঢ় হয়ে উঠলো- কি হয়েছিল ?
ভরা কলসির কানা ডেবে গিয়েছিল।
আমার উত্তরে সন্তুষ্ট হলো কি হলো না বুঝা গেল না। উজ্জ্বল চোখ দুটো আমার চোখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাক করে রেখে প্রায় থ্রি কোয়ার্টার হাত দৈর্ঘ্যরে অদ্ভুত লাঠি জাতীয় জিনিসটার অগ্রভাগ দিয়ে দেয়ালের দিকে ইঙ্গিত করলো। নির্দেশমতো উল্লম্ব স্কেলটা ঘেষে দাঁড়ালাম। একজন হাঁক দিলো, সিক্সটি সিক্স।
এবার বিপরীত দিকের দেয়ালে ঝুলানো একটা বড় পর্দার দিকে তাকানোর নির্দেশ। ওখানে একজন দাঁড়ানো। পর্দায় অংকিত সারি সারি বিভিন্ন আকৃতির ইংরেজি আলফাবেটস। একটা স্টিকের মাথা এলোপাথারি বিভিন্ন বর্ণের উপর রাখছে আর প্রশ্ন ভেসে আসছে, এটা কী ? এটা ? ওটা ? আমিও দ্রুত উত্তর দিয়ে যাচ্ছি। এরই মধ্যে আমার পাশে দাঁড়ানো লোকটা প্রথমে আমার বাঁ চোখ, তারপর ডান চোখ চেপে ধরছে আর একইভাবে ওদিক থেকে প্রশ্ন।
এবার দ্বিতীয় লোকটি আমার কাছে এসে ছোট্ট লাঠিটা থুতনির নীচের দিকে ছুঁইয়ে উপরের দিকে চাপ দিতে দিতে বললো- হা করুন।
আমি আলতো হা করলাম।
আরো বড় করে...।
আমি তাই করলাম। বাঁ হাতে ধরা ছোট্ট টর্চটা আমার মুখের ভেতর আলো ফেললো। তৃতীয় সামরিক ব্যক্তিটির হাতে অদ্ভুত লাঠিটা ধরিয়ে দিয়ে তার বাড়িয়ে দেয়া চামচের মতো যন্ত্রটা নিয়ে সোজা আমার মুখের ভিতর হলকম অবধি ঢুকিয়ে দিলো। এবং জিহ্বার উপর নীচ ডানে বামে কতক্ষণ নাড়াচাড়া করে চামচটা বের করে নিয়ে পেছনের চেয়ারটাতে বসার ইঙ্গিত করেই বললো- শার্ট খুলুন।
আমি শার্ট খুললাম, ভেতরের গেঞ্জিও খোলতে হলো। উদোম গায়ে চেয়ারটাতে বসতেই আবার কমান্ড- এভাবে থাকুন।
ঘাড়টা একপাশে কাত করে রাখলাম আমি। প্রথমে ডান কান, পরে বাম কানেও কী সব পরীক্ষা নিরীক্ষা চললো। এদিকে আরেকজন আবার ডান হাতে প্রেসার মাপার যন্ত্র জাতীয় কিছু ফিট করে নিয়েছে। চোখ দুটোকে নিয়ে হামলে পড়লো আরেকজন। তারপরে নাকটাকে। মাথাটা প্রায় চিৎ করে নিয়ে নাকের ছিদ্র দিয়ে কী একটা ঢুকিয়ে দিলো। টর্চ ফেলে দেখলোও আরো কী কী যেনো। সবকিছুই খুব দ্রুত ঘটতে লাগলো।
অল্পক্ষণ পরেই ভেতরের দরজার দিকে ইঙ্গিত, অর্থাৎ পরের রুমে। নিরবে কমান্ড পালন করছি। দরজার পাশে আমার টুপিটাকে আড়াল করে শার্ট আর গেঞ্জিটা পড়ে আছে মেঝেতেই। পাশের রুমে ঢুকার আগেই কমান্ড, প্যান্ট খুলে যান।
জী..? কমান্ডটা সঠিক শুনলাম কিনা নিশ্চিৎ হতে পারলাম না। পাশের সামরিক লোকটির দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালাম। একই কথার পুনরাবৃত্তি হলো- পরনের প্যান্ট এখানে খুলে রেখে যান।
বলে কী ! বেল্ট খুলতে খুলতে খানিকটা ইতস্ততঃ করছি। পাশ থেকে ধমক এলো, কুইক !
ধা করে খশে পড়লো প্যান্টটা। এবার শুধু ছোট্ট একটা বস্ত্রই শরীরে সেঁটে আছে, আন্ডার-অয়্যার !
ভেতরে ঢুকে সামরিক ইউনিফর্ম পরা লোকটির চোখের দিকে তাকাতেই রক্ত হিম হয়ে গেলো ! স্পষ্ট ইঙ্গিত আমার সবেধন নীলমণি ছোট্ট আন্ডার-অয়্যারটার দিকেই, রিমোভ !!
১৯৮১ সাল। সবে এইচ এস সি পাশ করেছি। ব্যায়ামপুষ্ট শরীরে মনে সব কিছুতে একটা ফুরফুরে ডোন্ট কেয়ার ভাব। নিজের সাধারণ ক্ষমতাটুকুকেও বাড়ন্ত তরুণীদের সামনে অতি-বীরত্বে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রকাশ করার মোহে উঠতি বয়সের উদ্দামতা তখন হার না মানায় উচ্ছল। নতুন পত্তনি করা বাসার সামনে বৃষ্টি-ভেজা শেষ বিকেলের পিচ্ছিল কর্দমাক্ত রাস্তায় সে রকমই এক অতি বীরত্ব দেখাতে গিয়ে মাথার তালু বরাবর দু’ফাঁক হয়ে যাওয়াটা তখনও টের পাইনি। টের পেলাম, যখন বৃষ্টিতে চুপসে যাওয়া গায়ের লাল গেঞ্জিটা দেখে বোঝার আর উপায় রইলো না যে অরিজিনালি ওটা সাদাই ছিল !
ঘটনার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় কে কীভাবে কখন মূর্চ্ছা গেল তা খেয়াল করার হয়তো সুযোগই ছিলো না। হাতের তালু দিয়ে ব্রম্মতালু চেপে ধরে রক্তক্ষরণ থামানোর চেষ্টা চালাতে চালাতে রিক্সা চেপে সোজা সদর হাসপাতালে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব কোণাঞ্চলের নিরিবিলি সুনামগঞ্জ শহরটিতে প্রাইভেট কিনিক বলে এরকম কিছু ছিল না তখন। সরকারি হাসপাতালটাও জেলখানার সহাবস্থান ছেড়ে সরকারি কলেজের পাশ্ববর্তী এলাকায় ঠাঁই গাড়েনি তখনো।
মাথার দশাসই ব্যান্ডেজ ছেড়ে সেলাইটা তখনো শুকিয়েছে কি শুকায়নি। এডভেঞ্চারপ্রিয় মনে ভূত চাপলো বিমান বাহিনীতেই যোগ দেবো। পত্রিকায় কমিশন র্যাঙ্কে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি দেখে পুরনো ইচ্ছাটা চাগিয়ে উঠায় অন্য কোথাও ভর্তির চেষ্টাও করা হলো না আর। পরিবার থেকে আমার এমন হঠকারি সিদ্ধান্তে পূনর্বিবেচনা করার উপদেশ এলেও আমার গভীর বিশ্বাস ওখানে চান্স তো পাবোই। আমি না পেলে আর পাবেটা কে শুনি ! এদিকে খাসিলত কি আর পাল্টায় ! ইটিশপিটিশ করার সেনসেটিভ জায়গাগুলোতে মাথা ফাটার প্রাক ও পরবর্তী বিক্রম ফলানোর বীরত্বগাথা বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে মেয়েলী কণ্ঠের কলকলে হাসির মাদকতায় সেই বোধটাই কাজ করেনি যে, এগুলো কি প্রশ্রয়ের হাসি ছিল ? না কি ঝাঁকড়া ঘন বাবরি চুলের উত্তুঙ্গ গ্যালারির মাঝখানে জোড়াতালি চিকিৎসায় ছেটে ফেলাজনিত কেশোচ্ছেদি মধ্যতালুর বিস্তৃত খোলা মাঠ নিয়ে গোপালভাঁড় মার্কা যে অদ্ভুত চেহারাটা ধরেছিলাম, তার প্রভাব ? অতঃপর হেয়ার ড্রেসিং সেলুনের স্বচ্ছ আয়নায় ক্ষুরের নির্দয় পোচে পোচে নিজেকে দেখছি ! অর্ধমুণ্ডিত চেহারার ভাবগতি দেখে পূর্ণমুণ্ডিত রূপ কী হবে ভাবতেই স্বজন হারানোর মতো দুর্বহ শূন্যতায় কাঁদবো না কি থম ধরে বসে থাকবো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। ক্ষৌরকার লোকটি ছোট্ট তোয়ালেটা এগিয়ে দিয়ে ইঙ্গিত করলো চোখ দুটো মুছে নিতে। আহা, এক জীবনে মানুষকে কত কিছুই না হারাতে হয় !
বিমান বাহিনীর ভ্রাম্যমান ক্যাম্প বসলো সিলেট শহরেরই প্রখ্যাত একটা স্কুলে। ভর্তি পরীক্ষার সবগুলো প্রক্রিয়া এখানেই সম্পাদিত হবে, মায় চূড়ান্ত ফলাফল দেয়া সহ। নির্ধারিত দিনে বহু প্রার্থীর সমাগমে গিজগিজ করছে। প্রথম ইভেন্টেই আইকিউ এবং সাধারণ পর পর দুটো লিখিত পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ভীড়টা পাতলা হয়ে গেলো। দুপুরের পর পর দুপর্যায়ের মেডিক্যাল টেস্ট। এগুলো উত্তির্ণ হলে কনফিডেন্সিয়াল ভাইভা। মেডিক্যাল টেস্টের লাইন ধরেছি। রিটেনে ভালো করায় সিরিয়াল শুরুতেই পড়লো। কিন্তু আগে কি জানতাম কী বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছি ! তাহলে হয়তো এই জীবনেও এমুখো হতাম না। নবীন তারুণ্যের তরল আবেগে সেই মেয়েটির কাছে আগপাছ না ভেবে যে অনড় প্রতিজ্ঞা করে এসেছি, তাই এখন গলায় ফাঁস হয়ে গেছে। দেখো, পাইলট হয়ে তোমাকে বিমানে চড়াবোই চড়াবো, নইলে আর কখনোই এ মুখ দেখাতে আসবো না, এই নামটাই পাল্টে দেবো...! স্বেচ্ছাকৃত ছুঁড়ে আসা এই কথাগুলোই কানে বাজতে লাগলো একে একে। অভিজ্ঞতার পাঠে তখন কি আর জানা ছিল, আত্মবিশ্বাস ভালো কিন্তু অতিবিশ্বাস কিছুতেই নয় ?
আমাদের শহরের স্থায়ী কোনো বাসিন্দা নয় সে। মফস্বলের কোন্ দূর গ্রাম থেকে দূরবর্তী আত্মীয়তার সূত্রে এমন মিষ্টি যে মেয়েটি শহরে এসেছিলো ম্যাট্রিক পরীার্থী হয়ে পাশের বাড়িতে, জান্তে বা অজান্তে কখন যে প্রথম স্বপ্নের মধুবীজটি নিজ হাতেই রোয়ে দিয়েছিলাম বুকে..! দেখতে দেখতে তা চারা হয়ে গেলো ! ছায়ার আবেশ নিয়ে বেড়ে উঠছে সে দ্রুত...। শিকড়সহ একে অনাহুত উপড়ানোর অভিশাপ কী করে বইবো আমি..!
এটা কিসের দাগ ! প্রশ্নের ঝণঝণ ধাক্কায় সম্বিৎ পেলাম।
কিন্তু এ কী ! আমার আন্ডার-অয়্যার কোথায় ! এক আদিম অনার্য পুরুষ আমি দিগম্বর দাঁড়িয়ে ঠায়, নির্বিকার ! এক চিলতে সুতোবিহীন এমন মুক্তকচ্ছ মানব হিসেবে এ আমার প্রথম পাঠ, অভূতপূর্ব ! সুরমার জলে সাঁতরে সাঁতরে বেড়ে উঠা কৈশোর তারুণ্যে দুর্গময় তেমন কোনো বাথরুম তো ছিলো না যে আগে এমন বিরল অভিজ্ঞতায় সিঞ্চিত হবো ? ঘটনার অভিঘাতে তখন পুরোটাই যান্ত্রিক আমি। ভব্যতার লেশমাত্রহীন সামরিক লোক দুজন আমাকে উল্টে-পাল্টে হাতের স্টিকটি দিয়ে যথেচ্ছ নেড়েচেড়ে কী যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিলো তারাই জানে। আমি শুধু জানি মেডিক্যাল টেস্ট সেরে যে আমি বেরিয়ে এলাম সে অন্য এক আমি, যে এক লাফে অনেক বেশি সাবালক হয়ে গেছে।
চূড়ান্ত ভাইভার কনফিডেন্সিয়ালিটি আমার সেই জন্মদাগটিকেই চিনিয়ে দিলো আবার। এবং বুঝিয়ে দিলো এ দুর্ভাগা দেশে কখনো কখনো এমন সময়ও আসে যখন ঈশ্বর আর আল্লাহর মাঝখানে বিশাল এক ব্যবধান তৈরি হয়ে যায় ! এরপর জীবনে আরো কতো বিচিত্র পরীক্ষা এলো গেলো। কিন্তু সেদিনের সেই নাওয়া-খাওয়াহীন গোটা দিন শেষে এক ক্লান্ত ক্ষুব্ধ ভঙ্গুর বিকেল আমার ভাগ্যটাকে নির্ধারণ করে দিয়ে গেলো, তাঁর সাথে আর কখনোই যে দেখা হবে না আমার ! এবং কী আশ্চর্য, আমি চাইলেও সেই মেয়েটির সাথে আর কখনোই দেখা হয় নি !
আগে চুল সরিয়ে দেখতে হতো, এখন আর তার প্রয়োজন হয় না। সময়ের ঝড়ে উড়ে যাওয়া বনানীর মতো ফাঁকা তালুয় চিরুণী ঘষটানোর অভ্যস্ত কৌতুক করতে গিয়ে আয়নার গায়ে একটু খেয়াল করলেই খুব সহজেই লম্বা আড়াআড়ি দাগটা চোখে পড়ে। ভরা কলসীর ধারালো কানা বসে গিয়ে হা হয়ে যাওয়া চামড়ার ভাজ ডাক্তারি সেলাই দিয়ে ফের বুজে দেয়া হলেও এই বুজে দেয়ার অমোচ্য দাগই বলে দেয় ওখানটা একদিন হা হয়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের সেই কাদম্বিনীর মতোই, আগে যে মরে নাই সে এটা বুঝি মরিয়া প্রমাণ করিল !
সেই দিনটির পর দীর্ঘ সোয়া দুইটি যুগ পেরিয়ে গেছে। আমাদের বাসার গেটে যে কৃষ্ণচূড়ার চারাটি রুয়েছিলাম একদিন, সেটি আজ পূর্ণ বৃক্ষ। প্রতি বছর ফাগুন এলেই রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায় তার। কিন্তু একই সময়ে রোপিত এই বুকের ভেতরের সেই চারাটি এখনো তেমনই রয়ে গেছে ! সপ্রাণ সতেজ। এবং বিষণ্নও। ছায়ার আবেশ নিয়ে এখনো বেড়ে উঠতে চায়...!
(১৭/০১/২০০৯)
[Published in the sachalayatan e-book "Khathgoray-golpo"]
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
1 comment:
ভাল লাগলো।
Post a Comment